-->
শিরোনাম

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শন বৈষম্য নিরসনে করণীয়

মোতাহার হোসেন
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শন বৈষম্য নিরসনে করণীয়

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত আবর্তিত হয়েছে বাংলার সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ,ভৌগলিক ও ভূখন্ডের স্বাধীনতা, বিশ্বে বাঙ্গালীর সম্মান ,মর্যাদা বৃদ্ধি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে তিনি সুদীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করেছেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। বাঙালিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

 

তাই এদেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু হলেন ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি,জাতির পিতা। মূলত: বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ,বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা,বঙ্গবন্ধু মানেই জাতির মুক্তি। বৈষম্য,বিভেদ,ক্ষুধা,দারিদ্রতা.অসাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতা মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। মহান মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান,হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মিলিত রক্তস্রোতে অর্জিত হয় মহাস স্বাধীনতা।

 

পুর্বাপার প্রেক্ষাপট হচ্ছে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাতির সোহরাওয়ার্দী ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে কালজয়ী ভাষণে বঙ্গবন্ধু ডাক দেন স্বাধীনতার, নির্দেশ দেন যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকার, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার। বাস্তবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য মুক্তি সংগ্রামে বাঙ্গালীকে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশে দেন তিনি। তখন থেকেই ঘুরতে থাকে ইতিহাসের চাকা।

 

মূলত: সেই দিন থেকেই বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার,প্রশাসন.ব্যাংক বীমাসহ প্রায় সকল প্রশাসন চলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পাশাপাশি প্রতিটি বীর বাঙ্গালী প্রস্তুতি গ্রহণ করে হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার। অন্যদিকে ৭ মার্চেও পর থেকে দৃশ্যমান হতে থাকে পাক শাসকদের ষড়যন্ত্র।

 

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনতে থাকে অস্ত্র-গোলাবারুদ। বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে বাংলার ভূখন্ড দখলে রেখে ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার লক্ষ্যে প্রণয়ন করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বর গণহত্যা চালানোর পরিকল্পনা।

 

ঢাকাসহ দেশের অপরাপর বিভাগীয় শহরে থাকার শুরু হয় গণহত্যার বীভৎসতা। বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ হত্যার এ পরিকল্পনার মূল হোতা এবং বাস্তবায়নকারীদের অন্যতম ব্যক্তি সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ থেকে কিছু তথ্য জানা যায়।

 

তার তথ্য অনুযায়ী, পরিকল্পনায় অনেক বিষয়ের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল বাঙালি সৈন্য আর পুলিশকে নিরস্ত্র করাসহ পিলখানা, রাজারবাগ আর চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার থেকে সব রাইফেল দখলে নিয়ে নেওয়া; অপারেশনের শুরুতে সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো অবরুদ্ধ করে রাখা; শেখ মুজিবকে জীবিত ধরা এবং ১৫ জন চিহ্নিত বাঙালি নেতাকে গ্রেপ্তার করা।

 

তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ দুপুরে হাইকমান্ড থেকে সেদিনই রাতের বেলায় তাকে অপারেশন শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক সামরিক অভিযান শুরু করা হয় ২৫ মার্চ মধ্য রাতে, চলতে থাকে নির্মম হত্যাকান্ড রাজধানীসহ সারা বাংলা জুড়ে।

 

এ রাতটি ছিল বাঙালি জাতির জীবনে এক মর্মান্তিক কালরাত। অবশ্য অনেক রক্ত দিয়ে রক্তের ইতিহাস সৃষ্টি করে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণ বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত নয় মাসের প্রতিটি রাতই ছিল বাঙ্গালীর জীবনে কালরাত। প্রতি রাতেই হানাদার আর তাদের বর্বর দোসরদের হামলা চলত গ্রামে-শহরে বাড়িতে বাড়িতে।

 

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরো জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম এক লড়াইয়ে যা রূপ নেয় জনযুদ্ধে। জাতির অস্তিত্ব রক্ষা আর বাঁচামরার লড়াইয়ে যোগ দেয় নারী-পুরুষ কিশোর-যুবা নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ। বাঙালি এমন ভয়ংকর রূপ আগে দেখেনি কখনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর সামরিক শাসকরা।

 

ভীত-সন্ত্রস্ত হানাদাররা মুক্তিযুদ্ধকালের নয় মাসে পুরো বাংলার মাটিকে লাশের মর্গ বানানোর লক্ষ্যে শুরু করে ধ্বংসযজ্ঞ। নিশ্চিত পরাজয় জেনে মরণ কামড় বসিয়ে দেয় দেশের আলোকিত সূর্যসন্তান আর কবি-লেখক-সাংবাদিক-সাহিত্যিকসহ সৃজনশীল বাঙালির ওপর। মননশীল মেধা ধ্বংস করে পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিতে চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে, যাতে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলেও বাঙালিরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

 

এ ছাড়াও, পাকিস্তানি শাসকরা বহু অপরাধের মধ্যে যে গুরুতর অপরাধ করেছে তা অমার্জনীয় এরা হলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের লেজুড়বৃত্তি করা ঘৃণিত দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসের লোকজন, যারা অজানা সংখ্যায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা দেশে, কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও ছদ্মবেশে বিষ-নিঃশ্বাস ছাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে।

 

