মিলু শামস: খাদেমুল-আরমাইন বাদশা ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্পের নির্দেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় মূল তফসির মারেফুল কোরআনের বাংলা অনুবাদে চতুর্থ সূরা আন-নিসায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বলেছেন, ‘কোরআন পাক কন্যাদেরকে অংশ দেয়ার প্রতি এতটুকু গুরুত্বারোপ করেছে যে, কন্যাদের অংশকে আসল ভিত্তি সাব্যস্ত করে এর অনুপাতে পুত্রদের অংশ ব্যক্ত করেছে এবং দুই কন্যার অংশ এক পুত্রের অংশের সমপরিমাণ বলার পরিবর্তে এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমপরিমাণ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।
অনেকেই বোনদের অংশ দেয় না এবং বোনরা এ কথা চিন্তা করে অনিচ্ছা সত্তে¡ও চক্ষু লজ্জার খাতিরে ক্ষমা করে দেয় যে, পাওয়া যখন যাবেই না, তখন ভাইদের সঙ্গে মন কষাকষির দরকার কি! এরূপ ক্ষমা শরীয়তের আইনে ক্ষমাই নয়; ভাইদের জিম্মায় তাদের হক পাওনা থেকে যায়। যারা এভাবে ওয়ারিসি স্বত্ব আত্মসাৎ করে, তারা কঠোর গুনাহগার। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নাবালেগা কন্যাও থাকে। তাদের অংশ না দেয়া দ্বিগুণ গুনার।
এক গুনাহ শরীয়তসম্মত ওয়ারিশের অংশ আত্মসাৎ করার এবং দ্বিতীয় গুনাহ এতিমের সম্পত্তি হজম করে ফেলার। এরপর আরো ব্যাখ্যা সহকারে বলা হয়েছে, যদি পুত্রসন্তান না থাকে, শুধু একাধিক কন্যাই থাকে, তবে তারা ত্যাজ্য সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে। এতে সব কন্যাই সমান সমান অংশীদার হবে। অবশিষ্ট তিন ভাগের এক অন্যান্য ওয়ারিশ যেমন মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা, স্ত্রী অথবা স্বামী প্রমুখ পাবে।
কন্যাদের সংখ্যা দুই বা তার বেশি হলে দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে তারা সমান অংশীদার হবে।... উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ওয়ারিশরা যে মালিকানা লাভ করে তা বাধ্যতামূলক। এতে ওয়ারিশের কবুল করা এবং সম্মত হওয়া জরুরি ও শর্ত নয়, বরং সে যদি মুখে স্পষ্টত বলে যে, সে তার অংশ নেবে না, তবুও আইনত সে নিজের অংশের মালিক হয়ে যায়। এটা ভিন্ন কথা যে, মালিক হওয়ার পর শরীয়তের বিধি অনুযায়ী অন্য কাউকে দান, বিক্রি অথবা বিলি বণ্টন করে দিতে পারবে।... পুুরুষদের যেমন উত্তরাধিকারের হকদার মনে করা হয়, তেমনি নারী ও শিশুদের এ হক থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
কেননা, সন্তানের সম্পর্ক হোক কিংবা পিতা-মাতার সম্পর্ক হোক অথবা অন্য কোনো সম্পর্ক হোক, প্রত্যেকটিতেই সম্পৃক্ততার মর্যাদা ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সমান। ছেলে যেমন পিতা-মাতা থেকে জন্মগ্রহণ করে, তেমনি মেয়েও পিতা-মাতারই সন্তান। উত্তরাধিকার স্বত্ব সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই ছোট ছেলে কিংবা মেয়েকে বঞ্চিত করার কোনোই কারণ থাকতে পারে না।’
১৯৯৭ সালে প্রণীত নারীনীতির যেসব ধারা নিয়ে কোরআন-সুন্নাহ অবমাননার জিগির উঠেছিল তা এ রকম- নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরি বিষয়াদি যথা-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও প্রযুক্তিতে নারীকে পূর্ণ ও সমান সুযোগ প্রদান করা (ধারা ২৫.১)। ২৫.২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উপার্জন উত্তরাধিকার, ঋণ, ভ‚মি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।
এ ছাড়া জাতীয় অর্থনীতির সব কর্মকান্ডের নারীর সক্রিয় ও সমঅধিকার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে ২৩.৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া। ২৩.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজমান পার্থক্য দূর করা। ২৩.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রতিহত করার লক্ষ্যে নারীর অনক‚লে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা।’
