স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে নির্মিত রেল লাইনে পরীক্ষামুলক রেল চলাচলের মধ্যদিয়ে বাঙালির বিশ্ব জয়ে নতুন মাত্রা সংযোজন হচ্ছে দেশের ইতিহাসে অনন্য মাইল ফলক। আর এই অনন্য মাইল ফলকের সাথে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে এই সেতু ও রেল লাইনকে ঘিরে পদ্মার দুই তীরে গড়ে ওঠা বৃক্ষণরাজির মন মুগ্ধকর ও নয়নাভিরাম ‘সবুজ বলয়।’ পদ্মা সেতু ও রেল সড়কের দুপাশে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে‘ সবুজ বলয়’
এই সেতু ও রেল দিয়ে চলাচল করার সময় নানা প্রজাতির গাছ গাছালিতে শোভিত বৃক্ষরাজি। এই দৃশ্য দেখে মনে হবে এ যেন কোন বৃক্ষ নয়, সবুজের অনন্য সমাহার, এসব বাহারি গাছ গাছালির অনাবিল মুগ্ধতা ছাড়াছে সেতুর চারদিকে। সকালের সূর্যদ্বয়ে আর বিকেলের সূর্যাস্তের দৃশ্যে মানুষকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যের অন্যজগতে নিয়ে যায়। শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবায় পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা থেকে মাদারীপুরের শিবচরের পাচ্চর পর্যন্ত সাড়ে ১০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক।
এবং পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্ত শুরুতে সেতুর উভয় প্রান্তে বিস্তৃর্ণ সবুজ প্রান্তর, মাঝে ধান ক্ষেত সড়কের দুই পাশে নানা জাতের ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। আর সড়ক বিভাজকের ওপর লাগানো হয়েছে নানা জাতের ফুলের গাছ। সেখানে সারা বছরই ফুল ফোটে। শুধু ফলজ,বনজ,ঔষধি গাছ নয় এসব স্থানে রয়েছে নানা জাতের ফুল,নানা জাতের দেশি বিদেশি ফলের গাছ।
এই সড়কের পাশাপাশি পদ্মা সেতুর চারটি পুনর্বাসন কেন্দ্র, দুটি সার্ভিস এরিয়া, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও শেখ রাসেল সেনানিবাস এলাকায় বনায়ন করেছে শরীয়তপুর বন বিভাগ। পদ্মা সেতু প্রকল্প ও এক্সপ্রেস এলাকা বনায়ন প্রকল্পের আওতায় আম, জাম, কাঁঠাল, তেঁতুল, নারকেল, পেয়ারা, লিচু, সেগুন, জারুল, শিলকড়ই, রাজকড়ই, গামার, তেজপাতা, দারুচিনি, নিম, বহেড়া, অর্জুন, হরীতকী, বকুল, পলাশ, দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া, শিমুলসহ ৬১ ধরনের ফলদ, বনজ, ঔষধি গাছসহ বিভিন্ন ফুলের গাছ রয়েছে।
সরকারের ৫ টি সংস্থা পৃথক পৃথকভাবে পদ্মা সেতু ও রেল লাইনের পাশে,পদ্মা নদীর তীরে নির্মিত বাঁধের পাশে প্রায় বিভিন্ন প্রজাতির ১০ লক্ষাধিক গাছ রোপনের উদ্যোগ নিয়েছে। আসন্ন বর্ষা মৌসমে এসব সংস্থা সমূহের এই উদ্যোগ শতবাঘগ বাস্তবায়ন করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শে বাঙালির সহাস,গর্ব, সক্ষমতা,বিশে^ মর্যাদা বৃদ্ধির অনন্য বিষ্ময়ের প্রতীক পদ্মা সেতুকে ঘিরে ‘সবুজ বলয়’ সৃষ্টির এই উদ্যোগ গ্রহণ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা পার হওয়ার পরই চোখে পড়বে এসব ফুল-ফলের গাছ। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুর সময় লাগানো এসব গাছ এখন চারদিকে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। দেশের অন্য কোনো প্রকল্পে এত বনায়ন হয়নি। বনায়ন প্রকল্পের আওতায় দুই লক্ষাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে স্থানীয় ব্যক্তিদের রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই বনায়ন প্রকল্প।
২০০৭-০৮ সালে যখন পদ্মা সেতুর জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়, তখন এ এলাকা ছিল ফসলের জমি আর লোকালয়। জমি অধিগ্রহণের পরে নিচু জায়গা বালু দিয়ে ভরাট করা হয়। তারপর সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এরপর ২০১২-১৩ সাল থেকে এসব স্থানে বনায়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়।
খুলনা-ঢাকা সড়কের বাসচালক মোক্তার হোসেন বলেন, দেশের অনেক অঞ্চলের বিভিন্ন সড়কে গাড়ি চালিয়েছেন। পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া এমন সবুজে ঘেরা ও ফুলের সৌন্দর্যবর্ধিত সড়ক কোথাও পাননি তিনি। শরীয়তপুর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ১০ বছর ধরে নিয়মিত পরিচর্যা আর রক্ষণাবেক্ষণ করে গাছগুলো পরিপক্ষ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রেখেছে বন বিভাগ।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বনায়ন প্রকল্পটি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের (সেতু বিভাগের) সহকারী প্রকৌশলী পার্থ সারথি বিশ্বাস বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে বনায়ন করা হয়েছে। সেতু এলাকার সব অবকাঠামো ধরে বনায়ন করা হয়। বিভিন্ন প্রজাতির সবুজ গাছে ও বাহারি ফুলে এখন এলাকাটিতে অন্য রকম মুগ্ধতা সৃষ্টি করছে।
