-->

তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুই

মোস্তাফা জব্বার
তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুই

২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিষয়ে অনলাইনে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। আমি অনলাইনে যুক্ত থেকে সেই আলোচনা সভায় যে বক্তব্য পেশ করি তার সম্পাদিত রূপ পাঠকের জন্য উপস্থাপন করছি।

 

‘আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন সিদ্দিক সাহেব এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. মঞ্জুর আহমেদ সাহেবকে। একটু আগে আমাদের মূল বক্তা প্রফেসর সাজ্জাদ হোসেন সাহেবের বক্তব্য শুনলাম। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কথাগুলো আমার কাছে অত্যন্ত ভালো লেগেছে।

 

তবে আমার কাছে যেটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে- তাদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তাভাবনা আমাদের বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেছে। যেহেতু আলোচনাটি বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক, সে কারণে প্রথমেই আমি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের শহীদ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদ, জাতীয় চার নেতা এবং বিশেষ করে আমাদের ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আমরা কয়েকজন বয়স্ক মানুষ ছাড়া বাকি যারা অংশগ্রহণ করেছে তারা সবাই নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে।

 

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাংলাদেশ গড়ে তোলার পেছনে বরাবরই নতুন প্রজন্মের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি যখন বাংলাদেশ ধারণা নিয়ে কাজ করেন তখন কিন্তু তিনি নতুন প্রজন্মের মানুষই ছিলেন।

 

আমাদের দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদরা এবং যারা মহীরুহ ছিলেন তারা যখন বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের কথা চিন্তাও করতে পারেন নাই তখন জাতির পিতা এই দেশটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করেছেন। নতুন প্রজন্ম বরাবরই সামনে তাকাতে পারে।

 

এখন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রচুর পরিমাণ তথ্য পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুসংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজ এখন ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা অনেক বই এখন পাওয়া যায়। আমি অনুরোধ করব আজকে যারা এই অনুষ্ঠানে শরিক আছেন, বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণদের বঙ্গবন্ধুর জীবনী পূর্ণাঙ্গভাবে পাঠ করবে, সেটা উপলব্ধি করবে ও তার সম্পর্কে প্রাপ্ত সবাই তথ্য অনুভব করার চেষ্টা করবে।

 

জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ অথবা ‘এইম ইন লাইফ’ বা ‘আমার আদর্শ মানুষ’ এইরকম একটা রচনা তো নিশ্চয়ই সবাই লিখেছি এবং সেখানে আমাদের অনেক সময়ই এই কথাগুলো স্পষ্ট করে বলতে হয়েছে যে, আমার জীবনের আদর্শ মানুষকে অথবা আমি কাকে অনুসরণ করি বা আমি কী হতে চাই।

 

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বহুজনের নাম বহুভাবে লিখতে হয়েছে কিন্তু তোমাদের জন্য যেটি আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি সেটি হচ্ছে যদি বঙ্গবন্ধুর জীবনটাকে অনুশীলন করা যায় এবং তার নীতি ও আদর্শকে যদি আমরা অনুসরণ করতে পারি, নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারি, এমনকি ব্যক্তি জীবনে যদি প্রয়োগ করতে পারি তাহলে সবচেয়ে বেশি নিজেকেই উপকৃত করব।

 

কারণ আমি পৃথিবীর প্রায় চেনাজানা এ রকম কোনো লোক নাই যার জীবন নিয়ে চর্চা করি নাই, যার সম্পর্কে জানি নাই, সেটা সে প্রযুক্তিবিদ হোক, রাজনীতিবিদ হোক, অথবা শিল্পী-সাহিত্যিকই হোক। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর যে বহুমাত্রিক জীবন- এই বহুমাত্রিক জীবনের সঙ্গে তুলনীয় আরেকটি মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়েছে।

 

আমি তোমাদের জানাতে চাই- বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, বঙ্গবন্ধু আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের ক্ষেত্রে অথবা আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বীজটি নিজেই বপন করেছেন। আমি বরং খুশি হয়েছি আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরাই সেই সমস্ত তথ্য আমাদের দিতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু কিভাবে বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ স্থাপন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু আটিইউ ও ইউপিইউ এর সদস্যপদ নিয়েছিলেন- এগুলো আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কাছে পৌঁছেছে; যা আমার কাছে অতি আনন্দের বিষয়।

 

আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর বহু অধ্যায় আছে, যে অধ্যায়গুলোকে তোমরা তার বহুমাত্রিক জীবনের রূপরেখাটি আত্মস্থ করতে পারো এবং নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারো। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন থেকে আরম্ভ করে সামাজিক দায়-দায়িত্ব সবকিছু তোমাদের আদর্শ। আমরা সবাই রাজনীতিবিদ হব এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু রাজনীতি সচেতন হব না এটা হতে পারে না।

 

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সচেতনতার বিষয়গুলো যদি আমরা নিজেরা প্রয়োগ করতে পারি তাহলে কিন্তু আমাদের জীবনের বহু সংকটকে অতিক্রম করতে পারব, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারব এবং সেই জায়গাটায় আমরা যেতে পারব।

 

আমার যেহেতু বঙ্গবন্ধু এবং তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কথা বলার কথা তাই আমি একটু বাংলাদেশের গড়ার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দিতে চাই। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন এই দেশটা একটা সম্পূর্ণরূপেই কৃষিভিত্তিক দেশ ছিল। আমি জানি না তোমাদের মধ্য থেকে কেউ হয়তো আছো, যারা চাকরিজীবীর সন্তান অথবা ব্যবসায়ীর সন্তান।

