-->

উন্নতমানের কৃষি উৎপাদনে দরকার দক্ষ কৃষক

আলকামা সিকদার
উন্নতমানের কৃষি উৎপাদনে দরকার দক্ষ কৃষক

দেশে মোট কতজন কৃষক আছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আছে বলে জানা যায় না। কৃষি শুমারিতে একেক সময় উঠে আসে একেক রকমের তথ্য। আমাদের বীর কৃষকরা তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাত-দিন পরিশ্রম করে ফলিয়ে যাচ্ছে সোনার ফসল। যার সুফল ভোগ করছি আমরা বছরের পর বছর ধরে।

 

বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নশীল দেশ। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত কৃষিপ্রধান দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে চেষ্টা করছে জোর গতিতে। কৃষিপ্রধান চীন এখন কৃষি প্রযুক্তিতে পরিপূর্ণ। আমরাও এগোতে শুরু করেছি একটু একটু করে। বহুমুখী কৃষিপণ্য উৎপাদন ও কৃষির সাফল্যের জন্য বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ একটি রোল মডেল। উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের জন্য একটি হাব হয়ে উঠতে পারে। এর জন্য দরকার স্মার্ট কৃষির সফল বাস্তবায়ন।

 

ঘোষণা দেয়া হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশের। এরই সঙ্গে বাংলাদেশের সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষিকেও স্মার্টের আওতায় আসতে হবে। কৃষিতে স্মার্ট বলতে খামারে ইন্টারনেট অব থিংস, সেন্সর, লোকেশন সিস্টেম, অটোমেশন, রোবটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তির ব্যবহারকে বোঝায়। বাংলাদেশের মতো দেশে অবশ্য এর সবটির ব্যবহার আমাদের ধীরে ধীরে পূর্ণতা পাবে। তবে স্মার্ট ফার্মিংয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো শস্যের গুণমান এবং পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ব্যবহৃত মানবশ্রমকে অপটিমাইজ করে প্রযুক্তির সাহায্যে তা সহজে প্রাপ্তি। 

 

অ্যাঞ্জেলা শুস্টারের মতে, বিশ্ব জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য কম পরিমাণে বেশি খাদ্যোৎপাদনে স্মার্ট ফার্মিংয়ের গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে, স্মার্ট ফার্মিং প্রাকৃতিক সম্পদ ও ইনপুটগুলোর আরো দক্ষ ব্যবহার, জমির উত্তম ব্যবহার এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলন বাড়াতে সক্ষম করে তোলে।

 

স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার শব্দটি খামারে ইন্টারনেট অব থিংস, সেন্সর, লোকেশন সিস্টেম, রোবট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তির ব্যবহারকে বোঝায়। চূড়ান্ত লক্ষ্য; শস্যের গুণমানের পরিমাণ বাড়ানো ও ব্যবহৃত মানবশ্রমকে অপটিমাইজ করা।

 

স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো- টেকসই কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং আয় বাড়ানো; জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করা; এবং যেখানে সম্ভব গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো বা অপসারণ করা। স্মার্ট ফার্মিং স্প্রে অপচয় কমানো থেকে জ্বালানি অর্থনীতির উন্নতি করতে পারে।

 

স্মার্ট কৃষিতে ব্যবহৃত প্রযুক্তির উদাহরণ হলো- যথার্থ সেচ এবং সুনির্দিষ্ট উদ্ভিদ পুষ্টি। গ্রিনহাউসে জলবায়ু ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণ, সেন্সর-মাটি, জল, আলো, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনার জন্য সফটওয়্যার প্ল্যাটফরম। অবস্থান সিস্টেম-জিপিএস, স্যাটেলাইট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, মোবাইল সংযোগ। রোবট, বিশ্লেষণ এবং অপটিমাইজেশান প্ল্যাটফরম।

 

