-->
শিরোনাম

চাই উদারবাদী সাংস্কৃতিক জাগরণ

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
চাই উদারবাদী সাংস্কৃতিক জাগরণ

বাংলাদেশের ভেতরে স্বাধীন বাংলাদেশের আসল রূপটিকে এখন খুঁজে পাই না। ১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্টের ভোররাতে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির দেশীয় দোসর এবং আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় সামরিক বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে গুলি চালিয়ে নৃশংসভাবে খুন করল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। হত্যা করল তার দুই কন্যাব্যতিত পরিবারের সবাইকে। বঙ্গবন্ধুর রক্তে সে ভোরের শ্রাবন মেঘ লাল হয়ে ভিজে গেল। তার রক্ত দেখা শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ ক্রমে প্রবেশ করতে শুরু করল স্বাধীন বাংলার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমরা হারাতে থাকলাম উদারবাদিতা। বাংলার সে ধারা সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত করতে কালো শক্তি জেগে উঠল। বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করতে শুরু করল হাটে মাঠে, বাজারে বন্দরে বাউলদের ওপর আক্রমণ। সুফি ধারার ইসলাম চর্চা ব্যাহত হতে হতে তার প্রাণশক্তি ক্ষীণকায় হওয়ার উপক্রম। আক্রমণ শাণিত হতে শুরু করল হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। কিন্তু কেন এমন হয়ে উঠতে থাকল বাংলাদেশ? পেছন না ফিরলে সবটা বুঝে ওঠা মুশকিল। ঊনিশ বাহাত্তর থেকে শুরু না করলেই নয়।

 

১৯৭২-এর সংবিধানে চার মূলনীতির একটি হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনল। সংবিধান কেটে ছেঁটে করা হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। অনেকের ধারণা, এটি একটি উদারবাদ। এর মাধ্যমে যারা আদিবাসী বা সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন, যেমন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, খেয়াং, মনিপুরি, সাঁওতাল, গারো তাদেরকে বৃহত্তর পরিসরে দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়। সঠিক নয় এটি। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬ (২)-এ লেখা, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন’, [সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন-২০১১]। যার অর্থ দাঁড়ায় যারা বাঙালি নন বা বাঙালি জাতির লোক নন অর্থাৎ ওইসব আদিবাসী বা সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষেরা কেউ বাংলাদেশের নাগরিক নন।

 

প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, কেন তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কেটে সংবিধান থেকে ফেলে দেয়া হলো? উত্তর সহজ। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে জাগরণ এবং স্বাধীনতা, তার আবেগ ও ইতিহাসকে খর্ব করা বা সেটিকে মুছে দেয়ার আয়োজন। এরই ধারাবাহিকতায় স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ ১৯৮৮ সালে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে সংবিধানে স্থান দেন। সংবিধান কাটাছেঁড়ায় এমন দ্বিতীয় আঘাতে বাংলাদেশের সমাজে ক্রমে ইসলামের মানবিক ধারার সুর বদলে উগ্রবাদী ইসলামে জায়গা করে নিতে শুরু করে।

 

বাংলাদেশের সমাজে বৃদ্ধি পেতে থাকে ধর্মীয় উগ্রবাদ। বিশ্বজুড়ে ও বাংলাদেশের সমাজে চিরকালই শান্তির বার্তাবাহক ইসলাম। সে ইসলাম সবাইকে একসাথে আলিঙ্গন করার ইসলাম। আমাদের মাঝে একটি দীক্ষা, তা হালো বাংলাদেশ সবার, হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টান এবং মুসলমানের। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বদলে দিল। প্রশ্রয় দিল স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিকে। শক্তি জোগাতে হাত বাড়াল কাঠমোল্লা ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের দিকে। বিশেষত, আফগানিস্তানে সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে তালেবান শক্তির বিকাশ এবং বাংলাদেশ থেকে অনেকের সেখানে মুজাহেদিনদের সাথে যুদ্ধ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বাংলাদেশের সমাজ বদলে যাওয়ার ক্ষেত্রে। কি রকম সেটা? যারা তালেবানদের সাথে যুদ্ধ করল, তারাই এক পর্যায়ে দেশে ফিরে তালেবানি ইসলামের কট্টোরবাদী ধারার প্রচারে নামল। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তাদের নিয়ে উদাস থাকল। ফলে গভীর হতে শুরু করল বোমা, গুলি ও কুপিয়ে মানুষ হত্যা করে শরিয়া আইন কায়েমের একটি বিকৃত পন্থা। অথচ ইসলাম যা বলছে, তা থেকে তারা দূরে। অন্তরে কুটিলতা নিয়ে ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী ধারার মোল্লায় এখন বাংলাদেশ ভরপুর। তারা আপন মতো করে ইসলামের কথা সাজায়। তাদের একটি বড় অংশ ইউটিউবে ওয়াজ নসিহত করে মূলতই নারীকে শয়তানের দোসর ও কুৎসিত হিসেবে বর্ণনা করতে। তারা নারীর শিক্ষার বিপক্ষে একটি কালো শক্তি। তারা সব উদারবাদিতার বিরুদ্ধে খুনের হুমকি দেয় প্রকাশ্যে। অনেককে খুনও করেছে।

