-->
শিরোনাম

রমজানের আগেই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে কেন?

নাজনীন বেগম
রমজানের আগেই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে কেন?

নাজনীন বেগম: পবিত্র রমজানের আগেই নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। সংগত কারণে খাদ্য সংগ্রহ ও খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির অসহনীয় ফারাকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছে তা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত ছিল না। তেমন পালাক্রমে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকও উৎপাদন পদ্ধতি ও বণ্টনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়, যারা সংখ্যায় কম।

 

সিংহভাগ মানুষ তাদের শারীরিক শ্রম ছাড়া সবই হারিয়ে বসে। কিছু পার্বণ, উৎসব আর ধর্মীয় আয়োজনকে কেন্দ্র করে নিত্য ভোগ্যপণ্যের ওপর যে মাত্রায় মূল্য বাড়িয়ে দেয় তা অসহনীয় হলেও এটাই বাস্তব প্রেক্ষাপট। বিশেষ করে প্রতি বছরই পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার আগেই দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের ওপর যে অসহনীয় চাপ তৈরি হয় তা সামলানো সত্যিই কঠিন। সরকার নানামাত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সময়ক্ষেপণ না করলেও দ্রব্যমূল্যকে সহনীয় রাখা দুঃসাধ্য।

 

তার ওপর ২০২০ থেকে ২০২১ সাল দুই বছরের লাগাতার করোনা দুর্ভোগ বিশ্বব্যাপী যে ক্ষতবিক্ষত আঁচড় বসায় তার চরম বিপত্তিতে ২০২২ সালের পুরো বছর অর্থনৈতিক মন্দার যে বিপদসংকেত দৃশ্যমান হতে থাকে সেটাও যেন নিত্য চাহিদার ওপর চরম প্রকোপ। ভোজ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির যে বিসদৃশ অবস্থা তা কখনোই আগের অবস্থায় ফেরার কোনো সুযোগ আর নেই। তেল নিয়ে তেলেসমাতির শেষ পরিশেষও নেই। তবে পেঁয়াজ নিয়ে ব্যবসায়ী মহলের যে কারসাজি সেটা এখন কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে।

 

ইতোমধ্যে চিনির দাম শুধু বেড়ে যাওয়া নয়, তার চেয়েও বেশি বাজার থেকে এই প্রয়োজনীয় পণ্য উধাও হয়ে যাওয়াও ভোক্তা শ্রেণিকে বিড়ম্বনার আবর্তে ফেলে দেয়। এমন নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যকে সামলাতে খোদ সরকারও যেন হিমশিম খায়। ন্যায্যমূল্যে দ্রব্য বিতরণই শুধু নয়, হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে কার্ড দেওয়াও শুরু হয়। এখানেও অনেক ঘাটতি উঠে আসতে সময় লাগে না।

 

রমজান আসতে এখনো প্রায় মাসখানেক বাকি। ইতোমধ্যে টিসিবির পণ্য মজুত বাড়ানোর তথ্য গণমাধ্যমে সরব হয়েছে। টিসিবিতেও প্রচুর ঘাটতি। যাদের খুব বেশি দরকার তারাই নাকি সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়। আবার আর্থিকভাবে সম্পন্ন অনেক ক্রেতা সামনে চলে আসে। একটি ধারাবাহিক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতিতে গলদ যেন অভ্যন্তরে জিইয়েই থাকে।

 

এবারো তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে আগত রমজানকে সামনে রেখে কোটি পরিবারে ভর্তুকি মূল্যের খাদ্যের সংস্থান দিতে সরকার প্রস্তুতি শুরু করেছে। সেখানে টিসিবির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। রমজান মানেই বিশেষ কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের শ্যেন দৃষ্টি। চাল, ডাল, তেল, চিনি, তরল ও গুঁড়া দুধ, পেঁয়াজ, রসুন এসবই যেন লাগামছাড়া হয়ে যেতে সময় নেয় না।

 

এসব পণ্যের ঘাটতি সামাল দিতে বিদেশ থেকে আমদানি করারও জোর প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সময়ই বলে দেবে এমন সব পূর্ব প্রস্তুতি কতখানি ভোগ্যপণ্যের লাগাম টেনে ধরবে। কারণ, সদা সক্রিয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অশুভ পাঁয়তারায় শুধু যে মূল্যবৃদ্ধি তা নয়, পরবর্তীতে তা আর কমানোর কোনো সুযোগই থাকে না।

 

অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের এটা নতুন কোনো কারসাজি নয়। অনেক বছর থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এক চক্রব্যুহের কঠিন জালে আটকানো। শুধু খাদ্যপণ্যই নয়, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটও এমন বন্ধন থেকে সহজে মুক্তি পায় না। ফার্মের মুরগি ও ডিমের ওপর অনৈতিকভাবে যে মূল্যবৃদ্ধি চাপানো হয়েছিল তা সাধারণ মানুষেরও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। আবারও মুরগি ও ডিমের চড়া দাম দৃশ্যমান হচ্ছে।

 