 

কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী- যাদের আমরা খোঁজ করি, অন্তত পুরো প্রজন্মটাকেই আমরা বলতে পারি চাষাভুষোর সন্তান বা কৃষকের সন্তান। আমরা মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। কারণ তোমরা হয়তো অবাক হবে যে, ১৯৭২ সালে আমাদের শিক্ষার হার শতকরা মাত্র ২৩ ভাগ ছিল। এখন সেই সংখ্যা ৭০ এর উপরে উঠেছে। শিক্ষার হার ২৩ ভাগ থাকার পেছনে মূল কারণও একটাই ছিল।

 

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল না। বিশেষ করে আমরা একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে কোনো না কোনোভাবে সঠিক ও বেঠিক সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা ছিল না। আমার কাছে মনে হয়েছে, তখন এক ধরনের তথ্যের অভাব ছিল। সেজন্য বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল না। ফলে তারা লেখাপড়ার দিকে খুব একটা মনোযোগ দিত না।

 

আমরা সবাই রাজনীতিবিদ হব এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু রাজনীতি সচেতন হব না এটা হতে পারে না।

 

আমার মনে আছে- আমি যখন হাইস্কুলে পড়তাম, তখন আমাদের মুসলিম হোস্টেলে আমরা ছিলাম মাত্র ৪০ জন। আর হিন্দু হোস্টেলে ছিল ১৮০ জন। এই অনুপাতের তুলনায় বর্তমান বাংলাদেশের যে রূপান্তর, সেটি কিন্তু গত ৫০ বছরের রূপান্তরের ফল। এই রূপান্তরের ফলে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করেছি সেটি অবশ্যই আমাদের শিক্ষার হার বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

আমাদের নতুন প্রজন্ম এই শিক্ষার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অবদান রাখছে। তোমাদের জানা দরকার, এই বাংলাদেশে আমরা যদি তথ্যপ্রযুক্তি অথবা ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলি তার তো নিশ্চয়ই একটা অতীত রয়েছে। এই অতীতটা এখানে তোমাদের যে দুজন বক্তব্য দিয়েছে তারা বলেছে। তোমরা শুনেছ যে, বঙ্গবন্ধু আইটিইউর সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন এবং বেতবুনিয়ায় ভ‚-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। আমি আরও দু-একটা বিষয়কে যুক্ত করে দেই।

 

বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার ফলে বাংলাদেশের টেলিকমিউনিকেশনকে পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু টিঅ্যান্ডটি বোর্ড গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশ যে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে সেই কাজটি কিন্তু বঙ্গবন্ধু কর্তৃক এই টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের দ্বারাই হয়েছে। এই টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের জন্য সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের মানুষ কথা বলতে পেরেছে। সেজন্যই বেতবুনিয়াতে ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।

 

আজকে তোমরা হয়তো চিঠিপত্র লিখো না। ডাকঘরের সেই চাহিদাটা এখন হয়তো নেই। কিন্তু প্রয়োজনটা যে ছিল এবং সেই প্রয়োজনটা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। আমরা নতুন রূপে ডাকঘরকে ঢেলে সাজাচ্ছি। সেখানে ডাকঘর তোমার দৈনন্দিন জীবনের একটা অংশ হয়েই কাজ করবে। বঙ্গবন্ধু ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করার ফলে আমাদের ডাকঘর যে সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করতে পেরেছিল এটাও একটা অসাধারণ বিষয় ছিল।

 

এক্ষেত্রে আমি বঙ্গবন্ধুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলব যা ছিল যুগান্তকারী। যেটি উল্লেখ করেছেন সাজ্জাদ সাহেব। যে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন তিনি করেছিলেন তার রিপোর্টটা যদি তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারতেন তাহলে কিন্তু শিক্ষার আজকে যে অগ্রগতি এটা সম্ভবত আমরা ৮০’র দশকেই পেয়ে যেতে পারতাম।

 

কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে এবং কেন হত্যা করা হয়েছে সেই কারণটাও আমি ব্যাখ্যা করব।

 

বঙ্গবন্ধু আমাদের শিক্ষার দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কিন্তু ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন এবং এটা দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, ‘শিক্ষা জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়’।

 

শিক্ষাকে যদি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থাপন করা না যায় তাহলে জাতির অগ্রগতি হবে না। যখন আমাদের খাবার জোগাড় করা কঠিন ছিল, যখন সত্যিকারভাবে তলাহীন ঝুড়ি হিসেবে চিহ্নিত ছিলাম তখনকার দিনে জাতীয় দায়িত্ব নেয়া, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেয়া একটা অসাধারণ কাজ ছিল।

 

একই সঙ্গে তিনি যে যুগান্তকারী কাজটা করে দিয়েছেন সেটি হচ্ছে- বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার যে গুরুত্ব সেটিকে তিনিই সবার আগে তুলে ধরেছিলেন। এই গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে আজকে আমাদের সব দিক থেকে বলতে হচ্ছে যে, প্রচলিত শিক্ষাধারার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহের ধারাটি হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। এটি রূপান্তরের জন্য মানব সভ্যতার রূপান্তরটা আমাদের জানা দরকার।

 

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version