-->

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা

এ কে এম এ হামিদ
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা

দেশের জনগণ অত্যন্ত আগ্রহভরে লক্ষ্য করছে যে, বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ ধনী দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে সরকার ভিশন ২০৪১ ঘোষণা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিভঙ্গিতে কৌশলগত নির্দেশনা (Strategic direction) প্রদান করেছে। যার ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে আরেকধাপ এগিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে ভিশনারি নেতা শেখ হাসিনার সাহসী ঘোষণা প্রদান ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞগণ কাজ করছে।

 

স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ৪টি পিলার তথা স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট গভর্ন্যান্স। এই ৪টি পিলার বা ভিত বাস্তবায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রের সূচনালগ্নে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি চৌকস জনবল কাঠামো। তাই দেশের উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে অবশ্যই শিক্ষা ক্ষেত্রে আগামীর বিশ্ব কর্মব্যবস্থার উপযোগী ফিউচার রেডি ওয়ার্কফোর্স তৈরিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

 

তৎপ্রেক্ষিতে উন্নত বিশ্বের সমৃদ্ধ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিশ্ব নেতাদের শিক্ষাদর্শন পর্যালোচনা করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষা ক্ষেত্রে আশু পরিবর্তনের বিষয়সমূহ চিহ্নিত করে এগিয়ে যাওয়া ব্যতিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কোনো বিকল্প নেই।

 

শিক্ষা বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল বলেছেন, ‘শিক্ষিতরা অশিক্ষিতদের থেকে ততটা আলাদা, যতটা জীবিতরা মৃত্যুদের থেকে আলাদা’। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, যা আপনি বিশ্বকে পরিবর্তনে ব্যবহার করতে পারেন’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কনফুসিয়াস বলেছেন, ‘শিক্ষা আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। আত্মবিশ্বাস আশার জন্ম দেয়। আশা শান্তির জন্ম দেয়।’ শিক্ষা বা জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে বেঞ্জামিন ফ্রান্সলিন বলেছেন, ‘জ্ঞানে বিনিয়োগই সর্বোত্তম, যা সর্বোচ্চ সুদ প্রদান করে।’

 

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে নীতিনির্ধারণী নির্দেশনায় বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশের আজ্ঞাবহ কেরানি তৈরি নয়, আমি চাই আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষাব্যবস্থা।’

 

এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত শিক্ষাদর্শন তার আজীবনের রাজনৈতিক সাধনারই বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর ৫৪ বছরের জীবনের ১৩ বছর জেলখানার বন্দিজীবনের সাধনা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দেখে অর্জিত থেসিট নলেজ তাকে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।

 

উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু চীন সফরে গিয়ে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘একটি বিষয় দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এক এক দেশে এক এক ধরনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণি (প্রিভিলেজড ক্লাস) আছে, যেমন আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’ অন্য দেশে শিল্পপতিরা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’, কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’।

 

এই প্রিভিলেজড ক্লাসটা সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। নয়াচীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে। একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা নাই তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য করবে। নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়াচীন।

 

১৫-২০ বছর পরে এরা যখন লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?’। বঙ্গবন্ধুর অনুধাবন ও পর্যবেক্ষণ যে কত সঠিক ও যথার্থ ছিল, তা আজকের চীনের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি।

 

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘নতুন মানুষের একটি জাত গড়ে তুলছে চীন’। তিনিও স্বাধীন বাংলাদেশে একটি নতুন জাতি গঠনের যথার্থ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সারা বিশ্বের নেতাদের শিক্ষাদর্শন পর্যালোচনা করে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর মতো স্বল্প বাক্যে যথার্থ অর্থপূর্ণ শিক্ষাদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়নি। যা আজও ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও যথার্থ।

 

দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ওই শিক্ষাদর্শন বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। যেমনিভাবে ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিলেও বিগত ১৩ বছরে অগ্রগতি তেমন দৃশ্যমান নয়। একইভাবে আইডিইবির সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নে নির্দেশ দিয়ে ২০১৮ সালে আবারো তাগাদা প্রদান করেন। অতঃপর গত ১২ মার্চ-২৩ BNQF আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এখন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষার পালা কত মাস/বছর লাগবে?

