-->

কতটা স্বচ্ছ রাজনীতির অন্দরমহল?

সুধীর সাহা
কতটা স্বচ্ছ রাজনীতির অন্দরমহল?

বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে উল্লেখ থাকলেও নির্বাচনের অন্যতম অঙ্গ রাজনৈতিক দল নিয়ে কিন্তু একটি কথাও উল্লেখ নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অন্দরমহল কি কেউ কখনো একটু ঘুরে এসেছেন? তা করলে কিন্তু আমি নিশ্চিত, সেখানে অনেক বিস্ময়কর তথ্য উদ্ধার করা যেত।

 

বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানে একমত্র রাজনৈতিক দলই এমন এক প্রতিষ্ঠান, যার কোনো স্বতন্ত্র অডিট হয় না। রাজনৈতিক দলের অডিট কে করবে, কীভাবে করবে কিংবা কখন করবে- সে সম্পর্কে কোনো আইন বা নির্দেশিকা নেই। তাই অধিকাংশ দলেরই কোনো অডিট হয় না। কারো যদি হয়ও, তাও হয় নিজেদের কর্মীদের দিয়েই এবং কোনো দলকেই অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করতে হয় না।

 

এমনকি নিজ দলের কোনো সদস্যই কখনো কোনো দলেরই অডিট রিপোর্ট দেখতে পায় না। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি, লাভদায়ক বা অলাভদায়ক বড় সংস্থার অডিট করে স্বীকৃতি অডিট সংস্থা এবং সেসব অডিট রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশিত হতে কোনো বাধা থাকে না। একমাত্র ব্যতিক্রম রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল অন্তহীন দেশি কিংবা বিদেশি টাকা নিতে পারে শুধু তাই নয়; কোথা থেকে সে টাকা এলো, কে দিল তা কাউকে জানাবার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই রাজনৈতিক দলগুলোর।

 

দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, তা নিয়ে অনেকে চিন্তা-ভাবনা করলেও রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংগঠিত গণতন্ত্রের বালাই আছে কিনা তা নিয়ে কখনো মুখ খোলে না। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দলে নির্বাচন বা মনোনয়নের কোনো রেওয়াজ নেই। প্রায় সব দলেরই প্রার্থী ঠিক হয় নেতাদের বিশেষ করে শীর্ষ নেতার বদান্যতায়। একজন যা চাইবেন, যেভাবে চাইবেন- অন্য সবাই হাত তুলে তাতেই বাহবা বাহবা করবেন।

 

এই প্রশ্ন কখনো আলোচিত হয়নি, সাধারণ মানুষ যারা রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটার, তারা রাজনৈতিক দলের কাছে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে তথ্য চাইতে পারে কিনা? বাংলাদেশে এ নিয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামায়নি। ভারতে ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন অবশ্য রায় দিয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলো তথ্য জানার অধিকারের আইনের আওতায় পড়ে।

 

সে রায় অবশ্য ভারতে কোনো দলই কখনো মানেনি। বরং সেই তথ্য কমিশনই ২০১৯ সালে রায় দেয়, রাজনৈতিক দলের অর্থ-সংক্রান্ত তথ্য জনতার জানার অধিকার নেই।

 

আগামী ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের প্রত্যাশা এ সংসদ নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে কাজটি খুব সহজ নয়। কিন্তু তারপরও উন্নয়ন সহযোগীরা আশাবাদী। প্রয়োজনে সরকারকে ছাড় দিয়ে হলেও বিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জনের পরামর্শ দিয়েছে তারা।

 

সরকারি দল নানাভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউকে আহব্বান জানিয়েছে, বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে সাহায্য করতে। বিরোধী দল বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। সরকারি দল বর্তমান সরকারের আইনেই নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর।

 

ইতোমধ্যে নির্বাচনী কৌশল এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকার জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে।

 

এর বাইরে একই বিষয় নিয়ে বৈঠক হয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ইইউভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদের। নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে নীতিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে। আমাদের দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক কোলাহল-বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই রয়েছে। এগুলো এমন বিষয়, যার ওপর আমাদের তেমন কোনো হাত থাকে না।

 

এগুলো মূলত রাজনৈতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া সামাজিক অবস্থান। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, এগুলোতে আমাদের কোনো হাত নেই; কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ এগুলোতে ভুক্তভোগী। আমরা যে অবিচ্ছেদ্য বা হস্তান্তর অযোগ্য অধিকার নিয়ে জন্মেচ্ছি বলে বিশ্বাস করি যেমন শরীরের অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, কথা বলা ও লেখার অধিকার, পছন্দের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার অধিকার, পছন্দের মানুষকে ভোট প্রদানের অধিকার- এসব অধিকার রাষ্ট্র সংবিধানের মাধ্যমে মেনে নিলেও সেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলো সে কাজটি করছে কিনা, তা রাষ্ট্র দেখে নিতে পারছে না।

 

