বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের পরবকে ম্রোরা বলে চানক্রান। চৈত্র-বৈশাখে যখন বিজু, বিষু, সংক্রান্তি, সাংগ্রাই, নববর্ষ, হংঅরানী কিংবা বৈসুক হয় তখনই ম্রো গ্রামে আয়োজিত হয় চানক্রান। শালফুল ফুটলে যেমন সাঁওতালসমাজ বাহা পরব আয়োজন করে, ক্লো-প্লাও ফুটলে ম্রোরা আয়োজন করে চানক্রান। চানক্রানের আগে ম্রো ছেলেমেয়েরা পাহাড় জংগল থেকে ক্লো-পাও ফুল সংগ্রহ করে।
কিন্তু এই ফুল সংগ্রহে আপন ভাইবোনের একসঙ্গে যেতে মানা। এ নিয়ে আছে এক ম্রো আখান। বহু আগে এক পাহাড়ি ম্রো গ্রামে এক জুমিয়া ম্রো পরিবারে দুই বোন-ভাই ছিল। তারা একসঙ্গে পাহাড়ে জুম আবাদ করত। একবার রিনায় (কলেরা মহামারি) তাদের মা-বাবা মারা যায়। এতিম ভাইবোন তখন নিজেরাই জুম আবাদ শুরু করে।
এক সকালে বোন ক্লোবং জুম পাহারা দিতে পাহাড়ে গেল গাছের তলায় কোলে বাচ্চা নিয়ে এক উইমোকমা (রাক্ষস) ক্লোবংকে ভয় দেখাল। ঘরে ফিরে ক্লোবং ভাইকে বলল। ভাই তখন দা ধার করে রাক্ষস মারতে পাহাড়ে গেল। গিয়ে দেখে সারা গায়ে পশমওয়ালা ডিমের মতো চোখের এক রাক্ষস বসে আছে। রাক্ষস ভাইকে ভয় দেখাল। রাক্ষসকে বিয়ে না করলে সে ক্লোবংকে মেরে ফেলবে। বাধ্য হয়ে রাক্ষসকে বিয়ে করে ভাই বাড়ি নিয়ে এলো।
কয়েক বছর যেতেই রাক্ষস আবার ক্লোবংকে মেরে খেতে চাইল। ভাই রাজি হতে বাধ্য করল। ক্লোবংকে নিয়ে ভাই ক্লো-পাও ফুল আনতে জংগলে গেল। বোনকে গাছের তলায় রেখে ভাই গাছে উঠল এবং গাছের ডাল দিয়ে ক্লোবংয়ের মাথায় আঘাত করল। ক্লোবং মারা গেল ও রাক্ষস তার মাংস খেয়ে নিল। এরপর থেকে ম্রো সমাজে ভাইবোন একসঙ্গে ক্লো-পাও ফুল সংগ্রহ করতে যায় না।
প্রতিদিন বদলাচ্ছে পাহাড়, জংগল, ঋতু আর চারধারের প্রকৃতি। ক্লো-পাওয়ের মতো বহু বুনো প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। প্রাণ-প্রকৃতিকে ঘিরে গড়ে ওঠা নিম্ন বর্গের ধর্ম, বিশ্বাস, রীতিনীতি, কৃত্য-আচার সবকিছুই বদলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বান্দরবানের লামার সরই পাহাড়ে গত বিশ বছরে কমেছে ক্লো-পাও ফুলের বিস্তার। অবশ্যই পরিবেশ-দূষণ কিংবা জলবায়ু বিপর্যয় আছে।
কিন্তু সরই পাহাড়ে তারচে বেশি যন্ত্রণা তৈরি করেছে মানুষ। এখন আর সরই পাহাড়ে রূপকথার উইমোকমা নেই, এখন বহিরাগত বাঙালির লোভের বাণিজ্যই পাহাড়ের নতুন উইমোকমা। পাহাড় থেকে বহুদূরের বহিরাগত প্রভাবশালী বাঙালি পুরুষ মানুষ।
সংরক্ষিত পবিত্র পাড়াবন বিনষ্ট করায় ম্রোরা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে। লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিযোগ পাওয়ার পর লামা বিভাগীয় বনকর্মকর্তাকে অবহিত করেন এবং ডলুঝিরি রেঞ্জ কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে বনবিভাগ।
আশা করি, তদন্ত প্রতিবেদনটি পাবলিক হবে। জোর-জবরদস্তি করে ম্রো বসতির গাছ কাটা বন্ধ হবে। হাতিকে বন্দি করে গাছ টানানোর মতো নির্দয় কাজ বন্ধ হবে পাহাড়ে। লেমুপালং পাড়াবনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। সরই পাহাড়ে ফুটবে ক্লো-পাও, নির্ভয়ে ফুল কুড়াতে যাবে ম্রো ছেলেমেয়েরা। নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় মিলবে চানক্রানের ক্লোবং নাচ।
সরই ইউনিয়নের লেমুপালং মৌজার চাইল্যা ঝিরির পাশে তিনটি ম্রো পাড়া। পুরাতন ও নতুন দেয়ান পাড়া এবং বাক্কা পাড়া। পাড়াবাসী অভিযোগ করেছেন দুই দশকের বেশি সময় ধরে তাদের সংরক্ষিত পাড়াবন থেকে গাছ কেটে নিচ্ছেন চট্টগ্রামের লোহাগড়ার ব্যবসায়ী মোরশেদ আলম চৌধুরী। লেমুপালং মৌজার বর্তমান হেডম্যান কাইনওয়াই ম্রো, এর আগে হেডম্যান ছিলেন তার বাবা চন্টু ম্রো। অভিযোগ উঠেছে নিরক্ষর চন্টু ম্রোর স্বাক্ষর জাল করে একটি হয়তো চুক্তিপত্র তৈরি করে এই কাজটি করা হচ্ছে। এমনকি গাছ পরিবহনের জন্য ঝিরি ও পাহাড় সব কেটে তছনছ করা হয়েছে।
