-->

জীবন তো দহনের, তদন্তই কি কথা?

ড. জোবাইদা নাসরীন
জীবন তো দহনের, তদন্তই কি কথা?

ভোরেই সংবাদটা জেনেছিলাম। কিন্তু কিছু করতে পারছিলাম না। শুনেছিলাম ওখানে লোকজন অনেক ভিড় করছে। কয়েকদিন আগেও এই ঢাকায় আগুন লাগার ঘটনা শুনেছি। আসলে বললে ভুল হবে না বোধহয় যে, কয়েকদিন পর পরই আগুন লাগা এখন মনে হয় অনেকটাই নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। তাই আমাদের কান, চোখ সয়ে গেছে আগুন। কারণ দেখুন না, ২০২৩ সালের মাত্র তিনটি মাস আমরা পার করেছি। এখনো এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ।

 

এর মধ্যেই পাঁচবার আগুনের তাপের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। এটি শুধু রাজধানীর চিত্র। কারণ রাজধানীর বাইরে আগুন লাগার খবরে আমরা অতটা বিচলিত হই না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী এই তো মাত্র সপ্তাহখানেক আগে একই দিন (গত ২৭ মার্চ) ঢাকার তিনটি স্থানে আগুন লেগেছিল। সেদিন মহাখালীতে সাততলা বস্তিতে আগুন লেগেছিল। সেখানকার বেশ কয়েকটি ঘর পুড়ে গেছে।

 

এবং রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের সেলটেক সিয়েরা কম্পিউটার সিটি ভবনে আগুন লেগেছিল। অন্যদিকে পুরান ঢাকার কাপ্তানবাজারের জয়কালী মন্দিরের পাশের সুইপার কলোনিতে আগুন লেগেছিল। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়েছিলেন চারজন। এর আগের মাসে গত ২৬ ফেব্রুয়ারিতে কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে বিবেচিত গুলশানের একটি ১২ তলা আবাসিক ভবনে আগুন লাগে এবং ওই দুর্ঘটনায় দুজন মারা যান।

 

গত মঙ্গলবার খুব সকালে যখন অনেকেই হয়তো সেহরির পরে একটু ঘুমিয়েছিলেন, তখন ঘটে এ অগ্নিকাÐের ঘটনা। ঘটনাটির মূল এলাকা বঙ্গবাজার। বঙ্গবাজার এলাকা ঢাকায় বসবাসরত মধ্যবিত্তদের জন্য অনেক পরিচিত। বিশেষ করে যারা দেশের বাইরে পড়তে যান, তাদের এমন কেউ নেই যাদের বঙ্গবাজারে যেতে হয় না। এমনকি স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীই বঙ্গবাজারের ওপর নির্ভরশীল।

 

তবে এই বাজারের মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, এ চারটি মার্কেটের ভেতরে ওলি-গলি অনেক সরু ও গুমোট। সেখানে অনেক সময় এমনিতেই শ্বাসকষ্ট হয়। দোকানগুলোও খুবই লাগোয়া। সেভাবেই মানুষজন কখনো একটু আলগে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করে। অনেক গলিতে দুজন একসঙ্গে এক দোকানের সামনে দাঁড়ানোর অবস্থাও নেই। সেখানেই আগুন লাগে।

 

ওই আগুন একে একে বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ মার্কেট ছাড়িয়ে পুলিশের ব্যারাকেও পৌঁছায়। অথচ প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছে, আগুনের মূল উৎস ছিল আদর্শ মার্কেট। ওই আগুন নেভাতে ফায়ার ব্রিগেডের ছয় ঘণ্টা লাগে। তারপরও কোনো কোনো মার্কেটের আগুন নেভেনি। রাত ৯টা পর্যন্ত ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা কাজ করেছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।

 

অনেক মন্দের ভালোর মধ্যে বড় একটি বিষয় যে, খুব সকালে আগুন লাগায় এবং মার্কেটে ওই সময় খুব বেশি লোক না থাকায় এই অগ্নিকান্ডে কেউ মারা যাননি। তবে ক্ষতির হিসাব অনেক বড়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এ ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি।

 

আমরা সবাই জানি, ব্যবসায়ীদের জন্য ঈদের আগের এ সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন উৎসব, পার্বণেই মূলত ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি কোনাবেচা করেন। কারণ অন্য সময় মানুষ এতটা কাপড়চোপড় কিনে না। তাই ঈদ সামনে রেখে খুব স্বাভাবিকভাবেই ওই মার্কেটগুলোয় অনেক টাকার মালপত্র তুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা।

 

