-->
শিরোনাম

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য দরকার দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা

মোতাহার হোসেন
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য দরকার দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা গ্রেফতার প্রভৃতি নিয়ে গত কিছুদিন ধরে নানা আলোচনা,সমালোচনা,টিভির টক শো’তে ঝড়বইছে। দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা অপিরহার্য্য। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারের ভূলক্রটি যেমন সংবাদ পত্রে তুলে ধরা দরকার। তেমনি সরকারের ভাল কাজের প্রশংসা করে সংবাদ,সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ হওয়া দরকার।

 

কিন্তু অনেক সময় কোন কোন সংবাদপত্র,সংবাদ মাধ্যম সরকারের ভাল কাজের প্রশংসার পরিবর্তে, পরিকল্পিত ভাবে মিথ্যা,বিভ্রান্ত মূলক সংবাদ,সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। অনেক সময় মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,জাতীয় পতাকা,জাতীয় সংগীতকে কটাক্ষ করে সংবাদ প্রকাশ করে।

 

একই ভাবে কোন কোন রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন কালে নেতা কর্মীদের হাতে লাটি ও মাথায় জাতীয় পতাকা বেধে মিছিল ,মিটিং এ অংশ গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের উপর ,আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর,পার্শ্ববর্তী দোকান,শপিংমলে হামলা,যানবাহন ভাঙ্গচ‚র,অগ্নি সংযোগে লিপ্ত হওয়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখি।

 

সম্প্রতি একটি পত্রিকায় স্বাধীনতা দিবসের দিন মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাও আবার মিথ্যা বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত ঐ সংবাদে একজন শিশুর হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তাকে দিয়ে শেখা কথা বলানোর চেষ্টা অন্যলোকের কন্ঠে বক্তব্য প্রকাশ করে সংবাদপত্র জগতে এক কলংক জনক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। একই সঙ্গে সংবাদ পত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ভূমিকাকে দারুণ ভাবে প্রশ্ন বিদ্ধ করেছে।

 

পাশাপাশি সংবাদ প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক,সম্পাদকের দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা,দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। দায়িত্ব জ্ঞানহীন এরকম একটি নির্জলা মিথ্যা,কল্পকাহিনীকে সংবাদ আকারে প্রকাশের পর একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে নিজেকেও অপরাধী মনে করছি। তবে আশার কথা হচ্ছে ঐ দৈনিকের দায়িত্বহীন, মিথ্যাচারে দুষ্ট অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে পেশাজীবী,সাংবাদিক সংগঠন সমূহ,নাগরিক সমাজ,বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সাংস্কৃতিক সংগঠন,জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিবাদে স্বোচ্চার।

 

তারা এ ধরনের হলুদ সাংবাদিকতা বন্ধের পাশাপাশি দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনারও দাবি জানিয়েছেন। কোন অপপ্রচার,অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ নিকট অতীতে এটাই প্রথম। অবশ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বন্ধে ও সাংবাদিক সংগঠন সমূহ সরকারের কাছে তাদের অবস্থান ও তুলে ধরেন।

 

প্রশ্ন হচ্ছে কোন ব্যক্তি,প্রতিষ্টান,সংবাদ পত্র সরকারের সমালোচনা,সরকারের কর্মকান্ড, সরকারি দলের এমপি,মন্ত্রীদের কর্মকান্ড,বক্তব্য বিবৃতি নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে প্রায়শই। এ জন্য কখনো সরকারি দলের পক্ষ থেকে তেমন উচ্ছবাচ্য হতে দেখিনি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠিয়ে প্রকাশিত সংবাদের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে। বিগত সময়ে এ ধরনের সংবাদ সম্পাদকীয় প্রকাশ হয়েছে। আবার কখনো কখনো ঐ সব সংবাদ সম্পরদকীয় নিবন্ধের বিরুদ্ধে ভূক্তভোগী,ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের প্রতিবাদ, ছাপা হয়েছে, আবার কখনো কখনো মামলা হয়েছে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ক্ষতিগ্রস্ত এমপি ,মন্ত্রী বা সরকারি সংস্থা থেকে মামলা করার নজিরও আছে।

 

সম্প্রতি প্রথম আলো সংবাদ প্রকাশের নামে আমাদের মহান স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতার বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে শেখ হাসিনা সরকারের ইতিবাচক উন্নয়ন তৎপরতা তথা সাফল্যকে হেয় করে দেখার অপপ্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে।

 

অবশ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ, ব্যবহার ও এই আইনে মামলা হওয়ার সথে সাথে কাউকে গ্রেফতারের আগে বিষয়টি তদন্ত,পর্যালোচনা করার দাবি রয়েছে সাংবাদিক সংগঠন গুলোর পক্ষ থেকে। সরকারের দায়িত্বশীল মহলণ নিশ্চয় সাংবাদিক সংগঠন সমূহের এই দাবি পর্যালোচনা করে বিদ্যমান আইনের সংশোধন,সংযোজন করা প্রয়োজন।

 

২৭ মার্চ (২০২৩) প্রকাশিত একাত্তর টিভির ‘স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোর সেই ছবি পুরোটাই ভুয়া’ শিরোনামে সংবাদে জানানো হয়েছে, দৈনিক প্রথম আলোর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাইরাল হওয়া খবরের ছবি ছিল, ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে এক শিশু।

 

