-->
ইউক্রেন সঙ্কট

পুতিনের শরীরে কি ‘সেই’ রক্ত?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
পুতিনের শরীরে কি ‘সেই’ রক্ত?
পারমাণবিক অস্ত্রের মোতায়েন ও ব্যবহারের হুমকি ইউক্রেন যুদ্ধকে যে কোন সময় একটি ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে অনেকে বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ চলছেই। দু’মাস পেরিয়ে গেলেও কোনভাবেই থামছে না যুদ্ধ। সামরিক স্থাপনা, মিল-কারখানা, তেলের ডিপো, নিরীহ মানুষের বসতবাড়ি কোনটাই অক্ষত নেই। মারিউপলে দুই হাজার বৃহৎ বসতবাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। খারকিভে আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণ চলছে। জনমানবহীন ধবংস্তূপের মধ্যে ভগ্ন দালানের বিশ্রী অংশ ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে মানবতাকে উপহাস করছে। রয়টারের এক তথ্যে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যে ৬০ লক্ষ মানুষ প্রাণভয়ে দেশটি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়ে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। মারিউপলের একজন সরকারী কর্মকর্তা স্থানীয় রেডিওকে জানিয়েছে- রুশ বাহিনী শহরটিকে একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানিয়ে ফেলেছে।

এত নিষ্ঠুর কর্মকান্ড দেখে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ রাখঢাক না করে হঠাৎ একদিন দারুণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, “এডলফ হিটলারের শরীরে ইহুদি রক্ত ছিল।” আর তাতেই নড়ে চড়ে বসেছে পুতিন শিবির। এই মন্তব্যে অনেকটাই বিব্রত তারা। কারণ, ইহুদি জাতিসত্তার ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত করা চরম অবমাননাকর উক্তি এটি। যদিও ফিলিস্তিনিদের উপর ইহুদি আগ্রাসনের নির্মমমতার চরম সত্য কথাটি তিনি হিটলারের উদাহরণ দিয়ে মুখ ফস্কে বলে ফেলেছেন। আর এতেই নিজের বিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বিরূপ মন্তব্যের প্রতিবাদ না করে তিনি দ্রুত আগ বাড়িয়ে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নাফাতালি বেনেটের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বেনেটের সাথে টেলিফোনে এই ক্ষমা চান।

কারণ যুদ্ধ চললেও সারাবিশ্বে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দেশে দেশে তেল-গ্যাসের সংকট, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, হতাশা, অশান্তি জেঁকে বসতে শুরু করেছে। গোটা ইউরোপ জুড়ে গ্যাস-তেলের তীব্র সংকট এবং খাদ্য বাজারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা, সুদান ও আফ্রিকার নানা দেশে বিদ্রোহ ও খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে- বিশ্ব অচিরেই এক চরম খাদ্য ঘাটতির মুখোমুখি হতে চলেছে।

খাদ্য সংকটের কারণে কোটি কোটি মানুষ অপুষ্টি, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে সামনের মাসগুলোতে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট তৈরি হতে পারে। এই সতর্কবার্তা দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। দিন তিনেক আগে গুতেরেস বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের আশংকা- ইউক্রেন থেকে রপ্তানি স্বাভাবিক না হলে বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে। রাশিয়ার হামলার কারণে ইউক্রেনের বন্দরগুলো দিয়ে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এসব বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ সূর্যমুখী তেল, গম ও ভুট্টা রপ্তানি হতো। এগুলো বন্ধ হয়ে পড়ায় এখন বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যাপক কমেছে এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী এসব পণ্যের দাম ব্যাপক বেড়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম ইতোমধ্যেই সারাবিশ্বে অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে। সামনে আরো কাঠন বিপদ অপেক্ষা করছে বলে সতর্কবার্তা আসছে বারবার।ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রেডিওতে দেয়া এক বক্তব্যে বলেন, দেশটি চরম ওষুধ সংকটের মুখে রয়েছে। রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরের ৪০০ হাসপাতালে আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। ওষুধ কারখানা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এন্টিবায়োটিক ওষুধ, ইন্স্যুলিনের অভাবে জরুরী চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। ক্যান্সার রোগীদের চিৎিসা ও অস্ত্রপচার ব্যাহত হচ্ছে।

