নানা দ্বন্দ্ব -সংঘাত বৈষম্যের বাইরে আমাদের সম্প্রীতির জগৎটি কিন্তু ক্ষুদ্র নয়। অনেক বিশাল ও বিস্তৃত। যেমন ইতিহাসে, তেমনি আমাদের সামাজিক জীবনে। সম্প্রদায়গত বিভেদ-বিভাজন ইংরেজদের উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্ট এবং ঔপনিবেশিক শাসনামলে সমাজ-জীবনে বিস্তার ঘটিয়েছিল, ভাগ করো এবং শোষণ করোর নীতির বাতাবরণে।
তাদের ইন্ধনেই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে প্রথম আঘাত এসেছিল। যার ধারাবাহিকতা আজো অব্যাহত রয়েছে কতিপয় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর। সে কারণেই সাম্প্রদায়িক সংঘাত-দাঙ্গা আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি, যেমন দেশে, তেমনি ভারতে। অথচ ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে উপমহাদেশজুড়ে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন ছিল।
রক্তাক্ত দেশভাগের সময় কলকাতার দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী আমার প্রয়াত পিতার কাছে জেনেছিলাম, কলকাতার দাঙ্গায় বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় অংশ নেয়নি। তারা একে অপরকে রক্ষায় তৎপর ছিল। বাঙালিদের সম্প্রীতি অটুট থাকলেও হিন্দুদের পক্ষে পাঞ্জাবি শিখরা এবং মুসলমানদের পক্ষে বিহারি মুসলমানরা দাঙ্গা করেছিল। অথচ দাঙ্গা না করেও নিরীহ বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছিল সে সময়।
পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা হয়েছিল একতরফা-একপেশে। প্রতিপক্ষ হিন্দু সম্প্রদায় দাঙ্গা আঁচ করে বিনা প্রতিরোধে দেশত্যাগী হয়েছিল। তাই এখানে দাঙ্গা মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫০-এর দাঙ্গার মূলে ছিল বিহার থেকে পূর্ব বাংলায় আগত বিহারিরা। যারা দাঙ্গায় ছিল পারদর্শী আর তাদের পক্ষে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীন লীগ সরকারও।
সে কারণে তারা এ দেশের বাঙালি মুসলমানদের ওপরও বেপরোয়া কর্তৃত্ব বিস্তার করতে পেরেছিল। চট্টগ্রামের ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের মহানায়ক সূর্যসেনের কাকা গৌরমণি সেন, যিনি পিতৃহারা সূর্যসেন এবং তার পুরো পরিবারকে প্রতিপালন করেছিলেন। সেই গৌরমণি সেনের এক পুত্রকে পঞ্চাশের দাঙ্গায় প্রাণ দিতে হয়েছিল চট্টগ্রামে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন সূর্যসেন।
ব্রিটিশ শাসক সূর্যসেনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী সূর্যসেনের খুড়তুতো ভাইকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ব্রিটিশমুক্ত স্বাধীন (!) স্বদেশে। কী নিষ্ঠুর-নির্লজ্জ দেশভাগের পরিণতি! এরপরই সূর্যসেনের পুরো পরিবার দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়।
১৯৭১-এ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরে আসেনি। দেশবাসী পায়নি কাক্সিক্ষত মুক্তিও। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে তার সব অর্জন একে একে খুইয়েছে। গণতন্ত্র হয়েছে কেবলই ভোটের তন্ত্র। মানুষের অধিকার ও সুযোগের গণতন্ত্রের নাগাল আমরা আজো পাইনি। সমাজতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে সংবিধান থেকে।
ধর্মনিরপেক্ষতা পাল্টে এসেছে রাষ্ট্রধর্ম। সামরিক শাসকের সেই সনদটি নির্বাচিত সরকারগুলোও সংবিধানে অটুট রেখেছে। জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে। সবই ঘটেছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই। অতীতের দ্বিজাতিতত্ত্বে ফিরে যাওয়ার নমুনা হিসেবেই একে একে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হরণ করা হয়েছে।
অধিক শক্তিমত্তায় ফিরে এসেছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। অবৈধ সামরিক শাসকরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে ধর্মকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের বেপরোয়া অপকীর্তির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে বিরোধিতা করলেও, মূলধারার দক্ষিণপন্থিরা নানা উছিলায় মৌলবাদীদের সমীহ করে এসেছে। আমাদের দেশে মৌলবাদীদের উত্থানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার তল্পিবাহক মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোর ভ‚মিকা স্পষ্ট।
বিশ্বজুড়ে মুসলিম মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও আমাদের দেশের মৌলবাদীদের আশকারা দিয়ে আসছে, করছে সমর্থনও। এমনকি আমাদের দেশকে উদার ইসলামী হিসেবেও অভিহিত করেছিল। বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের বিকাশ রুখতেই ডানদের সঙ্গে মৌলবাদীদের ঐকমত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দক্ষিণপন্থিরা রাষ্ট্রক্ষমতা লাভে নিয়ামক-নির্ণায়ক রূপে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক দলগুলোকেই বিবেচনা করে থাকে।
কতিপয় বিচ্যুত-বিভ্রান্ত বাম দল ডানের সঙ্গে ঐক্যমোর্চার বাতাবরণে ডানদের ঘনিষ্ঠ নৈকট্য লাভে তৎপর অথচ ডানদের কাছে তাদের মর্যাদা-গ্রহণযোগ্যতা ততটা নয়, যতটা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক দলগুলোর। ভোটের রাজনীতিতে নীতি আদর্শের কোনো বালাই নেই। ক্ষমতায় যাওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ডানপন্থি দলগুলোর আদর্শিক শত্রু মৌলবাদীরা নয়, বরং বামপন্থিরাই। যেটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