নাম জাকির হোসেন। শিশুটির উদ্ধৃতি ছিল এমন- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কি করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো।’ জাকির নামটি ভুল ছিল। আসলে সাত বছরের সবুজ নামে ওই শিশুর হাতে ১০ টাকা দিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক ছবি তুলেছেন বলে দাবি ওই শিশু ও তার পরিবারের।

 

সাভারের কুরগাঁও পাড়ায় সবুজের বাড়ি। তার মা মুন্নী বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে মেজো সবুজের নাম কীভাবে জাকির হোসেন হলো, আর প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তানকে কেন দিনমজুর বলা হলো তাতে তিনি অবাক হয়েছেন। রাজমিস্ত্রি বাবা আর মা’র আয়ে সংসার চলে। অন্যদিকে ছোট সবুজ কেমন করে জানলো বাজারের দ্রব্যমূল্যের খবর-সেটাও বিস্ময়কর। স্বাধীনতা দিবসে এমন খবরকে ১৯৭৪ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে জাল পরানো বাসন্তীর ছবির মতোই চক্রান্ত বলা হচ্ছে বিশিষ্টজনদের দৃষ্টিকোণ থেকে।

 

বাস্তবতা হলো, প্রকৃতপক্ষে অসৎ উদ্দেশে উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে একজন শিশুকে সংবাদের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশে বাসন্তী নামের একজনকে জাল পরিয়ে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। উক্ত বাসন্তীকে যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সাজানো হয়েছিল তা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে।এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এর বক্তব্য হচ্ছে ‘যিনি সংক্ষুব্ধ হন, তিনি মামলা করেন।

 

প্রথম আলোর সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যে মামলাটি হয়েছে, সেটি সঠিক হয়েছে। ‘‘আমরা ভাত, চাল, মাছ ও মাংসের স্বাধীনতা চাই–’’ সাত বছর বয়সের ছেলেকে ১০ টাকা ও প্ল্যাকার্ড দিয়ে ছবি তোলা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা হয়েছে। এর ইম্প্যাক্ট হচ্ছে ইথিওপিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও দুর্ভিক্ষ চলছে। বাস্তবে তা নয়, বরং দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এটি করা হয়েছে। সারা পৃথিবীতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে হয়তো আইন নেই, কিন্তু এ ধরনের আইন আছে।

 

এর মধ্যে আমরা যেটা করেছি তা হচ্ছে, সাংবাদিক বা যাঁর বিরুদ্ধেই ডিজিটাল আইনে মামলা হোক, তাঁকে যেন দ্রুত গ্রেপ্তার না করা হয় এবং মামলাটির অভিযোগ গ্রহণযোগ্য কিনা তা যাচাইয়ের জন্য একটি সেল আছে, সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপ নেওয়ায় অপব্যবহার অনেকটা বন্ধ ছিল। এখন দু-একটি মামলা হচ্ছে। এ আইনের অপব্যবহার যেখানেই হয়েছে, পদক্ষেপ নিচ্ছি বন্ধ করার বলে মন্তব্য তার।

 

জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬-২০০১ সালে এক মেয়াদ এবং ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশকে বিশ্বের দেশসমূহের কাছে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছে। করোনা পরিস্থিতিতে উন্নত দেশগুলোও যখন নাস্তানাবুদ অবস্থার সম্মুখীন, পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ যখন দেউলিয়া অবস্থায় পতিত, এমন পরিস্থিতিতেও শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শি নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যহত রয়েছে।

 

করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের সংকট মোকাবিলা করে যে মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, সেই মুহূর্তে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে সরকারের বিরোধিতার নামে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার অপচেষ্টা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কারণ দায়িত্বশীল সাংবাদিকরা দেশের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা ও সাফল্যের সহযাত্রী। সমাজের সঠিক চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরাই গণমাধ্যমের কাজ।

 

আর গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ জনমনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে বলে সংবাদমাধ্যমকে আরো দায়িত্বশীল,সর্তক হওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশপ্রেম,স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের,জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার প্রশ্নে কমিটমেন্ট থাকা জরুরি। এই বিষয়গুলোকে অস্বীকার করলে আমাদের অস্থিত্ব,আমাদের জাতীয় স্বত্ত্বাকে অস্বীকার করা হয়। স্বাধীনতা দিবসের দিন প্রথম আলো এমন একটা কাল্পনিক ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার অশুভ ইংগিত বহন করে। প্রত্যাশা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সাংবাদিক সংবাদ পত্র সমূহের জবাবদিহিতা,স্বচ্ছতা,বন্তুনিষ্টতা নিজেদেরকেই নিশ্চত করতে হবে।

 

একই সঙ্গে দেশের মহান স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সংগীত,জাতীয় পতকার সম্মানু সমুন্নত রাখাও গণমাধ্যমের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। একই সঙ্গে ব্যক্তি,গৌষ্টি বা কোন দলের পক্ষে উদ্দেশ্য মূলক,মিথ্যা ,বিভ্রান্ত কর সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থেকে স্বাধীন,সঠিক সাংবাদিকতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে।

 

কারণ স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চত করতে হলে একই সঙ্গে সাংবাদিক, সংবাদত্রের মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক সংগঠন সমূহ,সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। পাশাপাশি সরকার,সরকারের প্রশাসন যন্ত্রকেও সহায়ক ভূমিকা নিতে হবে তাহলেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

 

মোতাহার হোসেন: উপদেষ্টা সম্পাদক ,দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম। ৮.০৪.২০২৩ ই।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version