নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করছে রোজা শুরু হওয়ার আগেই। রোজার মাঝেও বেড়েই চলেছে পণ্যের দাম। সরকারের প্রশাসন, ভোক্তা অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, খাদ্য দপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিএসটিআই, কাস্টমস, স্বাস্থ্য দপ্তরের স্যানেটারি ইন্সপেক্টরসহ অনেক সরকারি বিভাগ গলদঘর্ম পরিশ্রম করছে মাঠপর্যায়ে, তবে তারা পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে পারছে না।
আজ থেকে ৩০ বছর আগে এত সরকারি দপ্তর পণ্যমূল্য ও নিরাপদ ভেজালমুক্ত খাদ্য নিয়ে কাজ করেনি। সরকার নিরাপদ খাদ্য ও বাজার মূল্য যথাযথ রাখতে দপ্তর বাড়িয়েছে, কিন্তু পণ্যের মূল্য এবং গুণগতমান ও খাবারে বিশুদ্ধতা আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। তাহলে এত দপ্তর বাড়িয়ে কী লাভ হলো। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় হয়েছে তা সরকারি দপ্তর দিয়ে কি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। দেশে নৈতিক মূল্যবোধের ঘটেছে মারাত্মক অবক্ষয়।
ধর্মের নামে যে নৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে তা শুধু ধর্মান্ধতাই শেখায়। জাতির সামষ্টিক মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে নৈতিকতার উন্মেষ ঘটায় না। রোজা বা অন্য কোনো বিশেষ পার্বণ উপলক্ষে যখন পণ্যের চাহিদা বাড়ে তখন একদল স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কৌশলে মুনাফা লুটে নেয়। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মপালকারী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ।
রোজা আসলে মানুষের বিশেষ করে খাদ্যপণ্যগুলোর চাহিদা বেড়ে যায় অন্য সময়ের বেশি। অসমর্থিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রোজার সময় খাবার তৈরির বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় সাধারণ সময়ের চেয়ে তিন চার গুণ বেশি। যদিও রোজার মাসকে বলা হয়ে থাকে সংযমের মাস। তবে বাস্তবে খাদ্যপণ্য কেনার বিষয়ে রোজার সময় ক্রেতাও হয়ে যান অসংযমী। আহারের জন্য ও রসনাতৃপ্তির জন্য বেশি করে কিনে খাদ্যপণ্যগুলো, অন্য মাসে তাদের এত বেশি পরিমাণে লাগত না যে পরিমাণ রোজার মাসে প্রয়োজন হয়।
যেমন, বাজারে সাধারণ সময়ে যত পরিমাণ জিলাপির চাহিদা ছিল, রোজা আসলে সেই জিলাপির চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রোজায় মসুর ডালের বাড়ে বহুবিধ ব্যবহার, যেমন পেঁয়াজু তৈরিসহ বিভিন্ন বড়া জাতীয় ও নানা পদের খাবার তৈরিতে মসুরের ডালের ব্যবহার হয়। বেগুনের ব্যবহার বাড়ে বেগুনি, তরকারিতে। ঠিক এমন করেই প্রতিটি খাদ্যপণ্যের ব্যবহার বাড়ে। ফলে এগুলোর বাজার চাহিদা বেড়ে যায়।
বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে হলে চাহিদার সঙ্গে জোগানের সামঞ্জস্যতা রাখতে হবে। রোজা আসলে হঠাৎ করেই বা অপরিকল্পিতভাবে বা অনুমেয়তার পরিমাপ না করেই চাহিদা বাড়ে। এই চাহিদা জোগানটা কত পূরণ করতে পারে বিদ্যমান বাজারের জোগান চ্যানেল- তা কিন্তু দেখার বিষয়। চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে জোগান না বাড়লেই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।
বাজারে পণ্য কমলে আর ভোক্তার সংখ্যা বাড়লে, পণ্য বিক্রয় পদ্ধতি অনেকটা নিলাম প্রথার মতো হয়ে ওঠে। যেমন, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি পণ্য কেনার জন্য পাঁচজন ভোক্তা উপস্থিত। পণ্যটা সবারই দরকার। একটু দাম বেশি হলেও তারা এটা কিনবে, তখন চলে প্রতিযোগিতা আর বিক্রেতা কৌশলে পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দেন, আর পাঁচজন ক্রেতা কে কার চেয়ে আগে পণ্যটি পাবে সেই মনোভাব থেকে মূল্যটা বেশি দিয়ে দেয়।প্রায়ই বলতে শোনা যায়, রোজার মাসে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে বেশি মুনাফা করে। এ ধরনের মুনাফা করাটা ঠিক না। যখন একজন ক্রেতা নিজেই অসংযমী হয়ে ওঠে পণ্যটি পাওয়ার আশায়, আর ক্রেতা নিজেই বেশি দাম হলেও পণ্য কিনে নেয় তখন দোষটা কার। ক্রেতার অসংযমী মনোভাবটাও পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়ার একটি কারণ। এই অসংযমী হওয়ার মনোভাবটা আমলে নিয়ে পণ্যমূল্য বাড়ার বিষয়টা দেখা উচিত।