 

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাবিষয়ক কৌশলগত নির্দেশিকা ((Strategic Direction) এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতি অনুমোদন ও বাস্তবায়নের কৌশলগত নির্দেশনাকে যদি যথার্থ মূল্যায়নপূর্বক জনশক্তি পরিকল্পনার সাপ্লাই ও ডিমান্ড এনালাইসিস, সরবরাহ ও চাহিদার ব্যবধান বিশ্লেষণ, বাস্তবায়ন অগ্রগতি ইত্যাদি বিষয় পদ্ধতিগতভাবে বাস্তবায়নে গভর্ন্যান্সের ত্রিমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে দেশের সেবা ও উৎপাদন ক্ষেত্রে গতি ত্বরান্বিত হতো।

 

শিক্ষা শব্দটি বহুমাত্রিক। তবে সাধারণভাবে শিক্ষা হলো অজানা থেকে জানার দিকে যাওয়া। শিক্ষা হলো ব্যক্তির সুপ্ত সামর্থ্য এবং সক্ষমতা বিকাশের প্রক্রিয়া, সৃজনশীলতা বিকাশের উপায় বা পদ্ধতি। শিক্ষা হলো জ্ঞানের বিষয়। শিক্ষাকে শালীন বা উত্তম বা শোভন মানুষ তৈরির সূতিকাগার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

 

যদিও আমাদের দেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও দর্শন থেকে বিরত হয়ে, শিক্ষাকে চাকরির সমার্থক হিসেবে পরিচিত করা হয়েছে। তাই অনেক শিক্ষাবিদগণ বলেন, শিক্ষা নিয়ে প্রচলিত ধারণায় যথেষ্ট মাত্রার ভ্রান্তি রয়েছে। তাদের মতে শিক্ষা হলো বস্তুনিষ্ঠ নির্মোহ জ্ঞান অর্জনের অন্যতম পথ, পদ্ধতি, পন্থা, মাধ্যম। শিক্ষা হলো মানবপ্রজাতির প্রকাশ বাহন।

 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘জ্ঞানের প্রয়োগে মানবতার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ, ব্যক্তির আত্মিক গভীরতার বিকাশ, ব্যক্তি ও সমাজের মেলবন্ধন সৃষ্টি, মানুষ ও প্রকৃতির যোগসূত্র স্থাপন, স্বাক্ষর ও নিরক্ষরের মাঝে অসমতা হ্রাস, ফলপ্রদতার সঙ্গে ব্যক্তির জ্ঞানভিত্তিক কল্পনা শক্তি সামঞ্জস্যকরণের মাধ্যমে অন্তরাত্মার পূর্ণতা সাধন, জ্ঞানভিত্তিক কল্পনাশক্তির বিকাশ, প্রসারণ, কর্ষণ এবং সৌন্দর্যবোধ চেতনা সৃষ্টি, সমৃদ্ধি জীবনে পূর্ণতাপ্রাপ্তিই হলো শিক্ষা।’

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শিক্ষাকে ব্যক্তি ও সমাজ পরিবর্তনের মূলশক্তি হিসেবে বিশ্বাস করতেন এবং পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেছেন।

 

প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে কি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব? নিশ্চয়ই না, তবে শুধু গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথ আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষাকে মূল স্রোত  ধারায় নিয়ে এসে দেশের ন্যূনতম ৫০% ছাত্রছাত্রীকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় এনরোলমেন্ট করতে হবে।

 

দেশের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে বিশ্ব কর্মব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রয়োজন কম্পিটেটিভ কম্পিটেন্ড ও আউটকাম বেইজড শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু’র কাক্সিক্ষত আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তির শিক্ষাব্যবস্থাই হবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার।

 

সেই কাক্সিক্ষত স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা থেকে তৈরি ৪র্থ শিল্পবিপ্লব ও একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও অভিযোজনে সক্ষম দক্ষ জনবল যারা গড়ে তুলবে স্মার্ট বাংলাদেশের ৪টি পিলার বা ভিত। তাই, স্পষ্টভাবে বলা যায় নির্ধারিত ৪টি পিলারের সর্বাগ্রে বা প্রথমে স্থান দিতে হবে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা।

 

