-->
শিরোনাম

রান্না বাংলাদেশে খেতে বসেন ভারতে, এভাবেই চলছে জীবন

মানস বন্দ্যোপাধ্যায়
রান্না বাংলাদেশে খেতে বসেন ভারতে, এভাবেই চলছে জীবন

মানস বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম কেন্দ্রীয় সংসদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসে বেশকিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো। কলকাতার কিড স্ট্রিট থেকে আসা শ্যামলী পরিবহনের সৌহার্দ্য বাসটি যখন ঢাকায় পৌঁছল তখন বাসের চালক নিতাই মন্ডল ও কন্ডাক্টর অভিজিৎ সরকারের সঙ্গে পরিচয় হলো।

 

দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে তারা ঢাকায় পৌঁছনোর পর আবার ৪ ঘণ্টা পর কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেবেন জানালেন। পৌঁছবেন পরদিন দুপুরে। আবার কয়েক ঘণ্টা পর আগরতলার পথে পাড়ি দেবেন। তাহলে ঘরে যান কখন? খাওয়া-দাওয়া কোথায় হয়?

 

অভিজিৎ ও নিতাই জানালেন, তাদের বাড়ি যথাক্রমে সোদপুর ও বনগাতে। ঘরে তাদের যাওয়া হয় না। গাড়িই তাদের ঘরবাড়ি। গাড়িই তাদের সংসার। গাড়িতে অথবা রাস্তায় খেয়ে নেন। জামাকাপড় বদল করেন রাস্তার ধারে কোনো হোটেল বা রেস্তোরাঁয়। ঘরে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমনকি পূজাতেও নয়।

 

নিতাই বলছিলেন, তার শিশুকন্যাকে স্কুলে ভর্তি করেছিলেন কবে জানা নেই। হঠাৎ করে এক দিন বাংলা বন্ধের সুযোগে বাড়িতে গিয়ে দেখেন তার শিশু কন্যা নেই। তার স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি যুবতী মেয়ে। সব মধ্য শিক্ষা পাশ করেছে। স্ত্রীর কাছে জানলেন সেই মেয়েই তার আদরের কন্যা। সেদিন তিনি অঝোরে কেঁদেছিলেন।

 

একই অবস্থা অভিজিতের। সোদপুরে যাওয়ার সুযোগ ঘটে না। পশ্চিমবঙ্গে তার কাটে মাত্র ১০ ঘণ্টা। বাংলাদেশে কাটে ১৪ ঘণ্টা। তারা তাহলে কোন দেশের নাগরিক?

 

মৃদু হেসে বললেন, গত ১০ বছর ভোট দিতে পারেননি। ভোটের সময় তাদের বাসেই থাকতে হয়। ঘরে টাকা পাঠিয়ে দেন দুজনেই। অনলাইনে। মোবাইলে কথা হয় দৈনিক। পরিবারের চিন্তা পদে পদে। টেলিফোনে সন্তানদের খবর জানান স্ত্রী। কোন ক্লাসে উঠল, কত নম্বর পেল। চোখে জল নিয়েই বললেন তারা কোন দেশের নাগরিক বোঝা মুশকিল। বাংলাদেশের গতিপথে সবাই তাদের চেনেন। বাসের যাত্রীদের কোনো অসুবিধা হয় না। ইমিগ্রেশন পদ্ধতি তাদের মুখস্ত। পেট্রাপোল, বেনাপোলে তারাই যাত্রীদের সাহায্য করেন ভারপ্রাপ্ত অধিকারীদের সঙ্গে কথা বলে। কখনো ঢাকার পথে, কখনো খুলনার বাসে, কখনো আগরতলা হয়ে চট্টগ্রামের পথে, কখনো গুয়াহাটি থেকে উত্তরবঙ্গ হয়ে ঢাকার পথে চলতে হয়।

 

