-->
শিরোনাম

‘সময়ের চাহিদা ও শিক্ষা সংস্কারে সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টা’

অমিত রায় চৌধুরী
‘সময়ের চাহিদা ও শিক্ষা সংস্কারে সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টা’

বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলা। নতুন ও পুরোনো বছরের সময় সন্ধিতে শিক্ষাবিষয়ক একটি উন্মুক্ত সভা। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘সময়ের চাহিদা ও শিক্ষা সংস্কারে সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টা’। অংশীজন ছিলেন প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের চারশ’ প্রতিষ্ঠানপ্রধান, সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি। অডিটরিয়াম কানায় কানায় পরিপূর্ণ। উদ্যোক্তা শেখ হেলাল উদ্দিন ফাউন্ডেশন।

 

দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল অনুষ্ঠান। ভেসে আসছিল মাঠের নির্ভেজাল অভিজ্ঞতা। একে একে চিহ্নিত হচ্ছিল শক্তি ও দুর্বলতার অচেনা জায়গাগুলো। কৌতূহল, জিজ্ঞাসা আর পরামর্শের অবিরাম স্রোত সময়টাকে উপভোগ্য করে তুলেছিল।

 

নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে সত্যিই কোনো অন্তরায় আছে কিনা সেটা শনাক্ত করতে এ ধরনের মতবিনিময় কতটা জরুরি তা প্রমাণ হয়েছিল। তৃণমূল পর্যায়ের অনেক পর্যবেক্ষণ ছকবাঁধা চিন্তায় সত্যি ঢেউ তুলেছিল। তবে বিশ্ব জনীন শিক্ষা আয়ত্তে আনতে নতুনকে মানিয়ে নেয়ার সংকল্পেও শিক্ষকরা ছিলেন অবিচল।

 

আর পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর জন্য শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবারই যে মানসিক প্রস্তুতি দরকার তাও মেনে নিয়েছিলেন উপস্থিত সুধীজন। পারস্পরিক মতবিনিময়ের এমন সমৃদ্ধ ও অর্থপূর্ণ মুহূর্তগুলো সমাজ ভাবনায় যাতে জায়গা পায় সেজন্য আজকের আলোচনাটা সেখানেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

 

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সভ্যতা এগিয়েছে। মানুষের জীবনমান, আকাক্সক্ষা কিংবা স্বপ্ন সবই বদলে গেছে। সমাজের গড়ন ও দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে যাচ্ছে। আর এসব পরিবর্তনের সঙ্গে মানানসই জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করাই হলো সময়ের চাহিদা। তা না হলে সমাজ পিছিয়ে পড়বে, দেশের উন্নতিও থমকে যাবে।

 

সেজন্য চাই যুগের উপযুক্ত শিক্ষা। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার শিক্ষা। বিশ্বমানের শিক্ষা। সেজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, নীতি ও দর্শন। মুক্তিযুদ্ধ জাতিরাষ্ট্রের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে এমন ন্যায়পরায়ণ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ।

 

আর সেই প্রগতিশীল ও দক্ষ জনবল সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষা উন্নয়নের নিরন্তর প্রচেষ্টা। ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়কালটা হয়তো ইতিহাসের পাতায় শিক্ষা সংস্কারের ব্যস্ত পর্ব হিসেবে বিবেচিত হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুযোগ-সুবিধা, নিয়োগ-ভর্তি, পাবলিক পরীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা, ফল-নিবন্ধনে স্বচ্ছতা, লাইব্রেরি-ল্যাব-ভবন উন্নয়ন ও সর্বোপরি প্রযুক্তির ব্যবহার সবখানেই আমূল ও ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টা লক্ষণীয়। এসব উদ্যোগের সাফল্য কতটা মিলেছে তার মূল্যায়ন হয়তো এখন প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

 

লেখাপড়ায় সাধারণ মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি স্বাধীনতার বোধ হয় সবচেয়ে বড় সুফল। ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ সবার স্বপ্নজুড়ে আছে শিক্ষা। নিঃসন্দেহে এটা সামাজিক পুঁজি। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা সে আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষাই রাষ্ট্রের অবলম্বন। শিক্ষা শুধু নাগরিককে দক্ষ করে না, সৃজনশীল, দায়িত্বশীল ও মানবিকও করে তোলে। সময়ের প্রয়োজন মেটাতে পারে। সে শিক্ষাই মানসম্পন্ন। শুধু গ্রেড বাড়লে লাভ নেই, দরকার মৌলিক জ্ঞান। দেখতে হবে দেশীয় উদ্যোক্তা কেন দেশে দক্ষ কর্মী পায় না। অথচ সে দেশেই বড় সংখ্যায় ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট কাজের সন্ধানে সীমানা পেরোতে চায়।

 

অথবা বাঁচার তাড়নায় যে কোনো পেশায় ঠাঁই পেতে চায়। অর্থাৎ শিল্প ও বাজারের চাহিদার সঙ্গে জোগানের দৃষ্টিকটু ‘মিসম্যাচ’। সেই কর্মী দরকার যার দক্ষতা আছে, বাজারে ততটুকুই প্রয়োজন যতটা ডিমান্ড আছে। সনদ তো শুধু নয়ই, প্রায়োগিক জ্ঞান বা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যাই হোক, প্রয়োজনের বেশি হলেও বিপত্তি। সুতরাং ‘ক্যারিয়ার ম্যাপিং’ করে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী সৃষ্টি ও জোগান থাকতে হবে। নতুবা গরিব মানুষের কষ্টার্জিত করের টাকায় উন্নত দেশ শিক্ষিত জনবল কিনে নেবে। সমাজ যদি এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত না হয় তা হলে নতুন প্রজন্ম কাজ হারাবে বা দেশ ছাড়বে। তা হলে তো দেশ এক সময় প্রায় তারুণ্যবিবর্জিত হয়ে পড়বে। গড় আয়ু তো বাড়ছেই।