অন্যদিকে ইউরোপ ও ন্যাটো বসে নেই। তারা ইউক্রেনকে নানাভাবে সামরিক ও মানবিক সহায়তা প্রদান করে আসছে। ইউক্রেনকে ৩৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৪ এপ্রিল রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ মস্কোভাকে কৃষ্ণসাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এর অবস্থান নিশ্চিত করে তথ্য সরবরাহে পেন্টগণের গোয়েন্দাদের পরিকল্পনা ছিল। এপ্রিল ৮, বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেনে ১৬০ কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। বিদেশী সহায়তা প্রাপ্তির আশ্বাস পাবার পর খারকিভ শহরে পাল্টা আক্রমণ জোরদার করেছে ইউক্রেন। এখন মনে হচ্ছে এই যুদ্ধ সহসা থামবে না।

রাশিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র চীন ইউক্রেন যুদ্ধে ততটা পক্ষপাতিত্ব করতে আগ্রহী হচ্ছে না। চীনের প্রেসিডেন্ট শিন পিং গত দশ বছরে চল্লিশ বার পুতিনের সংগে সাক্ষাৎ করলেও রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করতে গিয়ে চীনের অনেক জটিল পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। তারা ‘নতুন চীনা নীতি’ ধরে রাখার জন্য তৎপর। এতে ন্যাটোর সাথে যেন বড় ধরণের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না হয় সেজন্য চীন ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ ফেলছে। জার্মানীও ইউক্রেনে সামরিক সরঞ্জাম ও মানবিক সহায়তা প্রদান করছে।

পৃথিবীতে যুগে যুগে হিটলাররা ক্ষমতায় আসে। আসে ছোট-বড় নানা ধরণের স্বৈরাচারী শাসন ও তাদের জুলুমের নব্য কৌশল। আধুনিক যুগে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে নিত্যনতুন আবরণে দেশে দেশে স্বৈরাচারী নির্যাতনের তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। এভাবে ‘মাৎস্যন্যায়’ বা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে নিরীহ ও সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে অধিকারহারা জনগোষ্ঠীতে

ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের অনুশীলণের দাবী করেছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু হবার ৭০তম দিনে রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদের পশিচমাঞ্চলীয় ছিটমহলে এই পারমাণবিক হামলার মহড়া চালানো হয় বলে দাবী করেছে মস্কো। এছাড়া পোলান্ড ও লিথুয়ানিয়ার মধ্যে অবস্থিত বাল্টিক সাগরের ছিটমহলে পারমাণবিক বোমা হামলায় সক্ষম ইস্কান্দার মোবাইল ব্যালেষ্টিক ক্ষেপনাস্ত্র হামলার সিমুলেটেড পরীক্ষণ চালানো হয়। এই ক্ষেপণাস্ত্র হাজার মাইল দূর থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের যে কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারঙ্গম বলে জানা গেছে। পারমাণবিক অস্ত্রের মোতায়েন ও ব্যবহারের হুমকি ইউক্রেন যুদ্ধকে যে কোন সময় একটি ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে অনেকে বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