 

কিন্তু আমরা কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এ প্রসঙ্গটি বুঝতে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ভাষণে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ’ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়ে যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছিলেন, তা জানা অপরিহার্য। খসড়া সংবিধানের ওপর পরিষদ সদস্যদের সাধারণ আলোচনা, দফাওয়ারি পাঠ ও সংশোধনীর পর ৪ নভেম্বর চূড়ান্তভাবে সংবিধান অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ‘সমাপনী ভাষণে’ বঙ্গবন্ধু পরিষদে একটি আবেগময়, বিস্তৃত ও বিশ্লেষণধর্মী ভাষণ দেন। জাতীয়তাবাদের মূল উপাদান কী তার স্বভাবসুলভ ভাষায় তা স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, ‘এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন- সবকিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘... আজ বাঙালি জাতি যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা নিয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা স্বাধীনতা নিয়েছি, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা সংগ্রাম করেছি, সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালি, আমার ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’।

 

বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েও সুস্পষ্ট করে কথা বলেন। তখনো ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যে অপপ্রচার চলছিল সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে দেশে ধর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে বলে যে সমালোচনা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু সেসবের জবাব দেন। তিনি জোর দিয়ে এ-কথা বলেন যে, ধর্ম পালনের অধিকার সবার থাকবে কিন্তু ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না। তার ভাষায় : ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে- কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের কেউ বাধা দান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।

 

২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। কেউ যদি বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’

 

কিন্তু কি দেখছি আমরা এখন? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্ম নিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন, সে বিষয়গুলোই এখন যেন রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের সমাজ অভ্যন্তরে। কী হচ্ছে না ধর্মের নামে! ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। ফলে হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালনে অনেক অঞ্চলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার- এসব চলেছে এই বাংলাদেশের মাটিতে।

 

এখান থেকে উত্তরণ চাই। এ কালো গহ্বরের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে উদারবাদী ধারার যুথবদ্ধতা দরকার। জরুরিভাবে দরকার পাড়া-মহল্লায় লাইব্রেরি তৈরি। পুরোনো লাইব্রেরির সংস্কার এবং সবটিতে মানবতা বিকাশ লাভ করে, বিজ্ঞান বোঝার দুয়ার উন্মুক্ত হয় এমন সব বইপত্র রাখা। বই পাঠের অভ্যাস গড়া। খেলার মাঠ দখলমুক্ত করা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপকহারে দেশজ সংস্কৃতির বিকাশকে সহায়তা প্রদান। সে জন্য বাজেট বৃদ্ধি না করলে সব ব্যর্থ। গ্রামেগঞ্জে যাত্রাপালা, গ্রাম থিয়েটার, সুফি ও বাউলগানের আসরকে সুরক্ষা দেয়া। একইসাথে, যারা ধর্মকে বিকৃত করে, ইসলামের অপব্যাখ্যা করে যৌন সুরসুরি দেয়া ওয়াজ করে, তাদেরকে সঠিক ধারায় আইনের আওতায় আনা।

 

এ কঠোরতা প্রয়োগে রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক কাজ। সমাজে বাস করা উদারপন্থিদেরও অনেক ভূমিকা। মাঠে নেমে উদারবাদী সংস্কৃতি বিকাশের ডাক দিতে হবে। একটি উদারবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচর্যা করতে হলে সব মানুষের বাংলাদেশ, এ সংস্কৃতির পরিচর্যা করা জরুরি। তা না হলে রোধ করা যাবে না ইসলামকে বিকৃত করায় লিপ্ত হওয়া বিকারগ্রস্তদের। নানা উপায়ে শিশু, কিশোর ও তরুণ মনকে বিষাক্ত করছে মৌলবাদীরা। এ জন্য দরকার শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন। উন্নয়ন ঘটাতে হবে মাদ্রাসা শিক্ষার। চালু করতে হবে একমুখি শিক্ষা। বাংলাদেশে পঙ্গু হয়ে পরা মানবিক সমাজকে আপন শক্তিতে বলিয়ান করতে সাহসের সাথে নামতে হবে পথে। বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ হিসেবে তৈরি করতে হলে মাঠে নেমে ডাক দিতে হবে সব মানুষকে আলিঙ্গনের।

 

লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ, কবি, কথাসাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

মন্তব্য

Beta version