-->
শিরোনাম

আদালতে পোশাকে কেন দুর্ভোগ আইনজীবীদের?

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
আদালতে পোশাকে কেন দুর্ভোগ আইনজীবীদের?

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতসংলগ্ন এলাকায় ১১ মে দুপুরে শফিউল আলম নামের একজন আইনজীবী মারা গেছেন। গরমে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে ওই আইনজীবীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা।

 

বলা বাহুল্য, ঢাকার নিম্ন আদালতের বেশিরভাগ এজলাসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) নেই। অথচ এ প্রচন্ড গরমের মধ্যেই কালো কোট ও গাউন পরে আইনজীবীদের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, যা অনেক কষ্টের। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের অন্যান্য জেলার আদালতের তুলনায় ঢাকার আদালতে বিচারপ্রার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক অনেক বেশি।

 

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের আদালত অঙ্গনগুলো বাহ্যিকভাবে নানা সমস্যায় জর্জরিত, যা বিচার বিভাগের কাজের গতিশীলতা হ্রাস করে। দেশের আদালত অঙ্গনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়- বিচারক সংকট, এজলাস সংকট, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, জরাজীর্ণ ভবন, বিশ্রামাগার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেটের অভাবসহ নানা সমস্যা। আর এসব সমস্যা মাথায় নিয়েই চলছে দেশের আদালত।

 

আদালতপাড়ায় বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান থাকার কারণে বিচারপ্রার্থীদের প্রতিনিয়ত পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। শিকার হতে হচ্ছে চরম বিড়ম্বনার।

 

অনেক সময় দেখা যায়, বিচারকদের একই এজলাস পালাক্রমে ব্যবহার করতে হয়। যেমন- দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে কোনো আদালত বেলা পৌনে ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত চলে। আবার ওই একই এজলাস বেলা ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ব্যবহৃত হয় অন্য আদালত হিসেবে।

 

ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রেও একই এজলাস পালাক্রমে অনেক সময় ব্যবহার করা হয়।

 

বিষয়টি এমন যে, একজন বিচারক এজলাস ছেড়ে দিলে তবেই আরেকজন বিচারক ওই এজলাসে বিচারকাজ পরিচালনা করেন। একই এজলাস দিনে দুবার দুই আদালতের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অনেককেই বিচারপ্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

 

কারণ, এজলাস সংকটের কারণে বিচারকরা তাদের পুরোটা সময় বিচারকাজ করতে পারছেন না। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বিচারকদের এজলাস ত্যাগ করতে হয় মামলা নিষ্পত্তি করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। গুরুত্বপূর্ণ মামলা রেখেই বিচারকদের এজলাস ত্যাগ করার ফলে বিচারপ্রার্থীরা সঠিক সময়ে বিচারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

 

তা ছাড়া বিচারপ্রার্থীদের আর্থিক ক্ষতিসহ সময়ের অপচয় তো রয়েছেই।

 

পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের ১৭১টি আদালতে এজলাস নেই, যা দুঃখজনক। আর এসব সমস্যা মোকাবিলা করেই সংশ্লিষ্ট বিচারককে মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে মাসিক প্রতিবেদন পাঠাতে হচ্ছে।

 

অনেক আদালতে চেয়ার-টেবিল সংকটের কারণে মামলার কার্যক্রম চলার সময় বিচারপ্রার্থীসহ আইনজীবীদেরও আদালতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ সময় ধরে। এক্ষেত্রে যদি কেউ বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী কিংবা অসুস্থ কোনো ব্যক্তি হন, তাহলে তাদের সমস্যার অন্ত থাকে না। আবার বৃষ্টির দিনে দেশের অনেক আদালতপাড়ায় বিচারক, বিচারপ্রার্থী, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।

 

কারণ, বিভিন্ন আদালতে যাওয়ার রাস্তায় পানি ও কাদা জমে থাকা। সঠিকভাবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষাকালে বা বৃষ্টির দিনে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া দেশের অনেক আদালত ভবন জরাজীর্ণ ও টিন শেডের। বৃষ্টির দিনে বা বর্ষাকালে এসব জরাজীর্ণ ভবনের ছাদ চুইয়ে কিংবা টিনের ফুটা দিয়ে পানি নিচে (আদালতের মধ্যে) পড়ার কারণে আদালত মুলতবি করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তা ছাড়া এ অবস্থার ফলে আদালতে সংরক্ষিত ফাইলপত্রও বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

 

অনেক সময় দেখা যায়, দেশের কোনো কোনো আদালতে নেই বিশ্রামাগার, নেই কোনো ট্রায়াল রুম এবং আদালতে আসা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের জন্য নেই কোনো রুম বা জায়গা। এসব সমস্যার ফলে আদালতের বিচার কার্যক্রম শুরুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত বিচারপ্রার্থীদের বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয়।

 

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় অসুস্থ ব্যক্তিদের এবং ব্রেস্ট ফিডিং করা মায়েদের। আদালতে বিশ্রামাগার না থাকার কারণে অসুস্থ বিচারপ্রার্থীদেরও দুর্ভোগের সীমা থাকে না। আবার আদালতের সামনে সাক্ষীদের ভালোভাবে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ট্রায়াল রুমের প্রয়োজন থাকলেও দেশের অনেক আদালতেই তা নেই। ফলে অনেক সময় আদালতের সামনে ভালো সাক্ষ্য না হওয়ায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়।

 

শুধু তা-ই নয়, অনেক আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি) জন্য বসার আলাদা চেম্বার থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এপিপিদের বসার জন্য আলাদা কোনো চেম্বার নেই, যা তাদের জন্য নিঃসন্দেহে মানসিক কষ্টের বিষয়।

 

