স্বাধীনতার পর যে কয়েকটি দেশ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তার অন্যতম জাপান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ১৯৭৩ সালে জাপান সফর করেছিলেন। তখন থেকে জাপান বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী, দেশটি বহুদিন ধরেই এ দেশে একক প্রধান বিনিয়োগকারী। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরের মাধ্যমে জাপান-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উভয়ের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত হলো।
সফরের দ্বিতীয় দিনেই দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক এবং তার পরই উভয় দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৮টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। প্রতিরক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, কৃষি গবেষণা, মেট্রোরেল, শিল্পায়ন, জাহাজভাঙা শিল্প, শুল্কসংক্রান্ত বিষয়, মেধাসম্পদ এসব বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, এসব চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু হলে দুই এশীয় দেশের সম্পর্ক আরো গভীর হবে। হয়তো অনেকেই ভাববেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের প্রধান এশীয় মিত্রদেশের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা কি বাংলাদেশকে এই ব্লকের দিকে বিশেষভাবে টানবে?
বাংলাদেশ বরাবর ভূরাজনীতির কোনো বিশেষ বলয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেয়নি। বঙ্গবন্ধু সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতিতে অটল থেকে বরাবর একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। আমরা জানি চলতি শতাব্দী শুরু হওয়ার সময় থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, এ শতাব্দী হবে এশিয়ার। অর্থাৎ পশ্চিম গোলার্ধের এতকালের আধিপত্যের অবসান হবে এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে চীনের উত্থান এবং চীন-রুশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ভারতও একটি আঞ্চলিক শক্তি থেকে বিশ্বশক্তিতে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে। তাছাড়া পশ্চিমের বলয়ভুক্ত দক্ষিণ কোরিয়াও তাদের স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখতে চায়।
চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করে তুরস্ক স্বতন্ত্র অবস্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সবমিলে পরিস্থিতি জটিল হলেও প্রত্যেকেরই অর্থনৈতিক এজেন্ডা স্বতন্ত্র হওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে বর্তমান সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার অর্থনীতিতে টিকে থাকা ও বিকশিত হওয়া সম্ভব। কেবল প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা।
রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে জাপান সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এটি যেন কেবল আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ না থেকে কাজে পরিণত হয় সে চেষ্টা বাংলাদেশকেই করতে হবে। আমরা আশা করব অর্থনৈতিক ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু বিষয়ের মধ্যে যেন এটিও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর পায়। কেননা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাঁচাতে গিয়ে বাংলাদেশ বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
কেবল আর্থিকই নয়, আইনশৃঙ্খলা, পরিবেশ, সামাজিক সংকটও বেড়েছে। তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে জাপানের যে কোনো উদ্যোগ ফলপ্রসূ হলে বাংলাদেশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। আমাদের মনে হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে আন্তর্জাতিক উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করতে হবে। আশা করি জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবার আরও উচ্চতায় উঠবে এবং ফলপ্রসূ হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য