স্মার্ট শিক্ষা হলো একটি শিক্ষামূলক পদ্ধতি যা শেখার ফল উন্নত করতে এবং শিক্ষাকে আরো আকর্ষক এবং অ্যাক্সেসযোগ্য করে তুলতে ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী শিক্ষা পদ্ধতির ব্যবহার করা। শিক্ষণ ও স্মার্ট শিক্ষায় সাধারণত ট্যাবলেট, ল্যাপটপ এবং ইন্টারেক্টিভ হোয়াইট বোর্ডের মতো ডিভাইসের পাশাপাশি শিক্ষামূলক সফটওয়্যার, মাল্টিমিডিয়া সামগ্রী এবং অনলাইন সংস্থানগুলোর ব্যবহার জড়িত থাকে। স্মার্ট শিক্ষার লক্ষ্য হলো আরো বেশি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শেখার অভিজ্ঞতা তৈরি করা এবং প্রত্যেক পৃথক শিক্ষার্থীর শেখার চাহিদা এবং আগ্রহ পূরণ করে। শিক্ষকদের তাদের শিক্ষার্থীদের শেখার শৈলী এবং দক্ষতার সঙ্গে তাদের শিক্ষার পদ্ধতিগুলোকে উপযোগী করতে এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করা। স্মার্ট শিক্ষার মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে

 

 ইন্টারেক্টিভ এবং আকর্ষক বিষয়বস্তু : স্মার্ট এডুকেশন মাল্টিমিডিয়া এবং ইন্টারেক্টিভ কন্টেট যেমন ভিডিও, সিমুলেশন এবং গেমসকে আরো আকর্ষক এবং মজাদার করে তুলতে সাহায্য করে।

 

 ব্যক্তিগতভাবে শেখার পথ : স্মার্ট শিক্ষা শিক্ষার্থীদের তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে শিখতে দেয়া এবং তাদের শেখার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করা।

 

 সহযোগিতামূলক শিক্ষা : স্মার্ট শিক্ষা অনলাইন আলোচনা ফোরাম, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম এবং সহযোগী প্রকল্পগুলোর মতো সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা।

 

 মোবাইল এবং নমনীয় শিক্ষা : স্মার্ট শিক্ষা শিক্ষার্থীদের যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায়, স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটের মতো মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে শিখতে দেয় এবং শিক্ষাবিদদের বিষয়বস্তু সরবরাহ করতে এবং দূর থেকে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে সক্ষম করা।

 

স্মার্ট শিক্ষা আমাদের শেখানো এবং শেখার উপায়কে ডিজিটাল পথে রূপান্তরিত করছে এবং সব শিক্ষার্থীর জন্য একটি সহজ এবং আকর্ষণীয় শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করছে। যাই হোক, স্মার্ট শিক্ষার অনেক চ্যালেঞ্জও আছে, কারণ এই পদ্ধতি ডিজিটাল অ্যাক্সেস, অবকাঠামো এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য আমাদের সঠিক পরিকল্পনা ও নীতির প্রয়োজন।

 

অনেক বিশ্ব নেতা স্মার্ট শিক্ষার প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছেন, যা দিয়ে শিক্ষার গুণমান এবং প্রবেশযোগ্যতা উন্নত করতে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী শিক্ষা পদ্ধতির ব্যবহারকে নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে, জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডা গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে একটি লক্ষ্য হচ্ছে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা ও সবার জন্য আজীবন শিক্ষার তথা লাইফ লং লার্নিংয়ের সুযোগের সৃষ্টি করা।’ এই লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী মানুষকে উচ্চমানের শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সম্পদ ব্যবহার করার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়।

 

এ ছাড়াও, অনেক দেশ ও সংস্থা স্মার্ট শিক্ষা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইরাসমাস+ নামে একটি প্রোগ্রাম রয়েছে। যা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে উদ্ভাবনকে সমর্থন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্মার্ট শিক্ষার প্রচারের জন্য বেশকিছু উদ্যোগও চালু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ফিউচার রেডি প্রোগ্রাম। যা স্কুলগুলোকে তাদের শিক্ষাদানের পদ্ধতির মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার ও অনুশীলনে বিষয়ে সব সহায়তা প্রদান করে।

 

