-->

বিশ্বকে খাদ্যের জোগান দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে

ফনিন্দ্র সরকার
বিশ্বকে খাদ্যের জোগান দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপির) প্রধান মিন্ডি ম্যাকেইন বিশ্বকে খাদ্যের জোগান দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন। তার এই মন্তব্যের কারণ রাশিয়া-ইউক্রেনের শস্যবিষয়ক চুক্তির মেয়াদ ১৮ মে শেষ হওয়া। এই চুক্তি শেষ হওয়ার ফলে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে।

 

এই লেখা যখন লিখছি তখনো শস্য চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। খাদ্য কর্মসূচির প্রধান এই চুক্তিটি নবায়ন করার আহব্বান জানিয়েছেন। তা না হলে গোটা বিশ্বই খাদ্য সংকটে পতিত হবে। খাদ্য সংকট বিশ্বের মানব সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাশিয়া-ইউক্রেন খাদ্য শস্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ।

 

বিশেষত: ইউক্রেনকে ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয়ে থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শস্যের জোগান দিতে পারছে না দেশটি।

 

রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের শস্যচুক্তিতে বলা আছে, খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণে কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলো কিয়েভকে ব্যবহার করতে দিতে হবে।

 

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই বন্দরগুলো অবরোধ করে রেখেছিল রাশিয়া। রুশ যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে ঘেরাও ছিল বন্দরগুলো। চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির কথা থাকলেও চুক্তিটি আর আলোর মুখ দেখতে নাও পারে এমন হুমকি দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে বিশ্বে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় গত ২০২২ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া খাদ্যশস্য চুক্তিটি করেছিল।

 

এর বিনিময়ে মস্কোর কৃষিজ পণ্য রপ্তানিতে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ছিল জাতিসংঘের। ‘সূর্যমুখী বীজ’, গম, বার্লিসহ বিপুল শস্য রপ্তানি করে থাকে ইউক্রেন। চুক্তির ফলেই ইউক্রেন এসব পণ্য রপ্তানি করতে পেরেছে। বিশ্বে খাদ্যশস্যের চাহিদার প্রায় অর্ধেকই আসে ইউক্রেন থেকে। তাই চুক্তিটি নবায়ন করা না হয়, তবে বিশ্বে খাদ্যশস্য সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। যে জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান খাদ্য সংকটের সতর্কবার্তা প্রদান করেছেন।

 

যদি রাশিয়া-ইউক্রেন শস্য চুক্তিটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা না হয়, খাদ্যঝুঁঁকিতে পড়ে যাবে গোটা বিশ্বই। কেননা, রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে যে শস্য রপ্তানি হয় তা দিয়ে শিশু খাদ্যও তৈরি করা হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও যে চুক্তিটি সাধারণ মানুষের কল্যাণ বয়ে এনেছিল তা বিস্ময়কর।

 

এখন শঙ্কিত এই কারণে যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শস্য চুক্তির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান অবস্থান। চুক্তির শুরুতেই তিনি এর বিরুদ্ধেই ছিলেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের কারণে চুক্তিটি সম্ভব হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমনিতেই যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন ও রাশিয়া পণ্য উৎপাদনে সমস্যায় পড়েছে দেশ দুটোর কৃষি বিভাগ ও সাধারণ কৃষকগণ।

 

এদিকে কিয়েভকে সুরক্ষিত করতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। গত ফেব্রুয়ারিতে ২০২৩ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলনস্কি ব্রিটেন সফর করেন। সে সময় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, রাশিয়ার বোমা ও ইরানীয় ড্রোনের হামলা থেকে কিয়েভের নিরাপত্তা প্রয়োজন। এদিকে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। কৃষি এলাকাও হামলা থেকে বাদ যায়নি।

 

জানা গেছে, মাটিতে গোলাবারুদ ও আকাশপথে বিমান হামলা এক সঙ্গে দুটিই চালায় রুশ সেনাবাহিনী। আঘাতে ইউক্রেনের খারকি নামক জায়গার ৬টি বাড়ি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। খেরসন এলাকার প্রশাসন জানিয়েছে, গত ১২ ও ১৩ মে’র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৯০ বার গোলাগুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, বিদ্যুৎ স্থাপনা অন্যান্য লক্ষ্যে আঘাত হানার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে আসছে রাশিয়া।

 

যা হোক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কবে শেষ হবে এর কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত, যা ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়েছিল। শুরু হয়েছিল ক্রিমিয়ার অবস্থা ও দনবাসের কিছু অংশকে কেন্দ্র করে। যে অংশকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু হয়, আন্তর্জাতিকভাবে তা ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃত।

 

তার পরও ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ চলছে ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যুদ্ধ সামনে রেখেই বিশ্ব নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী ভাবে খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা যায়! বিশ্বের সভ্য কোনো মানুষই যুদ্ধের পক্ষে নয়। যুদ্ধ কখনো শান্তি দিতে পারে না। তারপরও কেন যুদ্ধ হয়? সে প্রশ্নটি থেকেই যায়।

 

আমার নানাভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি বটে কিন্তু কোনো ব্যাখ্যায়ই যুদ্ধের হিসেব মেলাতে পারছি না। গত ২টি বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, কী লাভ হয়েছে? এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি আরো কিছু রাষ্ট্রের যুদ্ধ আমরা লক্ষ্য করছি। যেমন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি, আবার সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ।

 

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি লক্ষণীয় এমনি অবস্থায় খাদ্য সংকট তৈরি হবেই। রাশিয়া-ইউক্রেন শস্যচুক্তিই একমাত্র শঙ্কার কারণ নয়। বিশে^র খাদ্য সংকটের কারণ হিসেবে কানাডা ভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ভিজওয়াল ক্যাপিটালিস্ট আরো তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে।

 

সেগুলো হচ্ছে- (১) ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান, (২) বিশ্বব্যাপী সারের ঘাটতি ও (৩) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে ফসল উৎপাদনে প্রতিকূল আবহাওয়া। খাদ্য সংকট মোকাবিলায় গোটা বিশ্বকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। বিশ্বে চাষ উপযোগী অনাবাদি ভূমিতে কৃষি চাষের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

 

পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে পর্যাপ্ত কৃষি উপযোগী জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে। জনবলের তথা কৃষিজীবীর অভাবে সেখানে কৃষি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োজনে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ থেকে লোকবল নিয়ে কৃষি উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য চাই ঐকমত্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বৈরি আবহাওয়া তৈরি হয়েছে, সে জন্য দরকার কার্বন নিঃসরণ গতিরোধ।

 

প্রতিবছরই জলবায়ু সম্মেলন হয় কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবরূপ লাভ করতে পারে না। প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ রক্ষায় সবাইকে ভ‚মিকা রাখতে হবে। নদিমাতৃক দেশে নদি খাল বিল সংরক্ষণ করতে হবে। বিশ্বের উৎপাদিত পণ্যের সুষম বণ্টন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। খাদ্য সংকট মোকাবিলা এখন প্রত্যেক রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সংকটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। মানব জাতি ইচ্ছা করলেই সব সমস্যা সমাধান করতে পারে।

 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version