-->
শিরোনাম

হার্ট অ্যাটাকের জরুরি সেবা : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

অধ্যাপক ডা. মো. আফজালুর রহমান
হার্ট অ্যাটাকের জরুরি সেবা : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

অধ্যাপক ডা. মো. আফজালুর রহমান : হার্ট অ্যাটাক একটি আকস্মিক হৃদরোগ। দেখা যায়, সুস্থ-সবল মানুষ, হয়তো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, হঠাৎ করেই এক দিন হার্ট অ্যাটাক হলো।

 

বুকের মাঝখানে হঠাৎ ব্যথা হার্ট অ্যাটাকের প্রধান লক্ষণ। কখনো তীব্র ব্যথা হয়। কখনো মনে হয়, কেউ বুকটাকে চাপ দিয়ে ধরেছে। বুকে প্রচণ্ড ভার মনে হতে পারে। বুকের ব্যথা ঘাড়, কাঁধ, চোয়াল, বাম হাত বা পিঠের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বুকে ব্যথা যখন বিশ্রামেও কমে না, দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় অথবা তীব্রতা বাড়তে থাকে, সঙ্গে শরীর ঘামা, বমি অথবা বমিভাব হয়, তখন হার্ট অ্যাটাক সন্দেহ করা উচিত।

 

এমন অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। শুধু দ্রুত হাসপাতালে না যাওয়া এবং চিকিৎসার বিলম্বতায় অনেক হার্ট অ্যাটাকের রোগীর পথে মৃত্যু হয়। অনেক রোগী হার্ট ফেইলর এবং অস্বাভাবিক মাত্রার কম রক্তচাপ বা ‘শক’ নিয়ে এমন সময় হাসপাতালে আসেন, যখন পুরো চিকিৎসাই জটিল হয়ে পড়ে।

 

আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজিসহ অনেক আন্তর্জাতিক হৃদরোগ গবেষণা সংস্থার তৈরি হার্ট অ্যাটাক চিকিৎসার নির্দেশিকা রয়েছে। এসব নির্দেশিকা মতে, হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় কোনো রকম কালক্ষেপণ করা যাবে না। এখানে প্রত্যেকটা মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। হার্ট অ্যাটাক সন্দেহ, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় সময়ের হিসাব করতে হবে মিনিট কষে।

 

ইসিজি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে ইসিজি হয়, রোগীকে যত দ্রুত সেরকম জায়গায় নেয়া যাবে, তত দ্রুত রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। বুকে ব্যথার সঙ্গে শুধু ইসিজির পরিবর্তন দেখে ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাক নির্ণয় করা যায়। এ অবস্থায় রোগীকে ওখানেই প্রাথমিক চিকিৎসা এবং হার্টের রক্তনালিতে জমাট রক্ত তরল করার জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রয়োগ করতে পারলে হার্ট অ্যাটাকজনিত অনেক জটিলতা এড়ানো যায়। হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ স্পষ্ট বোঝা গেলে এবং নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছাতে বেশি দেরি হলে গন্তব্যপথে তাৎক্ষণিক মোট ৩০০ মিলিগ্রাম এসপিরিন ট্যাবলেট এবং ৩০০ মিলিগ্রাম ক্লোপিডোগরেল ট্যাবলেট একসঙ্গে রোগীকে খাওয়ানো যেতে পারে।

 

রোগী নিকটস্থ প্রথম যে হাসপাতালে পৌঁছায়, তাকে ফার্স্ট মেডিকেল কন্টাক্ট বা প্রথম চিকিৎসা সংযোগ বলে। এখানে ১০ মিনিটের মধ্যেই ইসিজি করে রোগ নির্ণয় করা দরকার। ইসিজিতে ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাক হলে রোগীকে দ্রুত চিকিৎসা দিতে হয়। বুকে ব্যথা শুরু হওয়ার কতক্ষণের মধ্যে রোগী সেখানে গেল, হার্ট আটকের চিকিৎসায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি কতটা সক্ষম বা এটি কোন স্তরের হাসপাতাল, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে রোগীকে জরুরি চিকিৎসার আওতায় আনা হয়।

 

হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা দেয়ার অবকাঠামোগত সুবিধা সব হাসপাতালে একরকম নয়। রোগীর অবস্থা এবং হাসপাতালের সক্ষমতা অনুযায়ী রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে প্রথম সংযোগকারী হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দ্রুত ইসিজি করে ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাক নির্ণয়ে বিলম্ব করা যাবে না। কখনো হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে উচ্চতর লেভেলের হাসপাতালে প্রেরণ করার দরকার পড়ে। কারণ, বুকে ব্যথা শুরুর ১২ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের সক্ষমতা এবং রোগীর অবস্থা সমন্বিত হলে রোগীর হার্টের রক্তনালিতে রিং বা স্টেন্ট প্রতিস্থাপন করেও চিকিৎসা করা হয়। এ পদ্ধতির নাম প্রাইমারি পিসিআই । ১২ ঘণ্টার মধ্যে রিং বা স্টেন্ট লাগিয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথম সংযোগকারী হাসপাতাল থেকে এরকম সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে পৌঁছানোর সময়-ব্যবধান ইসিজিতে হার্ট অ্যাটাক নির্ণয়ের সময় থেকে দুই ঘণ্টার কম হতে হবে। এত কম সময়ের ব্যবধানে সেরকম সুযোগ সংবলিত হাসপাতালে পৌঁছে রিং লাগিয়ে চিকিৎসা করার সুযোগ আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এখনো সীমিত। রিং লাগিয়ে চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুলও।

 

আমাদের জনগোষ্ঠী এবং অর্থনৈতিক অবস্থাও এসব চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়। হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা নির্দেশিকাগুলো এসব দিকও বিবেচনা করেছে। তারা বলছে, ইসিজিতে ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাক নির্ণয় থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে যদি রোগীকে তাৎক্ষণিক রিং লাগানোর সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে প্রেরণ করা না যায়, তাহলে বুকে ব্যথা শুরুর ১২ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর হার্টের রক্তনালিতে জমাটবাঁধা রক্ত তরল করার বিশেষ ওষুধ ব্যবহারের সুযোগ থাকে। বহুল ব্যবহৃত এ ধরনের দুটি ওষুধ হলো স্ট্রেপটোকাইনেজ এবং টেনেকটাপেলেজ। সেক্ষেত্রে উচ্চতর হাসপাতালে প্রেরণের পূর্বে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে (সবমিলিয়ে সর্বোচ্চ আধাঘণ্টা) প্রাথমিক চিকিৎসার (৩০০ মিলিগ্রাম এসপিরিন ট্যাবলেট, ৩০০ মিলিগ্রাম ক্লোপিডোগরেল ট্যাবলেট এবং ৮০ মিলিগ্রাম এটোর-ভাস্টাটিন) পাশাপাশি স্ট্রেপটোকাইনেজ অথবা টেনেকটাপেলেজ ইনজেকশন দেয়া শেষ করতে হবে এবং রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য স্টেন্ট বা রিং লাগানোর সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে।

 

যদিও প্রাইমারি পিসিআই অর্থাৎ বুকে ব্যথার ১২ ঘণ্টার মধ্যে রিং বা স্টেন্ট প্রতিস্থাপন সর্বোত্তম পদ্ধতি, তবে তা সম্ভব না হলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাকে স্ট্রেপটোকাইনেজ অথবা টেনেকটাপেলেজ ইনজেকশন ব্যবহার করে ইসিজিতে হার্ট অ্যাটাক নির্ণয় থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও যদি স্টেন্ট বা রিং প্রতিস্থাপন করা যায়, তবে চিকিৎসার ফলাফল প্রাথমিক রিং প্রতিস্থাপনের মতই হয়। হার্ট অ্যাটাক চিকিৎসার এই পদ্ধতির নাম ফার্মাকো-ইনভেসিভ চিকিৎসা পদ্ধতি (স্ট্রেপটোকাইনেজ অথবা টেনেকটাপেলেজ ইরজেকশান + রিং প্রতিস্থাপন)।

 

‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় প্রথম সংযোগকারী হাসপাতালে আমাদের স্ট্রেপটোকাইনেজ অথবা টেনেকটাপেলেজ ইনজেকশান ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে এবং রোগী যদি ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে রিং প্রতিস্থাপনের সব সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে পৌঁছে ফার্মাকো-ইনভেসিভ (স্ট্রেপটোকাইনেজ অথবা টেনেকটাপেলেজ ইনজেকশান + রিং প্রতিস্থাপন) পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণের জন্য আর্থিক এবং মানসিকভাবে সক্ষম থাকে, তবে তাকে দ্রুত এ ধরনের চিকিৎসা সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে। রোগীর স্বজনের সঙ্গে সবদিক আলোচনা করে এবং সবদিক অবহিত করে স্ট্রেপটোকাইনেজ অথবা টেনেকটাপেলেজ ইনজেকশান প্রথম সংযোগকারী হাসপাতালে ব্যবহার করতে বাধা নেই। বরং কোনো কারণে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা বিলম্ব হলে অসুখ জটিলতার দিকে যেতে পারে। একদিকে রোগীর চিকিৎসা জটিল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে রোগী ক্রমাগত ঝুঁকির সম্মুখীন হতে থাকে।

 

লেখক : প্রাক্তন পরিচালক ও অধ্যাপক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version