ঘটনা-এক
পিনাক-৬ ডুবির পর একবার লঞ্চ পারাপার গাড়িতে ঢাকায় আসতেছিলাম। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীর অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না। কাওড়াকান্দি নেমে পরিবহণের নির্ধারিত লঞ্চে উঠলাম। পদ্মার মাঝ নদীতে এসে ঢেউয়ে এমন ধাক্কা শুরু করল, ঢেউয়ের পর ঢেউ। প্রতি ঢেউয়েই মনে হচ্ছিল এবারই হয়তো লঞ্চ ডুবে যাবে। দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করলেন অনেকে। কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে।
লঞ্চ ডুবে মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়লেন অনেকে। আমি ছেলেকে কোলে নিয়ে লঞ্চের মাথায় খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবছি আজই হয়তো......। ডুবতে শুরু করলেই ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত আমি। কিন্তু লঞ্চের ভেতরে বসে আছে স্ত্রী। ডুবে গেলে তো সে কোনোভাবেই বের হতে পারবে না। তাকে ডেকে বাইরে আনতেও পারছি না। কারণ যে যেখানে আছে- সেখান থেকে না নড়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ।
লঞ্চের চালকও দোয়া ইউনুস পড়ছেন, আল্লাহকে ডাকছেন আর লঞ্চ রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্ত্রী ভিতরে-ছেলে আমার কোলে। ডুবলে স্ত্রীর বাঁচার আশা ক্ষীণ। আর আমি এতটুকু কোলের ছেলেকে নিয়ে ঝাঁপ দিলে কতক্ষণ তাকে পানির উপরে রাখতে পারব। এসব চিন্তায় মুহূর্তে চোখে পানি চলে এলো। ধরেই নিলাম আজ সব শেষ। কিন্তু না। আল্লাহ রক্ষা করলেন। ধীরে ধীরে ঢেউয়ের গতি কমে এলো। লঞ্চও অনেকটা ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল।
এই ঘটনার পর আর কখনো ছেলেকে নিয়ে লঞ্চে পার হইনি। যতবারই বাড়ি গেছি। ফেরি পারাপার গাড়িতে গেছি। যতবার ওই ঘটনা মনে হয় ততবারই গা শিউরে ওঠে। গত ঈদেও বাড়ি যাওয়া হয়নি। বাড়ি থেকে বাবা-মা ফোন করেছেন, ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে যাব কি-না। ছেলে তার দাদা-দাদিকে বলেছে, লঞ্চ ডোবে-লঞ্চে আসব না ভয় লাগে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে, তারপর সেতু দিয়ে বাড়ি আসব।
ঘটনা-দুই
অন্তত বছর চারেক আগের কথা। হঠাৎ করে আমার জ¦র উঠে গেলে ১০৩-এ। একদিন পর ছেলেরও খুব জ¦র। ছেলের বয়স তখন ২ বছর। আমি জ্বরে এতই দুর্বল যে উঠে দাঁড়াতে পারি না। স্ত্রী আমাদের দু’জনকে নিয়ে কী ভাবে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হাসপাতালে নেবে তার একার পক্ষে সম্ভবও না। আমার এক বন্ধু আর এক কলিগ ছোটভাই আহমদ নূর ও নূরের বড় ভাই কাওছার এলো। স্ত্রীসহ তারা হাসপাতালে নিয়ে গেল। পরীক্ষায় বাপ-ছেলের ডেঙ্গু ধরা পড়ল। মাসের শেষ, হাতেও টাকা নেই। প্লাটিলেটও নামছে। দুর্বল হয়ে যাচ্ছি।