দেশের অনেক আদালতেই নেই পর্যাপ্ত যানবাহন। প্রয়োজনীয়সংখ্যক যানবাহন না থাকায় অনেক সময় বিচারকদের একই গাড়িতে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে আদালতে যাওয়া-আসা করতে হয়, যা তাদের জন্য শারীরিক ও মানসিক কষ্টের বিষয়। যানবাহন সংকটের কারণে অনেক সময় অনেক বিচারক নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন।

 

কারণ, আদালতের কাজকর্ম শেষ করে অনেক বিচারক আদালতপাড়া থেকে জেলা শহরে তার বাসস্থানে যান। আর কোনো বিচারককে যদি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করতে হয়, তাহলে অবশ্যই তিনি নিরাপত্তাহীনতা বোধ করবেন।

 

কারণ, তার দেয়া মামলার রায়ে সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষ বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা তিনি হামলার শিকার হতে পারেন।

 

যানবাহন সংকটের পাশাপাশি বিচারকদের আবাসন সমস্যাও প্রকট। বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট বিচারকদের বাসস্থান নির্মাণের আদেশ দিলেও এখনো সব বিচারকের বাসস্থান সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক জেলায় কর্মরত সব বিচারকের জন্য যদি একই স্থানে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তাদের নিরাপত্তা ও যাতায়াত উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধা হবে।

 

‘সময় অত্যন্ত মূল্যবান’ এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, ‘অজ্ঞাত কারণে’ অনেক আদালত নির্ধারিত সময়ে বসে না। একজন আইনজীবীর প্রতিদিন বিভিন্ন আদালতে মামলা পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু আদালত ঠিক সময়ে না বসার কারণে আইনজীবীরা সঠিক সময়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা পরিচালনা করতে সক্ষম হন না। ফলে আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থীদের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়। আবার মামলাজট নিরসনের উপায় হিসেবে আদালতে সাক্ষী হাজির করতে দেশের অধিকাংশ আদালতে এখন পর্যন্ত চালু হয়নি ই-ডেস্ক।

 

আইন-আদালতসংশ্লিষ্ট সবাই জানেন, ফৌজদারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সাক্ষীদের যথাসময়ে আদালতে হাজির না করা। আর সাক্ষীদের হাজির করার বিষয়ে আদালত পুলিশের ওপর নির্ভরশীল।

 

পুলিশ সাক্ষী হাজির না করলে আদালতের শুনানির তারিখ পেছানো হয় এবং শুরু হয় মামলার দীর্ঘসূত্রতা। এ সমস্যার সমাধানে আদালতসমূহে ই-ডেস্ক চালু করা প্রয়োজন। ই-ডেস্ক থেকে আদালতের সংশ্লিষ্টরা নির্ধারিত তারিখের আগে সাক্ষীর সঙ্গে যোগাযোগপূর্বক আদালতে তার হাজির হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন।

 

এক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইন সংশোধনপূর্বক এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যেন পুলিশ আদালতে চার্জশিট দেয়ার সময় সাক্ষীর মোবাইল-টেলিফোন নম্বরসহ পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা উল্লেখ করতে বাধ্য হয়।

 

উপরোক্ত সমস্যাগুলো ছাড়াও দেশের প্রায় প্রতিটি আদালত অঙ্গনে যেসব অভিযোগ ও সমস্যা প্রতিনিয়তই শোনা যায়, তার মধ্যে রয়েছে আদালতসংশ্লিষ্ট অনেক পিয়ন-পেশকার কর্তৃক উপঢৌকন (ঘুস) নেয়া। অভিযোগ রয়েছে, আদালতের বেশিরভাগ পিয়ন-পেশকার, জারিকারক ঘুস ছাড়া কোনো কাজই ঠিকমতো করতে চান না। যেন এটি একটি অলিখিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে! অনেক সময় বিচারপ্রার্থীরা অভিযোগ করেন, পিয়ন-পেশকারদের কাছে বিচারপ্রার্থীরা মামলাসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য নিতে গেলে বা কোনো সহযোগিতা চাইতে গেলে তারা ঘুস ছাড়া কোনো কাজই করতে চান না।

 

ফলে বাধ্য হয়েই ঘুস দিতে হয়। দুদক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এসব পিয়ন, পেশকার ও জারিকারকদের জমিজমা, বাড়ি, সম্পদ ও টাকা-পয়সার হিসাব সঠিকভাবে নিলে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলবে বলে আশা করা যায়।

 

এ ছাড়া আদালত অঙ্গনে রয়েছে টাউট-দালালদের দৌরাত্ম্য। আইনজীবী না হয়েও কালো কোট, টাই ও গাউন পরে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে আসা বিচারপ্রার্থী সহজ-সরল ব্যক্তিদের নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে ‘মক্কেল সংগ্রহ’ করা হয়। অন্যান্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে-মানসম্মত খাবারের হোটেলের অভাব, প্রয়োজনীয়সংখ্যক ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেটের অভাব; বার ও বেঞ্চের দূরত্ব বিদ্যমান থাকা; বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) উদ্যোগ কম থাকা ইত্যাদি।

 

বিচার বিভাগের কাজকে গতিশীল করাসহ সঠিক সময়ে জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতে দেশের আদালত অঙ্গনে বিরাজমান সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তা দূর করার কোনো বিকল্প নেই।

 

এক্ষেত্রে সরকার তথা আইন মন্ত্রণালয়, বিচারক, আইনজীবী, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, আদালত হচ্ছে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল; শেষ আশা-ভরসার জায়গা। তাই আদালত অঙ্গনে নানা ধরনের সমস্যা বিদ্যমান রেখে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

 

লেকখ : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ভিজিটিং প্রফেসর, চন্ডীগড় ইউনিভার্সিটি (পাঞ্জাব, ভারত)

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version