মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি ও ব্যয় কমাতে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।
নতুন এ নিয়মে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য ‘ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ)’ নামে পৃথক একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনার জন্য একটি কাঠামো, জাতীয় পর্যায়ে একটি নীতিমালা তৈরি ও পরীক্ষার মাধ্যমে একটি স্কোর দেয়ার কথাও আলোচনা করা হয়।
গত ৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অনুষ্ঠিত এক সভায় এসব আলোচনা করা হয়। এ ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ভোগান্তি অনেকটাই কমে যাবে।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়য়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ১৫ এপ্রিল ২০২৩ রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক যুগ্ম সচিবের স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ দেয়া হয়।
তাতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলরের অভিপ্রায় অনুযায়ী বিগত সময়ে যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় যুক্ত ছিল তাদের অংশগ্রহণে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে দায়িত্ব প্রদান করা হলো। একই সঙ্গে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ হতে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একক ভর্তি পরীক্ষার আওতায় নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে ইউজিসিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে দেশে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলাদাভাবে ভর্তি করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা ভর্তি পরীক্ষা হয়।
তবে ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে, তিনটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট, কুয়েট ও রুয়েট) আরেকটি গুচ্ছ এবং কৃষি ও কৃষি শিক্ষাপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় অপর একটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো দক্ষতার সাথে ‘গুচ্ছ পদ্ধতি’তে ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা করে আসছে। এটি একটি চমৎকার উদাহরণ।
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যখন অনেক কম ছিল (দশ-বারোটি) তখন ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলে পরিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তির অন্ত থাকত না। তাদের অভিভাবকসহ বিশেষ করে মেয়ে ভর্তিচ্ছুদের দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হতো। তাদের যাতায়াত, থাকার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, সময়ের অপচয়, যাত্রায় দুর্ভোগ, দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকা, রাস্তায় ও পথে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া সব মিলে এক অসহনীয় দুরবস্থার সৃষ্টি হতো। তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়নি এবং ওই সময় থেকেই একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বহু আলোচনা, সমালোচনা, লেখালেখি হয়েছে।
জিএসটি ভর্তি পরীক্ষার প্রথম বছর থেকেই অভিজ্ঞতার অভাব ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নেতিবচাক ধারণা তৈরি হয়। তা ছাড়া ভর্তি প্রক্রিয়া সমাপ্ত করার পরও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কিছু আসন ফাঁকা থেকে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়বারের ভর্তি পরীক্ষায়ও নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। যেমন ভর্তিচ্ছুদের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দুই মাসেরও অধিক সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের করণীয় সম্পর্কে অন্ধকারে ছিল। ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষার্থী গুচ্ছের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে ক্লাস করে দিয়েছিল সেশনজটে আটকে থাকার ভয়ে।
বিলম্বে ভর্তি কার্যক্রম করার কারণ হিসেবে জিএসটির পক্ষ থেকে বলা হয় যে, সমন্বিত ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য সফটওয়্যার তৈরি করতে তাদের এই সময় লেগেছে। সময়ক্ষেপণের কারণে ভর্তির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জিএসটিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যখন ক্লাস শুরু হয়, তখন জিএসটির বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার-পাঁচ মাস ক্লাস ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তাই অনেকে মনে করেন যে, প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষার সময় যে সমস্যাগুলো উদ্ভূত হয়েছিল, সেগুলো সমাধানে পরবর্তীকালে কোনো বিষদ পর্যালোচনা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। বিশেষ করে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে দুই মাসের অধিক সময় শিক্ষার্থীরা অন্ধকারে থাকায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী সেশন জটের আশঙ্কায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায়, যে কারণে শিক্ষকরা মনে করেন গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না।
উপরোক্ত সমস্যাসমূহের একটি টেকসই সমাধান হতে পারে জাতীয় ভর্তি পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ বা ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ)। এনটিএ একটি পরীক্ষার পরিবর্তে বিষয়ভিত্তিক আলাদা আলাদা পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে। যেমন- পদার্থ, রসায়ণ, জীববিজ্ঞান, গণিত, বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান ও অ্যানালাইটিক্যাল অ্যাবিলিটি। শিক্ষার্থীরা তাদের লক্ষ্য ও পছন্দ অনুযায়ী বিষয়সমূহের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবে। প্রশ্ন পদ্ধতি এমন হবে যাতে মেডিকেল, প্রকৌশল, সাধারণ ও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের শর্ত ও প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ পায়।
মেধাতালিকায় স্থান পেতে শিক্ষার্থীদের এবার ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম ৩০ নম্বর পেতে হবে। পরীক্ষায় প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য ০.২৫ নম্বর কাটা যাবে। গুচ্ছভর্তি পরীক্ষার নম্বরসহ এসএসসি ও এইচএসসির জিপিএ, এইচএসসির মোট নম্বর ও বিভিন্ন বিষয়ের জিপিএ ও প্রয়োজনে নম্বর বিবেচনায় মেধাতালিকা প্রস্তুত করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, আন্তরিকতার অভাব, ইচ্ছাকৃত সংকট তৈরি করে রাখাসহ কয়েকটি কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এতদিন একটি সমন্বিত ও সুস্থির ভর্তির ব্যবস্থা চালু করা যাচ্ছিল না।
ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সইতে হয়েছে সীমাহীন ভোগান্তি। দীর্ঘ কয়েক বছরের চেষ্টায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে দেশের ৩০টির বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ায় বড় অগ্রগতি হয়েছে। একক ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য, স্বায়ত্তশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবেÑ এ অজুহাতে এতদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ প্রক্রিয়ার বাইরে ছিল। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় সংশ্লিষ্ট সবাই ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য