প্রকৃত বামদের যেমন লড়তে হচ্ছে মৌলবাদের বিরুদ্ধে তেমনি একইভাবে বুর্জোয়া ‘রাজতান্ত্রিক’ দলগুলোর বিরুদ্ধেও। এরা কেউ যে তাদের মিত্র নয় এই সত্যটি তারা বুঝলেও সুবিধাবাদিতার লোভে-মোহে অনেকে আত্মসমর্পণ করে বাম আন্দোলনের ক্ষতিসাধন করে চলেছে। বামেরা ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র স্বার্থে বহু খন্ডে খন্ডিত হওয়ার কারণে নিজেদের মধ্যে যেমন বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে, একইভাবে হয়ে পড়েছে জনবিচ্ছিন্নও। যার সুযোগ নিয়েছে ডানপন্থি ও উগ্র মৌলবাদীরা।
হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভেদ-বিভাজনের আদলে মস্কো ও পিকিংপন্থিদের বিভেদ-বিভাজন আজো লক্ষ্য করা যায়। অথচ এই দেশ দুটি যে এখন আর সমাজতান্ত্রিক নয়, এই বাস্তবতায়ও অনেকের বোধোদয় হয়নি। তারা অনেকে অতীতের ন্যায় পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রু ভাবাপন্ন আচরণ এখনো করে থাকেন। মস্কো ও পিকিং পন্থার পরস্পরের বিরোধ-বিরোধিতা তীব্র ও ভয়াবহ ছিল বলেই তার রেশ আজো কাটেনি। এই বিরোধের জেরে অসম্মান-অমর্যাদাকর কটূক্তি থেকে বাদ পড়েননি তাদের দুই নেতাও।
মওলানা ভাসানীকে টুপিধারী ইসলামী সমাজতন্ত্রী এবং মণি সিংহকে রুশ-ভারতের দালাল বলতে বাধেনি। অথচ তাদের ত্যাগ, আদর্শ, দেশপ্রেম, প্রজ্ঞা এবং অবদানে এই জাতি ঋদ্ধ হয়েছে, হয়েছে ঋণীও। তাদের অবদান চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। পিকিং-মস্কো পন্থার বিভাজনে সমাজতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম পূর্ণতা পায়নি।
জাতীয় মুক্তির পরিবর্তে শ্রেণি সংগ্রামকে তৎকালে প্রধান অবলম্বন করার ফলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব চলে যায় দক্ষিণপন্থার উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাতে। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রক্ষমতাও রয়ে যায় জাতীয়তাবাদীদের দখলে। স্বাধীন দেশে শক্তিশালী বিরোধীদলীয় ভূমিকার বিপরীতে মস্কোপন্থিরা বিলীন হয়ে যায় আওয়ামী লীগে।
অপরদিকে চীনপন্থিরা গোপন রাজনীতির বৃত্তে আটকে পড়ার ফলে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি। এমনকি সামরিক শাসনের আগমনে পিকিংপন্থিদের বড় অংশ সদলবলে মওলানা ভাসানীকে ত্যাগ করে, একা ফেলে, গাঁটছড়া বাঁধে অবৈধ সামরিক শাসকের সঙ্গে। এর বিপরীতে বামদের ক্ষুদ্র অংশ নীতি-আদর্শ আঁকড়ে অবিচল থাকলেও নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য, বিভেদ, বিভক্তি এবং বিভ্রান্তিতে অসংগঠিত হয়ে পড়ে।
যার মোক্ষম সুযোগে মৌলবাদী ও দক্ষিণপন্থিরা দেশের মূলধারার প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। এদের হাত ধরেই সাম্রাজ্যবাদের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা স্থায়ী হয়েছে বাংলাদেশে; যে ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার পরিপন্থি।
মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সংঘটিত হলেও রাষ্ট্র ও শাসক দলগুলো তাদের প্রতিরোধ করেনি। ক্ষেত্রবিশেষ আশকারা দিয়ে এসেছে। দক্ষিণপন্থার দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার মোহে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের সঙ্গে নিয়মিত আপস করে চলেছে। মুসলিম মৌলবাদীদের আদলে দেশে সংখ্যালঘুদের জোট গঠিত হয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। বাদ পড়ে মুসলিম।
এই পরিষদে যদি মুসলিম সম্প্রদায় যুক্ত থাকত তবে এই সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি পেত দ্রুত। সব জাতিসত্তা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রের সব অধিকার, সুযোগ ও মর্যাদা প্রাপ্তি সাংবিধানিক এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার অন্তর্গত। সে অধিকার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিক দাবি সব দেশপ্রেমিক মানুষের।
সেজন্য সম্প্রদায়গত জোট গঠন মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা দিয়ে। সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এই জোট গঠন শুভবার্তা বহন করে না। ঐক্য পরিষদের প্রথম সারির অনেকে শাসক দলে সম্পৃক্ত এবং সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতেও। তাদের সম্প্রদায়গত ঐক্য পরিষদ দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে তেমন আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
দক্ষিণপন্থি দলগুলোর ঢালাও প্রচারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কথা প্রচারিত হলেও তাদের হাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একে একে বিনাশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই আমরা সমতা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যরে বাংলাদেশ অর্জন করতে পারব। যেটা মূলধারার দক্ষিণপন্থার কোনো দলের কাছে আশা করা দূরাশামাত্র। জনগণের রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই অর্জিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ। যা অর্জনে আমাদের আরো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। প্রয়োজন হবে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের অর্থাৎ সমাজ বিপ্লবের।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য