যারা বিরোধিতা করেছিল তারা নারীনীতিতে কোরআন-সুন্নাহর অবমাননা দেখেছে কিন্তু সম্পত্তি বিলি-বণ্টনে কোরআন বর্ণিত বিধান প্রতিমুহূর্তে লঙ্ঘিত হচ্ছে। তা নিয়ে কথা বলেনি। বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই, নিজেদের পরিবারে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে খোঁজ নিলে দেখা যাবে বোনদের প্রাপ্য সম্পত্তি দিতে বেশিরভাগ ভাইয়েরই মুখ ভার হয়। নানা ধরনের টালবাহানা-ক‚টকৌশল প্রয়োগ থেকে শুরু করে নির্যাতন এমনকি হত্যার সাক্ষী তো খবরের কাগজ।
স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে- ‘উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ওয়ারিশরা যে মালিকানা লাভ করে তা বাধ্যতামূলক। এতে ওয়ারিশরা কবুল করা এবং সম্মত হওয়া জরুরি ও শর্ত নয় বরং সে যদি মুখে স্পষ্টত বলে যে, সে তার অংশ নেবে না, তবুও আইনত সে নিজের অংশের মালিক হয়ে যায়।’ এই মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। এও ইসলামের বিধান, কোরানের নির্দেশ। এতেও তো কোরআন-সুন্নাহ লঙ্ঘন হচ্ছে।
ধর্মের জন্য এ ধরনের মায়াকান্না বহু পুুরোনো। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনে নেমেছিলেন তখন হিন্দু ধর্মের ‘রক্ষক’রা ধর্মের কাঁদুনী গেয়েছিল। কিন্তু বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন ঠেকাতে পারেনি। কারণ সবকিছুর পরও সমাজ সামনে এগোয়।
নারীনীতির পূর্বাপর না জেনেই বিরোধিতাকারীরা লাফঝাঁফ করেছে। নারীনীতি যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার ভিত্তি সিডও সনদ। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ সনদ গৃহীত হয়। সিডও পরিপূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দলিল। তিন ধারায় সংরক্ষণ আরোপ করে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে সিডও সনদ অনুমোদন করে।
পরে ১৯৯৭ সালে দুটো ধারা থেকে সংরক্ষণ তুলে নিলেও ধারা-২ এবং ধারা ১৬-১ (গ) থেকে এখনো সংরক্ষণ তোলেনি। সরকারি বক্তব্য অনুযায়ী, মুসলিম শরিয়া আইন পরিপন্থি বলে এ ধারা অনুমোদন করা হয়নি। প্রথম নারীনীতিও প্রণয়ন হয় ১৯৯৭ সালে। এরও পূর্ব ইতিহাস আছে। ১৯৯৫ সালে বেজিং নারী শীর্ষ সম্মেলনে নারী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনায় যে ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল যা প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন নামে পরিচিত তার আলোকেই নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
উদ্দেশ্য ছিল নির্যাতিত ও অবহেলিত এ দেশের নারী সমাজের বড় অংশের জীবনমান উন্নত করা। ১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে এ নীতি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় এ নিয়ে একদফা হৈ চৈ হয়েছিল। ২০০৪-এ পরিবর্তিত সরকার এসে কিছু শব্দ পরিবর্তন করে আবার নারীনীতি ঘোষণা করে। এতেও সামান্য সংশোধনী এনে তত্ত¡াবধায়ক সরকার আবার নারীনীতি ঘোষণা করে। তখনো বায়তুল মোকাররম এলাকায় এ নিয়ে রক্তারক্তি হয়েছে।
অর্থাৎ নীতি যখন নারীদের নিয়ে তখন এর বিরোধিতা করতেই হবে। অথচ নারীনীতি যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সেই সিডও সনদের গুরুত্বপূর্ণ ধারাতেই শরিয়া আইন পরিপন্থি বলে সংরক্ষণ আরোপ করে রাখা হয়েছে। শরিয়া আইন বলতে সচরাচর মুসলিম পারিবারিক আইনকে বোঝানো হয়। কিন্তু হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মের নারীদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয়নি।
হিন্দু পারিবারিক আইন অনুযায়ী সম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার নেই। খ্রিস্টান নারীদের অবস্থাও প্রায় এক। নীতিতে যেমন উল্লেখ নেই তেমনি সাধারণেও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। হিন্দু নারী বঞ্চিতদের মধ্যে বঞ্চিততর। খোঁজ নিলে দেখা যাবে ওই ধর্মের ‘রক্ষকরা’ও মানসিকতায় অভিন্ন।
মুশকিল হলো নারী সম্পর্কিত কিছু হলে সবাই ভাবে এ নারীদের বিষয় নারীরাই লড়বে। কিন্তু নারী সমাজ বিচ্ছিন্ন নয়, তার সঙ্গে পুরুষ সম্পর্কিত। যেকোনো নারী ইস্যু তাই সামাজিক ইস্যু। নারী উন্নয়ন নীতি আসলে কি তা ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করলে সম্পত্তি হারানোর আতঙ্ক যেমন থাকবে না তেমনি কোরআন-সুন্নাহ অবমাননার ধুঁয়া তুলে স্বার্থসিদ্ধির অবকাশও থাকবে না।
লেখক: কলামিস্ট
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য