কেন ঘটছে এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা? একদিকে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স চার বছর আগে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে ঘোষণা করেছিল ফায়ার সার্ভিস; অন্যদিকে দোকান মালিকরা বলছেন, ফারার সার্ভিসের অফিস খুব কাছে থাকলেও পানির অভাব ছিল। অগ্নিকান্ড এলাকার কাছেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়েছে। এতেও হয়নি।

 

পানি আনতে হয়েছে হাতিরঝিল, পুলিশের সদর দপ্তর ও ঢাকা ওয়াসা থেকে। তবে অন্যান্য সময়ের মতো এখানেও স্থানীয় লোকজনের অতিরিক্ত উৎসাহ, ভিডিও করা, ছবি তোলা এগুলোর কারণে ফায়ার ব্রিগেডকে কাজ করার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়েছে বলে জানা গেছে গণমাধ্যম সূত্রে। কেননা এ মার্কেটটির গলিগুলো খুবই সরু। সেখানে কাজ করা সত্যিই কষ্টের। এ ছাড়া বাতাসের বেগও ছিল আগুনের অনুক‚লে। এ জন্য আগুন নেভাতে সময়ও লেগেছে অনেকটাই।

 

এবার আসি কয়েকটি বক্তব্য বিশ্লেষণের দিকে। ফায়ার ব্রিগেড এ অগ্নিকান্ডের দায়ভার সেই মালিকদের ওপর চাপাতে চাচ্ছে এই বলে যে, ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণার পরও কেন তারা এ ভবনে ব্যবসা করছিলেন কিংবা এ ভবন ছেড়ে যাননি? তা হলে প্রশ্ন আসে, ওই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ জানার পরও এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব কী ছিল? তারা কি দায়িত্ব পালন করেছেন? কেন করলেন না? এসব প্রশ্ন তোলা খুবই জরুরি।

 

পানি সংকটের বিষয়ও এর আগে বহুবার আলোচিত হয়েছে। এখন বলা হতে পারে যে, এই ঢাকা শহরে তো কোনো জলাশয় দখলমুক্ত নয়। দূষণের কথা বাদই দিলাম। তা হলে পানি আসবে কোথা থেকে? এ কারণে কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার ব্রিগেডকে সব সময় পানি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এটি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নেয়া হয়েছে কি? হয়নি। কেন হয়নি?

 

এত উন্নয়ন কোনো কাজেই আসবে না যদি জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানিই আমাদের না থাকে। ওই জলাশয়গুলো দখলমুক্ত করে সেটি প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে শহরে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ এবং বাড়িতে পানির মজুদ তো সরকারেরই করার কথা। কেন ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটে এত মানুষ ব্যবসা করছেÑ এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো দায় ছিল না? তারা কী সেই ব্যবসায়ীদের অন্য কোনো জায়গায় পুনর্বাসনের কোনো চেষ্টা করেছিলেন?

 

ওই ভবনটি ভাঙার কোনো উদ্যাগ গ্রহণ করা হয়েছিল? সরু অলি-গলির বিপরীতে প্রশস্ত রাস্তা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল? না, কিছুই করা হয়নি, আমরা দেখিনি। আমরা দেখতে পাই আগুন, পানির সংকট আর শুনি সব হারানোর আর্তনাদ। যাদের যা হারিয়েছে, একমাত্র তারাই বুঝছেন ক্ষতির মর্মবেদনা। আমরা হয়তো দূর থেকে আহাজারি করি। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আগে তদন্ত রিপোর্ট আসুক, তার পর ক্ষতিপূরণ। এর আগেই চলছে একে অন্যকে দোষারোপ। সবাই দায়মুক্তি চায়।

 

বারবার বলা হচ্ছে জলাশয়গুলো সংস্কারের। কিন্তু সেগুলোর বেশিরভাগই ক্ষমতাসীনদের দখলে থাকায় সেটিও করা হচ্ছে না। আমাদের বেশিরভাগেরই আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ নেই। অনেক বিল্ডিংয়েই হয়তো আগুন নেভানোর যন্ত্র আছে। তবে সেগুলো কীভাবে চালাতে হয়, তা অনেকেই জানেন না।

 

কারণ এগুলো লাগানোই হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার শর্ত পূরণ করতে। অথচ ওই বিষয়ে আর কোনো কিছু করা হয় না। তাই যন্ত্র থাকলেই হবে না। সেগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ পরিচালনা খুবই জরুরি। আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া একেবারেই জরুরি। তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গাটা করে দেয়া আমাদেরই দায়িত্ব।

 

লেখক : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version