শুধু পাড়াবন নয়, এলাকাবাসী নিজেদের বড় করা গাছ প্রয়োজনে এই মোরশেদ সাহেব ছাড়া অন্য কারো কাছে বিক্রিও করতে পারে না। এক জটিল সিন্ডিকেট। কম দামে বিক্রি করে সেই টাকা পেতে অপেক্ষা করতে হয় বহুসময়। তবে সেই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গণমাধ্যমে জানান, জোত-পারমিটের মাধ্যমে মৌজাপ্রধান থেকে আজীবনের জন্য এই বাগান তিনি কিনেছেন এবং গাছ কাটা এবং হাতি দিয়ে গাছ টানানো বৈধভাবেই করছেন।
এ বিষয়ে একটি নিউজপোর্টালে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয় ৩ মে। লেমুপালং মৌজার ১৩টি ম্রো পরিবার গণমাধ্যমে জানান, হাতি দিয়ে কাটা গাছ টানার কারণে হাতির বিষ্ঠায় বিনষ্ট হচ্ছে পানীয় জলের ঝিরি। পূর্বে কালা পাহাড়, পশ্চিমে পালং খাল, উত্তরে শিলঝিরি এবং দক্ষিণে বমু খালের সীমানা অঞ্চলে বনবিনষ্টের এই দস্যুতা চলছে। হাতির বিষ্ঠায় দূষিত পানি পান করে স্কুলের শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু গাছ নয়, পাহাড় ঝিরির পাথরও তুলে নিতে চেয়েছিল মোরশেদ গং। এলাকাবাসীর বাধার মুখে তা বন্ধ আছে।
২০১৫ সনে ম্রোরা নির্বিচার গাছ হত্যার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু পরে মোরশেদ গং তিনবার ম্রোদের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাচেষ্টা ও মাদকের মামলা দেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২০২০ সালে মামলা খারিজ হয়ে যায়।
বিশ্বব্যাপী আজ পবিত্র বৃক্ষ ও পবিত্র বনভ‚মির ধারণা সর্বজনস্বীকৃত। বাংলাদেশেও ‘বন্যপ্রাণী আইন (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) ২০১২’ অনুযায়ীও সামাজিকভাবে সংরক্ষিত এমন পবিত্র-স্মারক প্রাণপ্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় অঞ্চলেই প্রায় আদিবাসী সমাজেই সামাজিকভাবে সংরক্ষিত পবিত্র বনভ‚মির অস্তিত্ত আছে। মৌজা রিজার্ভ বা পাড়াবন নামে পরিচিত এসব অরণ্য বৈচিত্র্য এবং বিন্যাসে স্বতন্ত্র হয়ে থাকে।
বহু গবেষণা প্রমাণ করেছে, এমন সামাজিকভাবে সংরক্ষিত বনগুলো বহু বিলুপ্ত প্রাণের শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু মোরশেদ গং প্রাণপ্রকৃতি সংরক্ষণের এই প্রথাগত সংরক্ষণ বিধিকে অমান্য করেছেন। লেমুপালং কুয়া-বামের পবিত্র মর্যাদা অস্বীকার করে বছরের পর বছর এই এলাকা থেকে গাছ কেটে সমগ্র এলাকার বাস্তুতন্ত্রকে বিনষ্ট ও অনিরাপদ করে রেখেছেন। এসব পাড়াবনে সাধারণত আগ্রাসী প্রজাতি থাকে না।
নির্দয়ভাবে এখানে কাটা পড়ছে কানরন (জলপাই), তুইহির (জারুল), উইকং (চাপালিশ), রাইম্য (গর্জন), ওমপাং (গামারি) কিংবা তুমপাও (নাগেশ্বর) এর মতো বৈচিত্র্যময় দেশীয় বৃক্ষপ্রজাতি। তুমপাও (নাগেশ্বর) ম্রো সমাজে পবিত্র বৃক্ষের মর্যাদা পায়, চানক্রান উৎসবে এই ফুলও লাগে। নির্বিচারে এসব গাছ কেটে ফেলায় এসব গাছের ওপর নির্ভরশীল পাখি ও বন্যপ্রাণীরা উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে। বন্যপ্রাণীর বিচরণস্থল ও খাদ্যউৎস সংকুচিত হয়েছে। সরই পাহাড়ে প্রভাবশালী বহিরাগতদের এমন কাঠবাণিজ্য শুধু ম্রো জনগোষ্ঠী নয়, বহু বন্যপ্রাণের অস্তিত্বকেই বারবার হুমকির মুখে ফেলছে।
এই সরই পাহাড়ের কথা কী আমাদের মনে আছে। এ পাহাড়ের রেংয়েনপাড়ায় ২০২৩ সালের পহেলা জানুয়ারি গভীর রাতে অগ্নিসংযোগ, হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। প্রমাণিত হয় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রি ম্রোদের ৪০০ একর পাহাড়ি অঞ্চল জবরদখল করে রাবারবাগান করার জন্য এসব ঘটাচ্ছে। এরও আগে ২০২২ সনের ২৬ এপ্রিল এই কোম্পানি সরই পাহাড়ে আগুন লাগায়। একদিকে রাবার কোম্পানির আগুন, আরেকদিকে প্রভাবশালীর কাঠবাণিজ্য কোনো বাহাদুরিই থামছে না সরই পাহাড়ে। কাঠ বা কোম্পানি নয়; রাষ্ট্রকে জনগণের সম্পদ এবং জানমালের সুরক্ষায় সোচ্চার হতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য