এ এ জাফর ইকবাল: আমাদের প্রধান খাদ্য চাল। ধান থেকেই আমরা পেয়ে থাকি চালের সরবরাহ। অথচ এখন অধিকাংশ কৃষক ধান আবাদে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে পরিস্থিতির কারণে। একই অবস্থা সোনালি আঁশ পাটের। দ্রুত কমে যাচ্ছে পাটের আবাদ। অন্য কোনো ফসল করার যাদের কোনো সুযোগ নেই, তারাই শুধু পাট আবাদটি ধরে রেখেছেন।
কৃষককে ধান ও পাট উৎপাদনের প্রতি যত্নবান করে রাখতে হলে খুঁজতে হবে সমস্যা। ভর্তুকি দেয়ার মতো সমস্যা নিরসনের সাময়িক উদ্যোগ বাদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে যেতে হবে ধান ও পাটের উৎপাদনকে।
ধানের মৌসুমে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান ও চাল কিনে থাকে। চালের মূল্য ৪২ টাকা প্রতি কেজি, আর ধান ২৮ টাকা। বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এক কেজি ধান উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ হয় সাড়ে ২৭ টাকারও বেশি। এ অবস্থায় কৃষক কেন সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করবে?
তারপরও মৌসুমে কৃষক সরকারি গুদামে দেয় কারণ তখন তাদের তাৎক্ষণিক অর্থ আহরণ জরুরি হয়ে থাকে। ভেজা ধান, চিটা ধান এবং অপুষ্ট মরা ধান দিয়ে কোনোরকমে ভরে সরকারি গুদাম। ফলে সরকারি গুদামে চালের গুণগত মানও নিম্ন পর্যায়ের।
এখন ধান চালের দাম বেড়েছে খোলা বাজারে। কিন্তু প্রান্তিক কৃষকের ঘরে ধান চাল নেই। সবই চলে গেছে চাতাল ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের কাছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে যাতে কৃষক লাভবান হওয়ার সুযোগ পায়। শিল্পায়নে আনতে হবে শস্যের উপজাতগুলোকে কৃষিকে নতুন মাত্রা দেয়ার প্রয়োজনে।
ধান যাতে কৃষক তাৎক্ষণিকভাবে বিক্রি না করে, কয়েকটি মাস নিজদের নিয়ন্ত্রণে সংরক্ষণ করতে পারে, সে ধরনের আর্থিক ব্যবস্থাপনা এখন জরুরি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কৃষকের ধান সংরক্ষণের উপায় বের করার জন্য বিদেশি সাহায্য সংস্থার উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো গ্রামীণ পর্যায়ে শস্যগুদাম ঋণ নামে একটি বিশেষ ধরনের ঋণ প্রক্রিয়া চালু করেছিল।
এ প্রক্রিয়ায় কয়েকজন কৃষক মিলে নিজেরাই নিজেদের ধান সংরক্ষণ করতে পারতেন। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সংগৃহিত ধান বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারতেন। ধানের দাম বাড়লে সে ধান বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধসহ নিজেদের প্রয়োজনীয় পাওনা বুঝে নিতে পারতেন। এই প্রক্রিয়া আবারো চালু করার সময় হয়েছে।
ধান আবাদের উপজাত সামগ্রী হলো কুড়া, তুষ এবং খড় বা বিচালি। কুড়া থেকে তেল উৎপাদন শুরু হয়েছে বছরকয়েক আগে। গুণগত মানের দিকে থেকে ধানের কুড়ার তেল সয়াবিন ও পাম অয়েলের চাইতে অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। তারপরও ভোক্তাদের কাছে এ তেল জনপ্রিয় হয়নি। একে জনপ্রিয় করার জন্য প্রচার চালাতে হবে।