এখানে আসা মানুষ ক্ষণিকের জন্য প্রকৃতির অপার স্নিগ্ধতার পরশ পাবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প ঘিরে আশাশের এলাকায় সবুজায়নও এগিয়েছে সমান তালে। নদীর দুই পাড় ও এক্সপ্রেস ওয়ের দুই পাশে রোপণ করা হয়েছে লাখো গাছের চারা। কয়েক বছরে এসব চারা বড় হয়ে সবুজের আবহ তৈরি করেছে পুরো এলাকায়।
পদ্মা পারের জনপদ ছিল অনেকটা রুক্ষ। সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে নানা প্রকারের বনজ, ফলদ, ঔষধি আর সৌন্দর্যবর্ধক বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ । শরীয়তপুরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় বনায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সংযোগ সড়কের পাচ্চর থেকে টোলপ্লাজা পর্যন্ত রোপণ করা হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৫০টি বনজ ও সৌন্দর্যবর্ধক ফুলের গাছ। এই জেলার দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে রোপণ করা হয়েছে দু লক্ষাধিক ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ।
এছাড়া সার্ভিস এরিয়া, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড, শেখ রাসেল সেনানিবাসসহ প্রকল্প এলাকায় রোপণ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির আরও ৩ লাখ গাছের চারা। পদ্মা সেতু প্রকল্প ও এক্সপ্রেস এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বনায়ন প্রকল্পের আওতায় আম, জাম, কাঁঠাল, তেঁতুল, নারকেল, পেয়ারা, লিচু, সেগুন, জারুল, শিলকড়ই, রাজকড়ই, গামার, তেজপাতা, দারুচিনি, নিম, বহেড়া, অর্জুন, হরীতকী, বকুল, পলাশ, দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া, শিমুলসহ আরও বিপুল পরিমাণ ফলদ, বনজ, ঔষধি গাছসহ বিভিন্ন ফুলের গাছ রয়েছে।
ইতোমধ্যে সার্ভিস এরিয়া ও পুনর্বাসন (আরএস) এলাকায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণচূড়া, বকুল, কাঞ্চন, সোনালু, মহুয়া, বহেড়া, অর্জুন, পলাশ, শিমুলসহ অন্তত দেড় লাখ ফলদ ও ঔষধি গাছ। পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্তের মহাসড়কের দুই পাশজুড়েও দৃষ্টিনন্দন ফুল-ফলগাছ চোখে প্রশান্তি এনে দেয়।
‘পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পাচ্চর গোলচত্বর পর্যন্ত ছয় লেনের এক্সপ্রেস হাইওয়ের মাঝখানের অংশে নানা ধরনের গাছ রোপণ করা হয়েছে। ‘এর মধ্যে রয়েছে পাতাবাহার, মসুন্ডা, সোনালু, বোতল ব্রাশ, এরিকা পাম্প, উইপিং দেবদারু, রঙ্গনসহ বিভিন্ন ধরনের বাহারি ফুলের ছয় হাজারসহ ৫৬ প্রজাতির প্রায় দেড় লাখ গাছ।
বন বিভাগের কর্মীদের পরিচর্যা আর প্রকৃতির মহিমায় সড়কের ঢালে ফলদ ও বনজ গাছের চারাও বেড়ে উঠছে।’ ‘গাছ যেমন একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনে । অন্যদিকে মানুষের মনের খোরাকও মেটায়। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কে গেলে মনটা ভরে যায়। চোখ ধাঁধানো ফুলের সমারোহ। তবে রাস্তার ক্ষতি যেন না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। ছোটো ছোটো গাছ, ফুল ও হালকা ফলের গাছ থাকলে তেমন ক্ষতি হবে না, বরং এতে মন জুড়িয়ে যাবে।’
‘পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কের আইল্যান্ডে যে গাছ লাগানো হয়েছে, তা সত্যি অসাধারণ। মহাসড়কের এই ১০ কিলোমিটার পথে চলার সময় মনে হয় না বাংলাদেশে আছি। মহাসড়কের মাঝে আইল্যান্ডে ফুলের গাছ, দুই পাশে ফলের গাছ। এমন সৌন্দর্যময় প্রকৃতি দেশে আর কোথাও চোখে পড়েনি। তবে পরিচর্যার অভাবে অনেক স্থানে গাছ মরে গেছে।
‘পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ পদ্মা সেতুর দক্ষিণ শিবচর প্রান্তে বন বিভাগের মাধ্যমে গত দুই বছরে সবুজায়নের প্রকল্প হাতে নেয়। এরই অংশ হিসেবে ফুল, ফল ও ঔষধি গাছের চারা লাগানো হয়েছে। ইতোমধ্যে এটি পর্যটন এলাকায় পরিণত হয়েছে। ভ্রমণপিয়াসু দর্শণার্থীর ভিড় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
সড়ক ও জনপদ বিভাগের মাদারীপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সড়কের মাঝে ছোটো গাছ লাগালে তেমন ক্ষতি হয় না। ফুল ও ছোট ফল গাছের শাখা-প্রশাখা তেমন বাড়ে না। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের মাঝে প্রায় ১২ ফুট চওড়া জায়গা আছে, সেখানে কোন ধরনের গাছ লাগানো উচিত তা গবেষণা করেই বন বিভাগ লাগিয়েছে।’
আমাদের প্রত্যাশা পদ্মা সে ও রেল সংযোগকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই অপরুপ নয়ানাভিরাম দৃশ্য তথা প্রকৃতির আধাঁর‘‘ সবুজ বলয়’ রক্ষা ও সম্প্রসারণ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে। তাহলে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার এই মহতী উদ্যোগ স্থায়ী রুপ পাবে।
পিআইডি ফিচার।মোতাহার হোসেন: উপদেষ্টা সম্পাদক -দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য