আর এসব প্রযুক্তির মধ্যে সংযোগ হলো ইন্টারনেট অব থিংস। আর এটি সেন্সর এবং মেশিনের মধ্যে সংযোগের জন্য একটি প্রক্রিয়া, যার ফলে একটি সিস্টেম, যা প্রাপ্ত ডেটার ওপর ভিত্তি করে খামার পরিচালনা করে থাকে। এসব ব্যবস্থায় কৃষকরা তাদের খামারের প্রক্রিয়াগুলো নিরীক্ষণ করতে এবং দূর থেকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

 

স্মার্ট ফার্মিংয়ের আরো সুবিধার মধ্যে রয়েছে স্যাটেলাইট অটোগাইডেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে উন্নত নির্ভুলতা, কাজের দক্ষতা ও জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানো, ভোগ্যপণ্য হ্রাস, ফলন বৃদ্ধি, চালকের চাপ কম, ব্যবহারের সহজতা; সহজ রেকর্ডিং এবং রিপোর্টিং; সহজ আর্থিক পূর্বাভাস; টেকসই উন্নত ব্যবস্থাপনা; গ্রিনহাউস অটোমেশন, শস্য ব্যবস্থাপনা, গবাদিপশু পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা, যথার্থ চাষ, কৃষিতে ড্রোনের ব্যবহার, স্মার্ট ফার্মিংয়ের জন্য ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিশ্লেষণ, অ্যান্ড-টু-অ্যান্ড ফার্ম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি।

 

প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় স্মার্ট ফার্মিং অন্য কোন কোন সুবিধা আনতে পারে?

 

প্রচলিত সাপ্লাই চেইনগুলো কৃষকদের গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তার চেয়ে তাদের পণ্য কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে তাদের কাছে কম তথ্যই থাকে; কিন্তু স্মার্ট ফার্মিংয়ে তথ্যের দক্ষ ও ন্যায়সংগত প্রবাহকে সক্ষম করে তোলে এবং আরো ভালো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুবিধার্থে সরবরাহ-শৃঙ্খলের সব অ্যাক্টরের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ তৈরি করে দেয়।

 

এতে অ্যাক্টরদের ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে এবং পুরো সরবরাহ-শৃঙ্খলজুড়ে লাভকে আরো সুষমভাবে পুনর্বণ্টন করার সুযোগ দিয়ে একটি উইন-উইন পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। সাপ্লাই চেইন (যেমন- প্রসেসর এবং ভোক্তাদের) তাদের গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তন করার সুযোগ চিহ্নিত করতে পারে। যার ফলে তাদের পণ্যের মূল্য বাড়ে।

 

কৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তথা ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বেশ আগেই। এসব প্রযুক্তিগত সুফল সম্প্রতি কৃষিতে জাগরণ সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে এটা আরো বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে বহু অনলাইন পরিষেবা বাড়ছে। এসবের প্রভাবে কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। অনেক তরুণ শিক্ষিত যুবকরাও যুক্ত হয়েছে আধুনিক কৃষির সঙ্গে উদ্যোক্তা হয়ে।

 

স্মার্ট ফামিং বাংলাদেশে সফল হলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে দ্বিগুণ হারে। যার জন্য প্রয়োজন হবে সংরক্ষণাগার। আর তার জন্য মাল্টিপারপাস সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে পারলে সবজি কম পচবে। অপচয় রোধ হবে, লাভবান হবে কৃষক। আর তাই এসবের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট বা প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন কৃষক।

 

তার জন্যও সরকারকে শিক্ষিত ও তরুণ যে সবাই কৃষি উদ্যোক্তা রয়েছে তাদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে এসে তাদের মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকদের প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যার জন্য সহযোগিতা থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিস বা কৃষি বিভাগের।

 

তাহলেই অতি দ্রুত সম্ভব তৃণমূলের কৃষকদের মাঝে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি বা স্মার্ট কৃষি পৌঁছে দেয়া।

 