পৃথিবীতে যুগে যুগে হিটলাররা ক্ষমতায় আসে। আসে ছোট-বড় নানা ধরণের স্বৈরাচারী শাসন ও তাদের জুলুমের নব্য কৌশল। আধুনিক যুগে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে নিত্যনতুন আবরণে দেশে দেশে স্বৈরাচারী নির্যাতনের তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। এভাবে ‘মাৎস্যন্যায়’ বা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে নিরীহ ও সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে অধিকারহারা জনগোষ্ঠীতে।পাশাপাশি কিছু মানুষের পেশীর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা নির্যাতনালয়। তারা নিজের অপকর্ম আড়াল করতে গিয়ে অপরাধের মাত্রা ভিন্নদিকে প্রবাহত করতে গিয়ে দুর্নীতি ও অপরাধের নতুন দিগন্ত সূচিত করে বিশ^বাসীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করতে কুন্ঠিত হয় না। তারা হয়ে যায় মানবতার শত্রু। এসব আত্মা অপকর্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে দুর্নাম কুড়িয়ে ঘৃণিত হয়। তারা মানুষের ঘৃণার আক্রোশে চিরবিদায় নেন এবং রেখে যান নিষ্ঠুর ইতিহাসের মর্মন্তুদ কাহিনী। ফেরাউন-নমরুদ-সাদ্দাদের কথা বাদ দিলাম। কেউ কি জেনেশুনে আধুনিক যুগে বা ভবিষ্যতেও এসব হিটলারদের নামে কারো বাচ্চাদের নাম রাখতে আগ্রহী?প্রেসিডেন্ট পুতিন কি সেই পথে চলছেন? সে যুগের রক্ত দূষণ এই সভ্য যুগে এখনও কি কারো শরীরে সত্যিই বইছে বা নিউরণেও জটিলতা তৈরী করেছে? হিটলারের ইহুদি রক্ত ও পুতিনের ৪০০ হাসপাতাল গুড়ানো তাহলে কি একই সূত্রে গ্রথিত?

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ-এর মন্তব্য অনুযায়ী পুতিনের শরীরে কি ইহুদিদের রক্তধারা প্রবাহমান? শরীরে এই রক্তধারা থাকলে কি মানুষ মানবতা ভুলে শত শত হাসপাতাল ধ্বংস করতে থাকবে? নাকি তিনি ন্যাটোর উস্কানীতে ইউক্রেন যুদ্ধের ফাঁদে পড়ে গেছেন? কেউ কেউ বলছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধিয়ে ন্যাটো খেলা দেখাচ্ছে এবং রাশিয়ার ক্ষমতা খর্ব করে জনপ্রিয়তা ধুলিস্মাৎ করে দিচ্ছে! এতে পৃথিবীর ক্ষমতাধরদের বাই-পোলার বা ভারসাম্যের খুঁটি দুর্বল হয়ে ইউনিপোলার হয়ে পড়ছে। ফলতঃ ইউনিপোলার বিশ্ব অদূর ভবিষ্যতে আরো মহা-স্বৈরাচারীর কবলে পড়তে যাচ্ছে।

কিছুদিন পূর্বে জাতিসংঘের মহাসচিব রাশিয়া সফর করে কি অর্জন করলেন তা অনেকের নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তিনি অজভেষ্টাল ষ্টিল কারখনায় আটকে পড়া মানুষগুলোকে দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়াসহ শরণার্থীদের মৌলিক সমস্যা নিরসনের কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে তার মতামতকে ক্রেমলিন ইতিবাচকভাবে নেয়নি। তবে কি যুদ্ধ চলতেই থাকবে, আর শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করতেই থাকবে? জাতিসংঘ শুধু সেসব শরণার্থীকে বাঁচানোর আবেদন নিয়ে যুদ্ধবাজ বিশ্বনেতাদের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দেবার কাজ করতে থাকবে? যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আর কে তাহলে আসল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে?যুদ্ধ বন্ধ করার দায়টা তাহলে কার? তা না হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর বাকী কোথায়? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য এখন শুধু পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার শুরুটাই বাকী। এটি হঠাৎ গর্জে উঠলে গোটা পৃথিবীতে মানবতার চরম বিপর্যয় সূচিত হতে আর বেশীদিন বাকী থাকবে না।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন

 

মন্তব্য

Beta version