কিছু নেতা স্মার্ট শিক্ষাকে ডিজিটাল বিভাজন দূর করার একটি উপায় হিসেবে দেখেন এবং নিশ্চিত করেন যে, সব ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীকে উচ্চমানের শিক্ষাগত সংস্থানগুলোতে অ্যাক্সেস রয়েছে। অনেক দেশের সরকার শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে আসা এবং বিশেষ করে গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে ই-লার্নিং সংস্থানগুলোতে অ্যাক্সেস সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ চালু করেছে। অন্যান্য নেতারা স্মার্ট শিক্ষাকে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে দেখেন। উদাহরণস্বরূপ চীনে স্টেম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, শিল্পকল্প ও গণিত) শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পরবর্তী প্রজন্মের নেতা তৈরির জন্য অপরিহার্য হিসেবে দেখা হয়।

 

কিছু দেশে নেতৃবৃন্দ নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য স্মার্ট শিক্ষা ব্যবহারের দিকেও মনোনিবেশ করেন, যেমন ঝরে পড়ার হার কমানো বা সাক্ষরতার উন্নতি। উদাহরণস্বরূপ ব্রাজিলে সরকার প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য একটি কম্পিউটার নামে একটি প্রোগ্রাম চালু করেছে। যার লক্ষ্য দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একটি কম্পিউটার ও ইন্টারনেট অ্যাক্সেস প্রদান করা।৪র্থ শিল্পবিপ্লব ও একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে যথার্থভাবে অভিযোজন করতে এখনই রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা চালুর জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের জনমিতি বিভাজন অনুযায়ী ২০৩০ সালেই জাতি সর্বোচ্চ কর্মক্ষম জনশক্তি পাবে। তাই ২০৩০ সালের পূর্বেই অর্থাৎ এখনই আমাদের (১) দেশের সব স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যায়ে যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তার অর্ধেকাংশকে ব্যবহার করে ৫০ ভাগ ছাত্রছাত্রীকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় এনরোলমেন্ট শুরু করা এবং ইনোভেটিভভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন স্তরে লার্নিং বাই ডুয়িং ও প্রজেক্ট বেইজড লার্নিং শুরু করা।

 

যাতে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক দক্ষতা বিকাশ ও তাত্তি¡ক ধারাসমূহ কর্মস্থলে কাজে লাগিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে যথার্থ ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম হয়; (২) প্রস্তাবিত শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি শিক্ষক কর্মচারি নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ শুরু করা, (৩) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পর্যায়ক্রমে পরিকল্পিতভাবে ল্যাব ওয়ার্কশপ তৈরি করা’ (৪) প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে যে ৬৪টি টিএসসিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছিল, সেখানে পুনরায় ছাত্র ছাত্রী ভর্তি করা। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে যেসব প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা কোর্স শুরু করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে কয়েকজন অদূরদর্শী ব্যক্তি তা বন্ধ করে দেয়।

 

যদিও উল্লিখিত টিএসসিসমূহের জন্য সরকার শিক্ষকের পদ সৃষ্টিসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বিষয়টি বর্তমান সরকারের সাফল্য দেখা যেতে পারে। (৫) সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫০% টিভিইটি গ্র্যাজুয়েট তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের জন্য একটি দক্ষ ও ত্যাগী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে টিভিইটি গভর্ন্যান্স সেল গঠন করা এবং বর্তমানের উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ও টিভিইটি বিভাগকে পুনর্গঠনপূর্বক একটি সাধারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অন্যটিকে টেকনিক্যাল এডুকেশন মন্ত্রণালয় করা।

 

বর্ণিত ২টি মন্ত্রণালয়ে দেশের যোগ্যতাসম্পন্ন নিষ্ঠাবান কর্মচারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে দীর্ঘ সময়ব্যাপী তাদের কাজে রাখতে হবে।

 

আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন উৎপাদনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার যেকোনো বিনিয়োগ সুদাসলসহ বহুগুণে শুধু রিটার্নই দেয় না, বরং একটি জাতিকে উন্নত সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করে। তাই এখনই টার্গেটভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে যেকোনো অবহেলা ও বিলম্ব জাতির জন্য কলংকজনক অধ্যায়ই সৃষ্টি করবে না, বরং সীমাহীন ক্ষতির সম্মুখীন করবে।

 

এ কে এম এ হামিদ, উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version