জ¦র শুনে প্রথম দিন থেকে মা-বাবা আসতে চাচ্ছিলেন। আবহাওয়া খারাপ থাকায় তাদের আসতে নিষেধ করেছিলাম। প্রতিদিনই যেতে হচ্ছে প্লাটিলেট কাউন্ট করাতে। ওদেরও অফিস আছে। ওরাও সবসময় থাকতে পারছে না। এরপর যখন দেখলাম আর পারছি না। তখন মা-বাবাকে আসতে বললাম।
আমার চিকিৎসার জন্য টাকা-পয়সা ডাব-পেঁপেসহ নানা কিছু নিয়ে সকালে বাসে উঠলেন। সকাল ১০টার মধ্যে কাওড়াকান্দি ঘাটে এলেন। আমার তো মোবাইলে কথা বলার মতো শক্তি নেই। স্ত্রীর সঙ্গে মা-বাবার কথা হচ্ছিল। এক ঘণ্টা পরপর ফোন দিচ্ছিল ফেরিতে উঠছে কি না? দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, ফেরিতে আর গাড়ি ওঠে না। কী ভাবে উঠবে পন্টুন পানিতে ডুবে গেছে। এরপর রাত ১ টার দিকে শুধু লোকজন তুলল ফেরিতে। আমার জন্য বাড়ি থেকে নিয়ে আসা সব জিনিস হাতে নিয়ে বাস থেকে নেমে ফেরিতে উঠল। ততক্ষণে বৃষ্টি আর পন্টুনের কাছ থেকে ঢেউয়ের পানিতে ভিজে গেল।
আমি তো ঘুম। মাঝে মাঝে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। রাত চারটার দিকে স্ত্রী ডেকে তুলল। বলল মা-আব্বা সায়দাবাদ এসেছে। এখন রিকশায় আসতেছে। ঠিকানা বলতে হবে। শুনে আরো টেনশন হলো। কারণ কয়েক দিন আগে যাত্রাবাড়ীতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে একজন নিহত হয়েছেন। তারা যদি আসার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। বাসা চেঞ্জ করেছি, আমার বাসা চেনেন না তারা। আমি বা আমার স্ত্রী কেউই নিচে গিয়ে নিয়ে আসতে পারব না। যাই হোক বাসার ঠিকানা বলা হলো। রিকশাওয়ালা নিয়ে গেল আরেক জায়গায়। এখানে-ওখানে ঘুরে ঘুরে ভোর ৫টার দিকে আমার বাসায় নিয়ে এলো। এই এক ঘণ্টার মধ্যে কতবার যে কথা হলো! এই এক ঘণ্টা ছিল আরো অনেক বেশি দুশ্চিন্তার। বাসায় আসলেন-কি যে অবস্থা। দু’জনেরই কাপড়চোপড় ভিজা। শীতে কাঁপছেন।
ঘটনা-৩
গেল ঈদুল ফিতরের আগের ঈদুল ফিতরে চিন্তা করলাম বাড়িতে যাব। তবে করোনার কারণে তখন বাস চলে না। চড়া মূল্যে একটা প্রাইভেটকার ঠিক করলাম। ঘাটে পৌঁছালাম তখন ৯টা। ভাবছিলাম হয়তো তাড়াতাড়ি ফেরি পার হতে পারব। শারীরিকভাবে তখন আমি বেশ অসুস্থ। গাড়িতেই ঘুমিয়ে গেলাম। যখন সজাগ হলাম তখন দেখি রাত আড়াইটা বাজে। গাড়ি যেখানেই ছিল সেখানেই আছে।
ঢাকার দিক থেকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার মতো মানুষ যাচ্ছে। ফেরি আসার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন দৌড়ে গিয়ে হুড়োহুড়ি করে ফেরিতে উঠে পড়ছেন। কাওড়াকান্দি থেকে নিয়ে আসা গাড়িও মাওয়ায় উঠতে পারছে না। লোকসহ ওই গাড়ি নিয়েই ফেরি আবার কাওড়াকান্দি যাচ্ছে। ভাবলাম সকালে দেখি কিছু করা যায় কি না। সকালে তো অবস্থা আরো খারাপ। সকাল ৮টার দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িতে যাব না। ঢাকায় ফিরে আসব। এখন পড়লাম আরেক বিপত্তিতে, গাড়ি ঘুরানোই সমস্যা। অনেকক্ষণ পর গাড়ি ঘুরাতে পারলাম।