উল্লেখ্য, ধানের কুড়া থেকে তেল উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি স্থানীয় বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার নয়। এটি এসেছে বিদেশ থেকে এবং এনেছেন মিল মালিকরা। এ তেলে একটা গন্ধ আছে যা পারিবারিক পর্যায়ে রাঁধুনিদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। স্থানীয় বিজ্ঞানীদের এ তেলের অপ্রয়োজনীয় গন্ধ দূর করার জন্য গবেষণা করা উচিত এবং তেলে পরিমিত ভিটামিনের সংমিশ্রণ দিয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য করাও প্রয়োজন।
অদ্যাবধি প্রয়োজনীয় ভোজ্যতেলের মধ্যে শতকরা ৭৮ ভাগ আমদানিকৃত অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। এটাকে নামিয়ে যদি ৫০-এও আনা যায়, তাহলে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো যাবে এবং একইসঙ্গে ধান উৎপাদনে আসবে নতুন মাত্রা।
ধানের তুষ শুধু জ্বালানি হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। কাঠের বিকল্প হিসেবে তুষ ব্যবহারে নতুন পণ্য আবিষ্কার ও উৎপাদন শুরু করা প্রয়োজন। চীনে তুষের ব্যবহার হচ্ছে কাঠের বিকল্প হিসেবে। ফিলিপাইনও এ বিষয়ে গবেষণা করছে। সে পথেও এগুতে হবে অতিদ্রুত।
ধান উৎপাদনের তৃতীয় উপজাত হচ্ছে খড়। আগে গ্রামে কুঁড়েঘর তৈরি হতো ছনের বিকল্প খড় দিয়ে। এখন তো গ্রামে কুঁড়েঘর অনেক কমে গেছে। খড় ব্যবহার হচ্ছে গবাদিপশুর খাবার হিসেবে এবং গ্রামীণ পরিবারগুলোর জ্বালানি হিসেবে। এই খড়কেও শিল্পায়নের আওতায় এনে কাঠের বিকল্প শিল্পজাত পণ্যও কাগজের মন্ড উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে।
সময়ভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব এ কাজ করতে হবে। খড় ও কুড়া দুটোরই চাহিদা আছে গবাদিপশুর খাবার তৈরিতে। কিন্তু আধুনিক পশুসম্পদ উন্নয়নে এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় না এনে শিল্পায়িত পশুখাদ্য উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোতে। সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
গ্রাম থেকে ঢেঁকি ও গাইল ছিয়ার ব্যবহার এখন উঠে গেছে। ‘বারানি’ নামের মহিলাকর্মীও এখন আর নেই। অধিকাংশ পরিবার বাজারে ধান বিক্রি করে চাল কিনে নেয়। বৌ-ঝিরা এখন আর কেউই বাড়িতে ধান সিদ্ধ করা ও চাল করার কাজেও সময় দিতে আগ্রহ দেখান না। এখানেও আনতে হবে নতুন মাত্রা। যখনি কুড়া, তুষ বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয়ের ব্যবস্থা হবে তখনই গ্রামের মানুষ সেদিকে যাবে। বাড়তি একটা ব্যবস্থা গ্রামে দেখা যাচ্ছে, পোর্টেবল বিদ্যুৎচালিত ধান ভাঙার মেসিন গ্রামে গ্রামে ব্যবহার শুরু হয়েছে। সেগুলোর সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। এভাবেই সংকুচিত করতে হবে চাতাল ব্যবসায়ী এবং মিল মালিকদের দৌড়াত্ম্য।
পাটের অবস্থানটি দুর্ভাগ্যজনক। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্প প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি গত ২০২০ সালে একসঙ্গে ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। বেকার হয়েছে আড়াই হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। আদমজি পাটকলের গল্প তো এখন ইতিহাস হয়ে গেছে।
বেসরকারি পর্যায়ে কয়েকটি পাটকল নতুনকরে চালু হলেও বস্তা, সুতলি এবং সুতা তৈরির ওপরই এগুলো নির্ভরশীল। মূলত পাট উৎপাদনটা টিকে আছে কাঁচাপাট রপ্তানির ওপর।