বঙ্গবন্ধু নিজ পরিবার-পরিজন থেকেও এদেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসতেন। তাই তিনি সবাইকে সংগঠিত করে সুদীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এনে দিয়েছেন লাল-সবুজ পতাকার বাংলাদেশ। ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

ভাষণটিকে ইউনেস্কো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে, সেগুলোকে সংরক্ষণ করা এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করে ইউনেস্কো। বাঙালি হিসাবে ৭ মার্চের ভাষণের এই স্বীকৃতি আমাদের জন্য গর্বের।

 

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকান্ডই ছিল না, এটা ছিল বিশ্বসভ্যতার জন্য এক কলংকজনক অধ্যায়ের সূচনা।

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সারাজীবন রাজনীতি করেছেন। দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন। মার্চ মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গৌরবের মাস। এ মাসেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু। আর এ মাসেই সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তি যুদ্ধের। আজ বঙ্গবন্ধু নেই।

 

তিনি জাতির জন্য রেখে গেছেন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তারই যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক শতাব্দীর পর শতাব্দী।

 

৭১-এর স্বাধীনতার পরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়টাতে এটাই ছিল সত্য। সেই সময়টাতে কেউ ঘাড় ফিরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনটাকে যাচাই করতে যায়নি। সুফিসাধকদের উত্থান, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামীদের বিদ্রোহ এবং বাউল জাগরণের পর থেকে সংস্কৃতির পথ ধরে ভাষাভিত্তিক সত্তা নির্মাণ যে সর্বজনীনতার আবহ সৃষ্টি করে, তার মাঝে ছাপার অক্ষরে লেখা যায় এমন কোনো দর্শন খুঁজে না পাওয়া গেলেও সাধারণের যাপিত জীবনে অলক্ষ্য, অনুচ্চারিত একটি দর্শনের ছোঁয়া ছিল।

 

ওই দর্শনই মানুষের অন্তরে নির্মাণ করেছিল সহমর্মিতা ও মর্যাদাবোধ। তাই তা মানুষের ক্রোধ ও ভেদজ্ঞান কমিয়ে মানুষকে করে তোলে সহনশীল। যে সাম্প্রদায়িক চিন্তার ওপর ভিত্তি করে ভারত বিভাগ বাস্তবায়িত হয়, তা নিতান্তই হয়ে ওঠে অতীত বর্জ্য বিষয়। এ কারণেই ৭১-এ জাতিধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সবাই আপন মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের একটি চূড়ান্ত সংগ্রাম, তথা মুক্তির যুদ্ধে শরিক হয়।

 

এ যুদ্ধের মাঝেই এদেশের মানুষ আরও পরিশীলিত হয়ে অধিকতর মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। এ কারণেই চুকনগরের মো. এরশাদ আলী মোড়ল হিন্দু ঘরের শিশুকে নিঃসংকোচে আপন করে নেয় এবং হিন্দু পরিচয়ে প্রতিপালন করে। এ কারণেই যশোরের কাঠি হুজুর মাদ্রাসার সংকীর্ণ চিন্তা অতিক্রম করে মন্দকে মন্দ বলে চিনিয়ে দেয় এবং ধ্বংসের মাঝে সুন্দর পৃথিবী খোঁজার চেষ্টা করে।

 

প্রসঙ্গত: যে কোনো দেশের জনতার যুদ্ধ জীবনের অধিকার আদায়ের চূড়ান্ত রূপ। যুদ্ধের পেছনে রাজনীতির নানা ছায়া থাকলেও কৃষকের আকাঙ্ক্ষা ও সাধারণের আকাঙ্ক্ষার কাছে তা পশ্চাৎপদ হয়ে ওঠে। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে যথেষ্ট। উল্লেখযোগ্যভাবে দরিদ্রতা হ্রাসে অগ্রগতি হয়েছে। তবে জেলাভিত্তিক বৈষম্যও বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ে আছে অসমতা।

 

তথ্যমতে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কোটিপতির সংখ্যা ছিল চারজন, এখন সে সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। তাদের অনেকেই বেগমপাড়ায় বাড়ি বানান, করোনায় দুর্নীতির আশ্রয়ে টাকা লোপাট করেন, তেলের দাম বাড়িয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেন। দেশের টাকা পাচার করতে কুণ্ঠা নেই অনেকের। দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। সিন্ডিকেটের থাবায় দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের।

 

এসব অপকর্মই বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্তরায়,ানু্েযষর ভাগ্য উন্নয়নের অন্তরায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়ী চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। স্বাধীনতার একান্ন বছরেও ধর্মীয় সহনশীলতার অভাব দেখা যায়, সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা তুলতে চায়, জঙ্গিরা নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠতে চায়। গণতন্ত্রের শোভিত পথ চলার ক্ষেত্রে মতান্তর এখনো ভাবায়। সুবর্ণজয়ন্তীর পথ ধরে অগ্রযাত্রায় দরকার সব আঞ্চলিক বৈষম্য, বিভেদ ও শোষণের অবসান।

 

সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি অপশক্তি যেন অগ্রগতির পথে বাধা না হয় সে জন্য সজাগ দৃষ্টি বিশেষ প্রয়োজন। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনে বদ্ধ পরিকর। তাই সব বৈষম্য দূর, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ উন্নয়নে তাদের ভূমিকা ব্যাপক। আঞ্চলিক সব বৈষম্য অবসান ঘটিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের ইতিবাচক ভ‚মিকা প্রত্যাশা শেখ হাসিনার সরকারের কাছে।

 

মোতাহার হোসেন : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version