এরপর খবর পেলাম, নারিশাবাজার থেকে হয়তো ট্রলারে পার হওয়া যেতে পারে। জিজ্ঞাসা করতে করতে গেলাম সেখানে। গিয়ে পেলামও। ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে ট্রলারে ওঠা যে কত কষ্টের। আমার ব্যাকপেইন। ভাই তুললেন সব। প্রায় ঘণ্টাখানেক নৌপথ পাড়ি দিয়ে উঠলাম এক চরে। চরের নাম সয়তানখালির চর। ভাই শ^শুরবাড়ির দিক থেকে ফোন করে আরেকটা প্রাইভেট কার আনালো। তাতে করে গেলাম গৌরনদী ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। সেখানে দুপুরে খেয়ে রওনা দিলাম। সন্ধ্যার পর বাড়ি পৌঁছলাম। এ জার্নিও টানা ২৪ ঘণ্টার। ঘাটে সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়তে হতো-ওয়াশরুম নিয়ে, খাওয়া নিয়ে।
বললাম মাত্র তিনটা ঘটনা। দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি মানুষের এমন অনেক দুর্ভোগের ঘটনা রয়েছে। ঘাটই আমাদের কাছে মনে হতো একটা বড় অভিশাপ। সেই অভিশপ্ত জীবনের অবসান ঘটছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে।
আমাদের বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার সাইনবোর্ড বাজারের কাছে। আমরা সাইনবোর্ড বাজার থেকেই ঢাকার বাসে উঠি। আগে আমার বাবাকে দেখেছি লঞ্চে ঢাকায় আসতেন। পিরোজপুরের হুলারহাট গিয়ে সেখান থেকে লঞ্চে উঠতেন। নামতেন সদরঘাট। পরিবহণ চালু হওয়ার পর মানুষ পরিবহণে যাতায়াত শুরু করেন। শুরু হয় মাওয়া কিংবা আরিচা ঘাট পার হওয়া। যখন থেকে ঢাকায় আসছি, ঘাটের দুঃখ ভোগ করেই এসেছি।
ঈদের সময় মাওয়ায় এত চাপ থাকে, এত সময় লাগে, টানা ৫ ঈদে বাড়ি যাইনি। কারণ কপাল খারাপ হলে কখনো ২৪ ঘণ্টা, কখনো ৩০ ঘণ্টা, কখনো বা আরো বেশি সময় লাগত। আরিচা হয়ে আসলে পথে কোনো সমস্যা না হলে, ফেরি ঘাটে জ্যাম না থাকলেও ১২-১৪ ঘণ্টা লেগে যেত। মাওয়া হয়ে আসলে ১০ ঘণ্টা লাগত। আর ঘাটে গাড়ির চাপ থাকলেও তো ১২, ১৪, ১৫ কিংবা ২০-২৪ ঘণ্টাও লেগে যেত।
একটা সময় লঞ্চ পারাপার সার্ভিস শুরু হয়। একই কোম্পানির দুই গাড়ি মাওয়া-কাওড়াকান্দি থাকে। ঢাকার যাত্রী মাওয়ায় নেমে পরিবহণের পক্ষ থেকে ঠিক করা লঞ্চে নদী পার হয়ে ওপার থেকে ওই কোম্পানির আরেক গাড়িতে উঠে গোপালগঞ্জ, মোল্লাহাট-ফকিরহাট-বাগেরহাট সদর-মোংলা-কচুয়া-মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলা, পিরোজপুর ও খুলনার মানুষ গন্তব্যে যান। লঞ্চ পারাপার গাড়িতে গেলেও আমাদের ৬ ঘণ্টা লেগে যায়। মাস দেড়েক আগে বাড়ি গেছিলাম তখন আসতে সময় লেগেছে ৪ ঘণ্টা ২৬ মিনিট। তাতে অনুমান করা যায়। সেতু দিয়ে বাগেরহাটে পৌঁছাতে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা।
সায়েদাবাদ ঢোকার সময় এবং বের হওয়ার সময় ধোলাইপাড় থেকে যাতে জ্যাম না লাগে সেই দিকে নজর রাখতে হবে। এমনিতেই সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ি প্রায়সময়ই জ্যাম থাকে। এখানে জ্যাম না থাকলে দ্রুতই মানুষ পৌঁছাতে পারবে গন্তব্যে।
লেখক : সাংবাদিক, দৈনিক ভোরের আকাশ
মন্তব্য