-->
শিরোনাম

ভারতের আসন্ন লোকসভা ও কর্নাটকের ভোট

গৌতম রায়
ভারতের আসন্ন লোকসভা ও কর্নাটকের ভোট

কর্নাটকের ভোট ঘিরে অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটেছে। কেন্দ্রের শাসক বিজেপি অর্থ-প্রশাসন, সবকিছুকে কাজে লাগিয়েই একদা যে পেছনের দরজা দিয়ে নিজেদের দলকে কর্নাটকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, ভোটদাতাদের স্পষ্ট কংগ্রেসের প্রতি আস্থা জ্ঞাপনের পরে সেই পেছনের দরজার সব ছিটকিনিতেই আগল পড়েছে। পাঁচ বছর আগে, কর্নাটক বিধানসভার ভোটে জিতেছিল কংগ্রেস। মানুষের সেই রায়কে টাকার জোরে বদলে দিয়ে তিন বছরের ভেতরেই সেখানকার রাজ্যপাটে বসে পড়ে বিজেপি।

 

২০২৩ সালের ১০ মে’র ভোটে মানুষের রায়কে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টার ত্রুটি বিজেপি শিবিরের পক্ষ থেকে কম করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদি থেকে শুরু করে দোর্দন্ড প্রতাপশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সংঘের তাবড় তাবড় নেতারা যেভাবে সেখানে ভোটের প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন, অত্যন্ত কৌশলী দৃষ্টিতে তৈরি সাম্প্রদায়িক ফিল্ম, দি কেরল স্টোরির প্রচার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী করেছেন, সাম্প্রদায়িক এবং জাতপাতের বিভাজনের সবরকম চেষ্টা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের পক্ষ থেকে করা হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে কর্নাটকের মানুষদের বিজেপির বিরুদ্ধে, কংগ্রেসের পক্ষে এই সুস্পষ্ট রায়দান কেবল বিন্ধ্য পর্বতের অপরপ্রান্তের রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, আগামী লোকসভা ভোটের (২০২৪) প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে।

 

ভারতে লোকসভা ভোটের আর মাত্র বছর খানেক দেরি। কেন্দ্রের শাসক বিজেপির মূল মস্তিস্ক আরএসএসের শতবর্ষ পূর্তি আগামী ২০২৫ সালে। তাই আগামী লোকসভা ভোটে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে এককভাবে গরিষ্ঠ করে আবার ভারতের শাসনপাটে বসানোটা সংঘের কাছে এখন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুসলমান মুক্ত ভারত গঠনের লক্ষ্যে মোদি সরকারকে দিয়ে একের পর এক যে কর্মসূচি আরএসএস নেওয়াচ্ছে, সেই কর্মসূচির চূড়ান্ত রূপ, রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রে ভারতকে রূপান্তরিত করাই এখন একমাত্র টার্গেট আরএসএসের।

 

আর রাজনৈতিক হিন্দু ভারত যদি একবার ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে, ভারতের সংবিধানের খোলনলচে বদলে দিতে পারে, তবে সংঘের বহুকাক্সিক্ষত হিটলারীয় পথে তারা ভারতকে পরিচালিত করতে পারবে। অর্থাৎ হিটলারের ইহুদি নিধনের আদলে, চোরাগোপ্তাভাবে বা কখনো রাষ্ট্রীয় মদদে এখন যেভাবে মুসলমানদের হয় প্রাণে, নয়তো বা ভাতে মারছে হিন্দুত্ববাদীরা, সেই কাজটা তখন তারা সংবিধানগতভাবেই করবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাওয়া ক্ষমতাকে, গণতন্ত্রের খোলনলচে একদম বদলে দিয়ে চিরস্থায়ী করে ফেলবে।

 

হিটলার, মুসোলিনীর আদলে রাজনৈতিক ধ্যানধারণাতে বিশ্বাসী আরএসএসের কাছে ‘বহুত্ববাদী’ ধারণার কোনো জায়গা নেই। ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও যেমন বহুত্ববাদী ধারণাকে তারা স্বীকার করে না, ঠিক সেরকমভাবেই রাজনীতির ক্ষেত্রেও, একাধিক রাজনৈতিক দলের ধারণা তেষতাদের বিশ্বাস নেই। আস্থা তো নেই-ই। সার্বিকভাবে ফ্যাসিবাদের নামান্তর হিসেবে হিন্দুত্ববাদ বিকাশ লাভ করেছে। তাই একক গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি ২০১৪ সালে ভারতের শাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ওদের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ধারণায় বিশ্বাসী বা সেই ধারণাকে প্রসারিত করার ধারণায় আস্থাবান, তার বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল ভারতে রাজনীতি করুক, রাজনৈতিকভাবে বিকশিত হোক এটা আরএসএস কখনোই চায় না। আর কমিউনিস্টদের সম্পর্কে ওদের ধারণা হিটলার-মুসোলিনীর কমিউনিস্টদের সঙ্গে ধারণা থেকে এতটুকু আলাদা নয়।

 