অভিজিৎ এবং নিতাই কথা বলার সময় মুখে গুটকা থাকায় কথা অস্পষ্ট হয়। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা বলেন, তাদের মুখে সবসময় গুটকা থাকে। অভিজিৎ একটি প্যাকেট খুলে দেখলেন তাতে ৪০টি গুটকার প্যাকেট রয়েছে। গাড়ি চালানোর সময় যাতে কোনোমতেই ঘুম না আসে তার জন্যই মুখে রাখতে হয় গুটকা। না হলে অ্যাক্সিডেন্ট অনিবার্য। তাহলে ঘুমোন কখন? বললেন ঘুমের সুযোগ কোথায়? গন্তব্যস্থলে পৌঁছে ঘণ্টাখানেক আবার ফিরে যাওয়ার পর ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেন তারা। সে এক অদ্ভুত জীবন তাদের। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম তাদের কথা। এমন দুর্বিষহ জীবন সত্তে¡ও কত সতেজ রাখতে হচ্ছে শরীর। আসলে সত্যিই কি তারা সুস্থ থাকতে পারবেন কয়েক বছর পর?

 

বাংলাদেশের বয়রা গ্রামে মোট ৬০টি পরিবারের বসবাস। তবে সমস্যা রেজাউলেরই। তার বসতবাড়ির ৯ বিঘা জমি পশ্চিমবঙ্গে ও ৭ বিঘা জমি বাংলাদেশে পড়েছে। মাঝখানে সীমান্ত রেখা। রেজাউলের এক ছেলে কাজ করেন কলকাতা পুলিশে। কিন্তু মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন যশোরে।

 

সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কোনো এক দিকেই স্থায়ীভাবে যেতে অসুবিধে দেখা দিয়েছে। তবে ভারত ভুখন্ডেই চলে এসেছেন তিনি।

 

কারণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জমি। চাষ করার সময় অনেক ঝক্কি। দু’পারে সীমান্তরক্ষীর অনুমতি নিয়ে চাষ করতে পারেন। ওই ৭ বিঘা জমিতে যে ধান হয় তা দিয়েই কোনোক্রমে সারা বছরের খাওয়ার চালটা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওপারের ধান ওপারেই বিক্রি করে আসতে হয়।

 

বলা যেতে পারে তিনি দুই দেশেরই বাসিন্দা! এপার ওপার দুপারেই ট্যাক্স দেন রেজাউল মন্ডল রান্না ঘর ভারতে। কিন্তু খেতে বসেন বাংলাদেশে। সীমান্ত এভাবেই ভাগ করেছে উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা সীমান্তের বয়রা গ্রামের এই বাসিন্দাকে। আদতে কোন দেশের নাগরিক তা এই ৬৫ বছরে বুঝে উঠতে পারেননি রেজাউল।

 

ঠিক যেন বালুরঘাটের একটি বাড়ির মতো। সেখানে দুটি ঘর হিলিতে ও একটি ঘর বাংলাদেশে। দুই ঘরের মধ্যে একটি একজন বাংলাদেশে রাত্রিযাপন করেন, অপর দুজন ভারতের অংশে রাত কাটান। ধান্দাবাজদের দৌলতে দুই দেশের মধ্যে চোরাই কারবারের পিঠস্থান হয়ে পড়েছে বাড়িটি। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে সিসিটিভি লাগানো হয়েছে।

 

বাংলাদেশের খাতায় রেজাউলের ঠিকানা যশোরের গদাধরপুরে। রান্না ঘরের জন্য ট্যাক্স দেন ওপারে হাসিনা সরকারকে। সীমান্তরক্ষীদের কাছে তিনি এখন ৩৯/১১ পিলারের বাসিন্দা। দেশভাগের সময় সীমান্ত চলে গেছে তার উঠোনের ওপর দিয়ে। ফলে বিভক্ত হয়ে গেছে তার বাস্তুভিটা। কোনো একদিকে যে চলে যাবেন তাও ঠিক করে উঠতে পারেননি। সেই থেকে এভাবেই চলছে। কাঁটাতারে বেড়া এখানে নেই। তাতে বিপদ বেড়েছে অনেকটাই। চব্বিশ ঘণ্টা চলে বিএসএফ কিংবা বাংলাদেশের বিজিবির নজরদারি।

মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীণ সাংবাদিক, নিউ দিল্লি, ভারত।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version