তাহলেই হয়তো সুফল দ্রুত আসবে কৃষির আধুনিকায়নের। বাড়বে উৎপাদন শীলতা, সময় কমে আসবে কৃষি উৎপাদনে, এক জমিতে তিন ফসল, চার ফসল আবাদ করা সম্ভব হবে। আর যখনি এর সুফল প্রতিটি কৃষকের ঘরে পৌঁছে যাবে তখন কৃষক আগ্রহী হয়ে উঠবে কৃষিতে বিনিয়োগ করতে।

 

স্মার্ট ফার্মিং গড়ে তুলতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরতে গিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এক সেমিনারে বলেছিলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে দেশের এক হাজার গ্রামকে স্মার্ট ফার্মিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এতে ২০ লাখ কৃষক ও সাড়ে ৩ লাখ উদ্যোক্তা যুক্ত হবেন।

 

তিনি বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ গ্রামকে স্মার্ট ফার্মিংয়ের জন্য ডিজিটালাইজ করতে চাই। এতে ২০ হাজার কৃষক, তাদের জন্য ২০ হাজার আধুনিক কৃষি ডিভাইস, সাড়ে ৩ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হবে। এভাবে ফেইজ ওয়ান, টু, থ্রি করে ২০৪১ সালের মধ্যে এক হাজার গ্রামের ২০ লাখ কৃষক এবং সাড়ে ৩ লাখ উদ্যোক্তা স্মার্ট ফার্মিংয়ের আওতায় আসবে।

 

ইকোসিস্টেমের জন্য ডিজিটাল ভিলেজ সেন্টার, ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার, ডিজিটাল ভিলেজেস, এমএফএস, ইন্টার অপারেবল ডিজিটাল ট্রান্সজেকশন প্ল্যাটফর্মসহ অন্য অনুষঙ্গগুলো একত্র করে কাজ করবে।

 

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান জমির সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে স্মার্ট ভার্টিকেল এগ্রিকালচার ফার্মিং, স্মার্ট কৃষি ফার্মিং, পারিবারিক পুষ্টি বাগান ব্যাপকভাবে চালু করা যেতে পারে। সরকারের এসব বিষয় বহুমুখী প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর বাস্তবায়নও হচ্ছে। সহজ কথায়, দেশের স্বল্প সম্পদকে বা জমিকে যতখানি স্মার্টলি ব্যবহার করা যাবে, ততই কৃষি হয়ে উঠবে স্মার্ট।

 

বর্তমানে দেশ থেকে আম, কাঁঠাল, আলু, বিভিন্ন সবজি, হিমায়িত চিংড়ি ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। স্মার্ট ওয়েব ও মোবাইল এপস উদ্ভাবন এবং অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে সাপ্লাই চেইন সংক্ষিপ্তকরণ, কৃষক এবং ভোক্তার ক্রয়/বিক্রয় ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং স্মার্ট কৃষি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে সহজ হবে স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন।

 

সরকারের এ চিন্তা ধারাকে সফল বাস্তবায়ন করতে পারলে অবশ্যই কৃষক স্বাবলম্বী হবে। আরো আন্নত হবে দেশের কৃষিব্যবস্থা। সঠিক নিয়মে উৎপাদন করে গ্রাহকদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা কৃষি ব্যবসায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ভবিষ্যতে টেকসই ক্ষমতা পাবে এবং স্মার্ট ফার্মিং এটির অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।

 

স্মার্ট কৃষি ফার্মিং কৃষকদের পানি, ভৌগোলিক অবস্থা, দৃষ্টিভঙ্গি, গাছপালা এবং মাটির প্রকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে। এটি কৃষকদের তাদের উৎপাদন পরিবেশের মধ্যে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই পদ্ধতিতে এগুলো পরিচালনা করতে সাহায্য করে। এটি কৃষকদের সময়মতো তাদের পণ্যের পরিমাণ ও গুণমান নিরীক্ষণ করতে এবং প্রয়োজনে তাদের উৎপাদন কৌশলগুলো সামঞ্জস্যে সক্ষমতা দেয়।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version