উত্তর ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি নিজেদের ভিতটা যতখানি পোক্ত করতে পেরেছে তাদের দীর্ঘদিনের নানা রকমের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচির দ্বারা, সেই কাজটা বিন্ধ্য পর্বতের অপরপ্রান্তে কখনোই তারা সেভাবে করে উঠতে পারেনি।

 

উত্তর ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি নিজেদের ভিতটা যতখানি পোক্ত করতে পেরেছে তাদের দীর্ঘদিনের নানা রকমের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচির দ্বারা, সেই কাজটা বিন্ধ্য পর্বতের অপরপ্রান্তে কখনোই তারা সেভাবে করে উঠতে পারেনি। ’৪৭-এর দেশভাগের পূর্ববর্তী সময় থেকে উত্তর ভারতে বিভাজনের রাজনীতিটা জোরদারভাবে করে চলেছে হিন্দুত্ববাদীরা।

 

তার রাজনৈতিক ফসল আরএসএসের বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নানারকমভাবে তুলেছে; কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী সময় থেকে ধীরে ধীরে যে মেরুকরণের রাজনীতিকে গোটা ভারতে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে, এই কাজে তারা উত্তর ভারতে যেভাবে সফল হয়েছে, সেই সাফল্য কখনোই তাদের দক্ষিণ ভারতে আসেনি।

 

হিন্দুত্বের রাজনীতি দক্ষিণ ভারতে সেভাবে সাফল্য আনতে পারছে না দেখে বাজপেয়ির আমলে দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার পথে হেঁটেছিল আরএসএস। সেই সময়ে জয়ললিতার দলের সঙ্গে বিজেপির যে সম্পর্কের চড়াই উতরাই, তা ভোট রাজনীতিতে বিজেপিকে বিশেষ সাফল্য দেয়নি, কিন্তু সেই সম্পর্ক আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলোকে প্রথমে তামিলনাড়–তে, পরে সেখান থেকে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, তাদের সামাজিক কর্মসূচির আড়ালে সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি এবং কর্মকান্ডের বিস্তার ঘটিয়ে মেরুকরণের রাজনীতির পথটাকে অনেকখানি মসৃণ করে দিয়েছিল।

 

সেই পথে হাঁটেননি মোদি। আরএসএসের যে বিরোধীশূন্য রাজনীতির পথে হাঁটার তাগিদ, সেই পথে হেঁটে নিজেদের একমাত্র তাত্ত্বিক বন্ধু শিবসেনার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি করেছেন মোদি-শাহ জুটি। শিবসেনার বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে বিজেপির সংঘাতের যেসব হাতে গরম খবর নানা সংবাদমাধ্যমে বেরোচ্ছে, সেগুলোর প্রকৃত বাস্তবতা ঘিরে আমি সন্দিহান। কারণ আরএসএসের উগ্র হিন্দু সা¤প্রদায়িক, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, চরম মুসলমান বিদ্বেষী নীতি ও কর্মসূচির সঙ্গে শিবসেনার সর্বস্তরের সংগঠনগুলোর আশ্চর্যজনক মিল।

 

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কালে, যখন মমতা, জয়ললিতা, নবীন পট্টনায়ক, চন্দ্রবাবু নাইডু, অসম গণপরিষদ ইত্যাদিকে এক ছাতার তলায় আনতে পারেনি আরএসএস, তখনো কিন্তু সংঘ রাজনীতির যাবতীয় নাশকতার কেবল উগ্র সমর্থকই নয়, সেই কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে একদম প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল শিবসেনা।

 

বিরোধী মুক্ত ভারত তৈরির যে ফ্যাসিবাদী মানসিকতা নিয়ে গত ১২ বছর ধরে আরএসএস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির বকলমে ভারত শাসন করছে, সেখানে তাদের আক্রমণের মূল টার্গেট হলো কমিউনিস্টরা এবং কংগ্রেস দল। গোটা ভারতে কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক শক্তি সব জায়গায় না থাকলেও কমিউনিস্টদের মতাদর্শগত দিকটাই হিন্দুত্ববাদীদের সবথেকে বড় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। কমিউনিস্টদের শ্রেণিচেতনা, বিজ্ঞানমনষ্কতা, ধর্মনিরপেক্ষতা যেভাবে দেশের সর্বত্র আধুনিক মানসিকতার মানুষ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ মানবিকী বিদ্যার আধুনিক ধারাতে চর্চা করা মানুষদের চেতনার জগতে ক্রিয়াশীল থাকে, সেটাই সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের সব থেকে অপছন্দের বিষয়।

 

এই চেতনাই হিন্দুত্ববাদীদের কাছে বহুত্ববাদী ভারতকে ধ্বংস করে এই দেশকে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করবার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরা যেখানে বামপন্থিরা বেশি শক্তি ধরে, সেসব রাজ্যে সন্ত্রাসী হিন্দুত্বের প্রয়োগে বেশি তৎপর আরএসএস।

 

আর এ কাজে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরাতে আরএসএস-বিজেপির সব থেকে বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য বন্ধুর ভ‚মিকা পালন করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর তার দল তৃণমূল কংগ্রেস।

 

লেখক : সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version