নাগরিকদের সম্মিলিত কণ্ঠই রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের দ্বারা গৃহীত একটি সনদই রাষ্ট্রের সংবিধান। কিন্তু সেই রাষ্ট্র এবং সংবিধান নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না শুধু সঠিক রাজনৈতিক কালচারের অভাবে। এটাই রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। কিন্তু সে ব্যর্থতার জন্য তাদের মধ্যে কোনো গ্লানি নেই, ভ্রুক্ষেপ নেই।

 

তৃতীয় বিশ্বে জোট-রাজনীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে সেই সত্তর দশক থেকেই। প্রায় প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগেই আমরা ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’-এর কথা শুনি। কোনো একটা ভোটের দামামা বাজলেই দেশসুদ্ধ সবাই ‘বিরোধী ঐক্য’ হলো কিনা, তা নিয়ে মাথা ঘামায়। বিরোধী ঐক্য না হলে বিরোধীরা অস্বস্তি প্রকাশ করে, শাসক দল বিরোধীদের ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না। যেন ভোটের বাজারে বিরোধীরা একাট্টা হয়ে শাসকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এটাই দস্তুর।

 

এমন রাজনীতির গ.সা.গু হলো প্রধানত শাসকের বিরোধিতা। নীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ কিছুই তখন আর সামনে আসে না। ভোটাররা শুধু এর জন্যই উজাড় করে ভোট দেয় বলে মনে হয় না, যদি না কোনো কারণে শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের সলতেটা প্রস্তুত থাকে। শাসক দলের নেতারা অবশ্য অন্য তালে থাকেন। মসজিদ বা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন নেতা- হাতটা নেতার ঢঙে, আকাশের দিকে তোলা। ছবি উঠছে পটাপট।

 

সরকারি এবং সরকারের পছন্দের এজেন্সির ফটোগ্রাফাররা দাঁড়িয়ে পড়েছে নামিদামি ক্যামেরা হাতে। স্পট বদলাল। এবার পেছনে ছোট্টমনিদের স্কুল। ক্লিক, ক্লিক। আবার স্পট বদল। এবার পেছনে না খাওয়া মানুষের লাইন। খাবার প্যাকেট হাতে নেতা- খাবার নিতে ব্যস্ত গরিব মানুষের ঢল। লাইন ধরে কর্মীর মোটরসাইকেল। ক্লিক, ক্লিক। দিনের আলোতে কিংবা প্রদীপের আলো-আঁধারিতে জ্বলজ্বল করছে আমাদের নেতারা। ছবি উঠছে লাগাতার। এখানে রাজনীতির প্যাকেজই শেষ কথা। মানুষের জন্য কাজ কতটা হলো, ভোটার কী চাইছে- দেখার সময় নেই শাসক দল এবং বিরোধী দলের নেতাদের।

 

সেসব ছিল পুরনো ফ্যাশন। এখন নতুন নিয়ম। মোড়কটা চাই ঝাঁ-চকচকে। ভেতর ফাঁপা হলেও মানুষ তা দেখতে পাচ্ছে না। অল্প করে কাউকে রোজ মাদক সেবন করালে ধীরে ধীরে তার শরীর আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক কাজ করে না; সব সময় যেন একটা ঘোরের মধ্যে অবস্থান। আমাদের এখন কতকটা সে রকম অবস্থা! এই নতুন রাজনীতির মায়াজালে আমরা যেন আটকে পড়েছি।

 

রাজনীতির চাটুকারিতার বাজার কিংবা বস্তুগুণ দিয়েই আজকের লেখাটা শেষ করব। ধরা যাক, একটি বড় রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ধরা যাক, কোনো এক পদে তিনজন সদস্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রথম প্রার্থী রাজনৈতিকভাবে প্রতিভাধর। তার জনমত গঠন করার ক্ষমতা আছে। দ্বিতীয়জনের প্রতিভা মাঝারি মানের এবং তার ক্ষমতা সীমিত।

 

তৃতীয়জনের রাজনৈতিক প্রতিভা নেই বললেই চলে। এই শেষেরজন নিজের স্বার্থেই দলের নেতাকে সর্বদা খুশি রাখার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি জানেন যে, প্রতিযোগিতামূলক চাটুকারিতায় তিনি হয়তো পেরে উঠবেন না; কিন্তু চেষ্টা করতে বাধা নেই। তাই তিনিও নেতাকে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। তার যেটুকু প্রতিভা ছিল, সেটুকু জলাঞ্জলি দিয়ে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে তিনিও চেষ্টা করেন নেতার কৃপা পাওয়ার। প্রথমজন জানেন, নেতা তাকে কোনোদিনই ক্ষমতার কাছাকাছি আনবেন না। কারণ তিনি নেতার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাহীনতার কারণ।

 

নিশ্চিতভাবে জেনে নিন, সর্বময় নেতা ওই নিম্ন প্রতিভার সেই ব্যক্তিকেই কৃপা দেখাবেন।

লেখক : কলামিস্ট।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version