এ দেশে সবার আয় সমান না। যাদের আয় বেশি তারা পণ্যের মূল্যটা বিবেচনায় নেয় না। তারা অধিক মূল্য হলেও চাহিদার পণ্যটি কেনে। কারণ ক্রেতার কেনার প্রবণতার গতি নিরীক্ষণ করেই বিক্রেতা দাম বাড়ায়। রোজার মধ্যে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবজির চাহিদা সাধারণ সময়ের চেয়ে বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এই পণ্যগুলোর উৎপাদন কি রোজার মাসে বেড়ে যায়, যদি না বাড়ে তাহলে চাহিদার বিপরীতে জোগান কমাটা স্বাভাবিক। জোগান কম, কেনার প্রতিযোগিতা বেশি এই ধরনের পরিবেশের সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়। তাই দেখা যায়, সাপ্লাই চেইনটা মাঝে মাঝে চাহিদার প্রবল তোড়ে ভেঙে পড়ে আর বাজারে সৃষ্টি হয় ভ্যাকুয়াম, তখনই পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়।
গ্রামের কৃষকরা কৃষির খাদ্যপণ্য উৎপাদন করে যেমন- ছোলা, ডাল, মটরদানা এ রকম। এই কৃষকরাও বাড়িতে এই পণ্যগুলো মজুত করে রাখে রোজার মাসে বিক্রি করার জন্য। রোজা শুরু আগে বা রোজার মধ্যে কৃষকরা গ্রামের হাটে পণ্যগুলো বিক্রি করে দেয়। প্রশ্ন হতে পারে তাহলে তো পণ্যটির দাম কমার কথা। কিন্তু কমে না কেন? না কমার কারণ হলো- উৎপাদনের সময় থেকে পণ্য সংরক্ষণের ব্যয় ও সময় এর বিষয়টি আমলে নিলে দেখা যাবে পণ্যটির দাম অটোমেটিকলি বাড়ারই কথা।
সরকারের বিভিন্ন দপ্তর খুচরা বাজারে গিয়ে পাইকারিভাবে কেনা মূল্যের ভাউচার চেক করছেন। এই বিষয়টি কি সঠিক সমাধানের পথ হলো? কারণ পাইকারি বাজার ভাউচার তৈরি করার সময় খুচরা ব্যবসায়ীর দিকটাই দেখবে। পাইকারি বিক্রেতা নানা কৌশলে ভাউচারের দাম লিখতে পারেন। ভোক্তা অধিকার দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা নিজেরাও কিন্তু বিষয়টি বোঝেন। কারণ সরকারি দপ্তরের অনেক কর্তাব্যক্তি অফিসসামগ্রী কেনার সময় ভাউচারে বেশি দাম লিখিয়ে নিয়ে যান। আর বেশি দাম লিখা ভাউচার দিয়ে সরকারি কোষাগার থেকে বিল নেন। আবার এটাও দেখা যায়, পরিমাণে অফিস সরঞ্জাম লেগেছে তার পরিমাণটা বেশি লেখেও দোকানির কাছ থেকে ভাউচার নেন। এ রকম ফাঁকফোকরের কথা সবারই জানা।
মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় হয়েছে তা সরকারি দপ্তর দিয়ে কি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, ভোক্তা অধিকার দপ্তর জোরেসোরে মাঠে নেমেছে পণ্যের মূল্য সঠিক রাখতে বা দাম কমাতে। কিন্তু তারা কতটা পারছেন? ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে প্রশ্ন- এখানে কি পাইকারি বাজার থেকে কেনা ভাউচার দেখার প্রয়োজন আদৌ আছে বা তা দেখে কি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা। সরকারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মনিটরিং এ বাজারের দাম কমার চেয়ে বেড়েই চলেছে। বিষয়টা এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহিতার গল্পের মতো।
এক গ্রামের দরিদ্র নারী একটি এনজিও থেকে ঋণ নেন সাপ্তাহিক কিস্তিতে, তিন সপ্তাহ তিনি কিস্তি দিতে পারেননি। মাঠকর্মী এসে তাকে শাসিয়ে বলে আজ কিস্তি না দিলে বড় স্যার আসবেন। দরিদ্র নারীটি কাঁপতে কাঁপতে বলেন ঘরে টাকা নাই- বড় স্যার কেন দারোগা আসলেও কোনো লাভ হবে না।
সুতরাং রোজায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অবশ্যই জোগানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহনে জায়গায় জায়গায় পুলিশের চাঁদা নেয়ার প্রবণতা রোধ করতে হবে। শুধু প্রান্তিক খুচরা বিক্রেতার ওপর ছড়ি ঘুরালেও কোনো লাভ হবে না। তাই জোগানের চ্যানেলটা আগে নিশ্চিত করুন। উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে পণ্যের দাম আর বাড়বে না বলে আশা করা যায়।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য