বাণিজ্যিকীকরণের ওঁৎ পাতা ফাঁদে যেভাবে অসহায় ভোক্তা শ্রেণি জিম্মি হয়ে থাকে সেটাও সার্বিক পণ্য ব্যবস্থাপনার ওপর চরম ও নেতিবাচক অপঘাত। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে দ্রব্যমূল্যের সংকট খুব বেশি দৃশ্যমান না হলেও ২০২২ সাল যেন খাদ্যপণ্যের চরম দামের এক অসহনীয় ক্রান্তিকাল।

 

২০২২ সাল থেকে সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার যে চরম প্রকোপ সেখান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য সহনীয় মাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে সময় নেয়নি। তেমন ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পণ্যের দাম এখনো মাত্রা ছাড়ানো। সবটাই কি খাদ্যপণ্যের সংকট? নাকি কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি করে ভোক্তাদের নাজেহাল অবস্থায় ফেলে দেয়া। আর ব্যবসায়ী চক্রের পকেট ভারি করা। এর ফলে ক্রেতাসাধারণ যে দুর্বিষহ জালে আটকে পড়ে যায় সেখান থেকে তাদের বের হওয়াও দুঃসাধ্য। সংগত কারণেই ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েছে অতি সাধারণ ভোক্তা শ্রেণির।

 

আর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তাদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লাভের আসক্তিতে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মানুষের পকেট কাটতে পেছন ফিরে তাকায় না। চাল-ডাল-তেল-মাছ-মাংসসহ, শাকসবজিও এখন মূল্যবৃদ্ধির কোপানলে। পবিত্র রমজান মাস এলেই যেন তোড়জোড় পড়ে যায় প্রতিদিনের খাদ্যপণ্যের ওপর নানা মাত্রিক চাপ ফেলতে। সেটা যতটা না কৃষি উৎপাদক শ্রেণির তার চেয়েও বেশি সিন্ডিকেটের লাগামহীন দৌরাত্ম্যে।

 

সমুদ্র পরিবেষ্টিত ও নদীবিধৌত বাংলার মৎস্যসম্পদে চিরকালের এক সমৃদ্ধ অঞ্চল। সেখানেও চলছে এক ধরনের বাণিজ্যিক অপকৌশল। সরকার সব সময় সতর্ক-সাবধানতার অসাধু ব্যবসায়ীদের ওপর কঠোর নজরদারি রাখলেও কোন ফাঁক-ফোকরে তারা পার পেয়ে যায় বলা মুশকিল। এ কথা অনিবার্য ভোগ্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির দুঃসময়ের মূল হোতা কিন্তু অবাধু ব্যবসায়ী চক্র। যারা ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের হিসাব-নিকাশে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় রাখতে একেবারেই অপারগ।

 

আমাদের মিঠে পানির মাছের যে আবেদন তা যেমন সুস্বাদু, একইভাবে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকরও বটে। এমন ঐতিহ্যিক সম্ভারের ওপরও দুষ্টচক্রের শ্যেন দৃষ্টি পড়া দেশের জন্য অমঙ্গল। এখানে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’, ‘নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরকে’ই প্রাসঙ্গিক নজরদারিতে খাদ্যপণ্যের মান ও পুষ্টি সুরক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখা জনস্বার্থে জরুরি।

 

কৃষি উৎপাদন পণ্যের অবারিত সম্ভার থাকা সত্তেও আমাদের দেশে পবিত্র ইবাদতের মাসটি এলেই কেন যে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় তা হিসাবই মেলে না। বিভিন্ন সময় সরকার চাহিদা মোতাবেক নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের ঘাটতি মেটাতে আমদানি করেও সমস্যার সুরাহা করার চেষ্টা করে। যেমন রমজানের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান বিভিন্ন সময় বিদেশ থেকে আমদানিও করা হয়।

 

এবারো রোজার প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে ১ কোটি ১০ লাখ লিটার সয়াবিন তেল কেনার অনুমোদন দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, যা কেনা হবে টিসিবির মাধ্যমে। এতে খরচ নির্ধারণ করা হয় ১৯৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি নতুন কিছু নয়। সেখানে পেঁয়াজের চরম আকালে উৎপাদন বাড়ানোর উপস্থিত কার্যক্রমও চোখে পড়ার মতো। তবে এবার পেঁয়াজের দামের ওপর কোনো চাপ আসেনি। ক্রেতার সক্ষমতা বিবেচনায় দামটা সহনীয়ই বলা যায়।

 

তবে খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে নতুন করে সংকট তৈরিতেও সময় লাগে না। সংগত কারণেই ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানিও সরকারের নজরদারিতে থাকে। বোধ হয় বাজারে সে কারণেই কোনো দরকারি পণ্যের ঘাটতি দৃশ্যমান হয় না। যেমন আগে টাকা বেশি দিলেও ঘাটতি পণ্য পাওয়া মুশকিল হয়ে যেত। তেমন দুঃসংবাদ কখনো উঠে আসে না।

 

তবে খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই সমস্যা মিটবে না, বরং সিন্ডিকেটের কঠোর অপচ্ছায়া থেকে বাজার মুক্ত রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লাগাতার কঠোর নজরদারিতে বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনাকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাসঙ্গিক করা অপরিহার্য। সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগের আবর্তে ফেলে অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফা অর্জনের বাঁকা সিঁড়িকে সোজা পথে টেনে আনতে যা যা প্রয়োজন সবই করা সময়ের অনিবার্য দাবি।

 

লেখক : সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version