 

এ দেশে মুখস্থ নির্ভর শিক্ষার জনক ব্রিটিশ কলোনি প্রবর্তিত ব্যবসাবান্ধব ব্যবস্থা। সেখানেই আমাদের এখনো স্বাচ্ছন্দ্য, হয়তো মনোজাগতিক আনুগত্য। সে সিস্টেমের বর্তমান কারিগর কোচিং-গাইড নেক্সাস। কোচিং শিক্ষার্থীকে পরনির্ভর করে, পরাধীন করে। মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় থাকলে শিশু স্বাবলম্বী হয় না। মনের বিকাশ অবরুদ্ধ হয়। বিশ্লেষণের ঝোঁক বাড়ে না। চিন্তার জাল ছড়ায় না। ফলে ফাঁপা মানবসম্পদ তৈরি হয়; যা কাজের বাজারে মূল্যহীন। সে অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন নীতিনির্ধারকরা। সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের উদ্যোগেও একই উদ্দেশ্য নিহিত। কিন্তু শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। মোটিভেশনের অভাব ছিল। দৃষ্টিভঙ্গিতেও অস্পষ্টতা।

 

ফলে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি। সেজন্যই নতুন কারিকুলাম যেখানে ছাত্র-শিক্ষক হতে অভিভাবক সবাই সম্পৃক্ত। এসএসসির আগে পাবলিক পরীক্ষার চাপ নেই। এইচএসসি পর্যায়ে আরেকটি পরীক্ষা। শিক্ষক কর্তৃক মূল্যায়নযোগ্য অংশ আরো নিরপেক্ষ করার পক্ষে অনেকে মত প্রকাশ করেন।

 

এছাড়া বলা যায় শিক্ষাক্রম মোটামুটি পরীক্ষামুক্ত, নম্বরহীন মূল্যায়ন; যেখানে পাস-ফেল নেই। প্রতিদিনের পাঠ প্রতিদিনই মূল্যায়িত। দক্ষতাও লিপিবদ্ধ। শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি চলবে অবিরত। সতীর্থ, বাবা-মা, সমাজ সবাই শিক্ষক। এটাই ধারাবাহিক মূল্যায়ন। বছরে দুবার সামষ্টিক মূল্যায়ন। তবে প্রায় নম্বর ও পরীক্ষামুক্ত প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েরা বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা কীভাবে ভর্তি হবে তা নিয়ে অবিভাবকদের মনে অনিশ্চয়তা আছে।

 

কাজেই প্রশিক্ষণ বা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন সবখানেই যে বিপত্তি দেখা দেবে এতে আশ্চর্যের কিছু দেখি না। ‘স্বল্পতম সময়ে সর্বোচ্চ মুনাফা’ এই যখন বেঁচে থাকার জনপ্রিয় দর্শন তখন আদান-প্রদানের রসায়নে ছাত্র-শিক্ষক সবার জন্যই নীতি আগলে রাখা রীতিমতো দুঃসাধ্য। শিক্ষার্থীও চায় অল্প সময়ে অনেক রোজগার।

 

অর্থাৎ আর্থিক সুরক্ষা। এছাড়া ক্ষমতা ও বৈভবের প্রতিও তার আকর্ষণ বাড়ছে। সে কারণে বিজ্ঞানের মেধাবী ছেলেমেয়েরা এমন সব পেশায় এসে যাচ্ছে যেখানে তার কষ্টার্জিত দক্ষতা প্রয়োগের ন্যূনতম সুযোগ নেই। তবে নতুন শিক্ষাক্রম মাধ্যমিক পর্যন্ত শাখাহীন থাকায় সব শিক্ষার্থী অন্তত সাধারণ ও মৌলিক দক্ষতাগুলো রপ্ত করার সুযোগ পাবে।

 

কর্মসংস্থান নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন। আমাদের মেধাবী তরুণরা যাতে দেশেই কাজ পায়, সুযোগ পায়, ‘মিসম্যাচ’ না ঘটে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে কৃষিতে যথেষ্ট গবেষণা হয়েছে। কৃষিতে বিপ্লব হয়েছে। করোনা দুর্যোগে আমাদের ঢাল হয়েছিল কৃষি। তবে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শুধু দক্ষতা অর্জন করলেই দেশ উপকৃত হবে না, দেশের প্রতি মমত্ব তৈরি হতে হবে। ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহ থাকতে হবে। না হলে তারা হয় রোবট, নতুবা স্বার্থপর জীবে পরিণত হবে। যার মাশুল দিতে হবে অনাগত সময়কে।

 

সরকারের নির্দেশনা আছে সব পর্যায়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পড়ানোর। জানি না কত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা অনুসরণ করছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম তার লক্ষ্যই ছিল একটা প্রগতিশীল, জ্ঞান ও সমতাভিত্তিক সমৃদ্ধ সমাজ কায়েম করা। বিশ্বজনীন শিক্ষায় আমজনতার প্রবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের সবাইকে হতে হবে ঐক্যবদ্ধ।

 

লেখক : অধ্যাপক, ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version