ডেনমার্ক বাংলাদেশের পাট দিয়ে ছোট ও মাঝারি নৌযানের বডি তৈরি করে অভ‚তপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। অথচ আমাদের বিজ্ঞানীরা পাটের আঁশ এবং পাট উপজাত সামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন কোনো পণ্য উৎপাদনে সক্ষম হননি। স্বাধীনতার বেশ আগে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. কুদরত-ই-খুদা আবিষ্কার করে গেছেন পাটখড়ি থেকে পারটেক্স। সেই অভূতপূর্ব সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে পারটেক্স শিল্প প্রতিষ্ঠান। নতুন কোন শিল্প-সামগ্রী উপহার দিতে পারেননি কেউ অদ্যাবধি।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে পাটখড়ি পোড়ানো ছাই রপ্তানি হচ্ছে চীন ও ইতালিতে। এ কাজে আমাদের বিজ্ঞানীদের কোনো অবদান নাই। ব্যবসায়ীরা বিদেশ গিয়ে পাটের পোড়ানো ছাই দেখে এসে এগুলো দেশে উৎপাদন শুরু করেছে। পাটপাতা এবং পাটের বীজ উল্লেখযোগ্য দুটি রাসায়নিক শিল্পের উপকরণ। গত শতাব্দীর শেষপ্রান্তে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন খুলনায় কাঁচা পাট থেকে কাগজের মÐ তৈরির কাজ শুরু করলেও আঁতুড়ঘরেই মৃত্যু ঘটেছে শিল্পটির।
কৃষককে ধান ও পাট উৎপাদনের প্রতি যত্নবান করে রাখতে হলে খুঁজতে হবে সমস্যা। ভর্তুকি দেয়ার মতো সমস্যা নিরসনের সাময়িক উদ্যোগ বাদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে যেতে হবে ধান ও পাটের উৎপাদনকে।
কৃষি খাত থেকে পাট এবং ধানকে কোনো অবস্থাতেই নিঃশেষ হতে দেয়া যাবে না। এ কথা অসত্য নয় যে, এক একর জমিতেই আড়াই-তিন ফুট মাটি কেটে পুঁটি মাছের চাষ করলেও কৃষক বছরে আয় করতে পারে জমির দামের দ্বিগুণের বেশি মুনাফা। সঙ্গত কারণেই দরিদ্র কৃষক ধান-পাট আবাদ বাদ দিয়ে সেদিকেই ঝুঁকবেন। আমাদেরই পথ বের করতে হবে ধান পাট আবাদের ওপর নির্ভরশীল আবাদি উপজাত পণ্যের নতুন নতুন সম্ভাবনাময় শিল্প।
বিগত ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় গবেষণা উপকেন্দ্র বসিয়েও পাট ও পাটের উপজাত পণ্যের আধুনিক শিল্পোৎপাদন নিশ্চিত করতে পারেনি। এটা তাদের কাজও নয়। এ কাজটি করা উচিত বাংলাদেশ শিল্প ও গবেষণা পরিষদের।
১৯৭০ সালে গাজীপুরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ফিলিপাইনের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের আদলে গড়ে ওঠা ইনস্টিটিউটের ব্যাপক সাফল্য নানাভাবেই পৃথিবীতে সমাদৃত। কিন্তু তাদেরও পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতো ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে শিল্পায়ন নিয়ে গবেষণার সুযোগ নেই।
কৃষি উৎপাদনের উপজাতগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে নিতে হবে শিল্পায়নে। অসম্ভব কোনো কাজ নয় এটি। আমাদের বিজ্ঞানী আছে, গবেষণাকেন্দ্র আছে, অবকাঠামো আছে, অভাব শুধু সমন্বিত উদ্যোগের। এই উদ্যোগের উপযুক্ত সময় এখনই।
পাঁচটি পদ্মা সেতু করলে যে উপকার হবে, শুধু পাট ও ধানের ওপর নির্ভর শিল্পায়নে তার চাইতেও অধিক টেকসই সুফল আসবে। ভর্তুকি দিয়ে দীর্ঘদিন কৃষি উৎপাদন সমুন্নত রাখা যাবে না। উৎপাদক যদি তার উৎপাদনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধমে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে কোনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই পাট ও ধান পরিত্যক্ত ফসলে রূপান্তরিত হবে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য