ইভিএমের সঠিক ব্যবহারে ভোট পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব তা গাজীপুর সিটি নির্বাচনে প্রমাণ হলো। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে কমিশনের স্বচ্ছতা, আন্তরিকতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। চমৎকার পরিবেশ পেয়ে ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিয়েছে তাদের কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে।
সমগ্র দেশবাসীরও কড়া নজর ছিল নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের ওপর। সব কেন্দ্রে ভোট হয়েছিল ইভিএম দিয়ে, এটাও ছিল দেশবাসীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অন্যতম কারণ। বলা চলে, জাতীয় নির্বাচনের মাত্র আট মাস বাকি থাকতে কোনো ধরনের গোলোযোগ-অভিযোগ ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে এই ভোট।
ইভিএম পদ্ধতিতে বিগত কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনের তুলনায় গাজীপুরের এই নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল বেশি। নির্বাচন কমিশনের কঠোর অবস্থান, সিসি ক্যামেরার ব্যবহার, ভোটের আগের রাতে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল এবং এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের কঠোর অবস্থান প্রশংসিত হয়েছে।
তবে সরকারের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রতিশ্রæতির পাশাপাশি বাংলাদেশের সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণাও গাজীপুরের ভোটে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, সরকার ও কমিশনের এমন অবস্থানের ফলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসতে উৎসাহিত হয়েছে, যা আগামী দিনের নির্বাচনগুলোর জন্য একটি শুভ বার্তা। অবশ্য এই বার্তার মুখ্য ভ‚মিকায় ছিল ইভিএমের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা।
ইভিএম পদ্ধতিতে আগামী মাসে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও ইভিএম এবং সংশ্লিষ্ট সবার ভূমিকা গাজীপুরের চেয়েও আরো সহায়ক হবে এমনটি এখন দেশবাসীর প্রত্যাশা। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বর্তমানে ইভিএম ক্রয় প্রকল্পটি স্থগিত আছে।
এ অবস্থায় ইভিএমের পরিবর্তে ব্যালট বক্সেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এমন সিদ্ধান্তই এখন পর্যন্ত বহাল আছে। যদিও ইভিএম দিয়ে স্বল্প সময়ে, নির্ভয়ে ও স্বচ্ছন্দে ভোট দিতে পেরে গাজীপুরবাসীর আগ্রহ ও সন্তুষ্টি ছিল লক্ষণীয়।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এই নির্বাচনে ভোট গ্রহণে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ৪৮০টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ইভিএমের পাশাপাশি কেন্দ্রগুলোতে ৪ হাজার ৪৩৫টি সিসিটিভি ক্যামেরাও লাগানো ছিল। সেজন্য কারচুপি করতে সাহস পায়নি কোনো সন্ত্রাসী। নিরাপদ পরিবেশ পেয়ে ভোটাররাও ভোট দিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে দেখা গেছে দারুণ উচ্ছাস।
তবে নিয়ম না জানায় অনেক বয়স্ক মানুষ বিপাকে পড়েন। আঙুলের ছাপ না মেলায় ঝামেলায়ও পড়েন অনেকে। ইভিএম ত্রুটির কারণে দারুস সালাম মাদরাসার দুটি বুথে এবং আজিমুদ্দিন কলেজের একটি বুথে যথাক্রমে দুই ঘণ্টা এবং এক ঘণ্টা ভোট বন্ধ ছিল।
অবশ্য, ফল ঘোষণাকালে মাঝখানে কয়েক ঘণ্টা দেরি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভোটার এবং প্রার্থীরা। যেহেতু ইভিএমে ভোট শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেজাল্ট পাওয়া যায়, তাই সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। ব্যালট বিষয়ে ভুল-ত্রুটি কিংবা সংখ্যার প্রমাণ থাকে কমিশনের হাতে, প্রার্থী চাইলে পরবর্তীতে তা যাচাই-বাছাই করার সুযোগ পান।
কিন্তু ইভিএমে এ সুযোগটি নেই, কারণ এর ভেতর রক্ষিত চিপটি শুধু ‘রিড অনলি মেমোরি’। আঙ্গুলের ছাপ দিলে ভোটারের ছবি প্রদর্শন এবং কাক্সিক্ষত প্রার্থীর পক্ষে ভোট হলো কিনা তাও বোঝার কোনো উপায় থাকে না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) সংযুক্ত হতে পারে ইভিএমের সঙ্গে।
আবার ইভিএমগুলো ব্রাঙ্ক কিনা, অডিট কার্ডের চিপ টেম্পারিং করে প্রিলোডেড করা কিনা, ব্যাটারি ও কন্ট্রোল ইউনিট, ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল ডিসপ্লে ঠিকমতো কাজ করে কিনা ইত্যাদি যাচাই-বাছাই ও সব খুঁটিনাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ত্রুটি মুক্ত ইভিএম সরবরাহ করা উচিত। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
আবার ইভিএম ত্রæটির কারণে কিংবা আঙুলের ছাপ না মিললে (সাধারণত শ্রমঘন কাজে জড়িত, কায়িক পরিশ্রম ও গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত নাগরিক ও বয়স্কদের আঙুলের ছাপ ইভিএম মেশিনে না মেলার সম্ভাবনা থাকে) প্রিসাইডিং অফিসারের ওভাররাইটের ক্ষমতায় পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা সম্ভব।
ভোটগ্রহণে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে শুধু মেশিন অন-অফ করা, বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ ও ভোটের ডিজিটাল বাটন বিষয়ে শেখানো হয়, কোনো কারিগরি সমস্যার সমাধান শেখানো হয় না। সংখ্যায়ও তারা খুব নগণ্য। ফলে, একই সঙ্গে একাধিক মেশিন হ্যাং হলে এসব টেকনিশিয়ানের কিছুই করার থাকে না।
এমন পরিস্থিতিতে টেকনিশিয়ানের নাম করে ‘বিশেষ’ লোকজন কেন্দ্রে প্রবেশ করে ডুপ্লিকেট ‘অডিট কার্ড’ রিপ্লেস করার আশঙ্কা থাকে। এমনটি হলে ডিজিটাল অডিট বা ফরেনসিক টেস্ট করে নিতে হবে। তবে সহায়তার নামে যেকোনো অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
কর্মীদেরও এই কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে ভোটের দিন নেতা, কর্মী ও সাধারণ মানুষের ক্ষমতা সমান, শুধু একটি ভোট দেয়া। ইভিএমে আরো যেসব চ্যালেঞ্জ আছে যেমন বয়স্কদের প্রযুক্তিভীতি, আঙুলের ছাপ না মেলা, সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বন্ধ, সব প্রার্থীর এজেন্টদের নির্ভয়ে কেন্দ্রে থাকার নিশ্চয়তা প্রদান, কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব রোধে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
পোস্টার-ফেস্টুন, ইলেকট্রনিক ও বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ইভিএম সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করা গেলে ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়বে, ভোটাররা নির্বাচনমুখী হবে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে কিছু পুরোনো ইভিএম যন্ত্র স্থানীয় ভোটারদের প্রদর্শনের জন্য রাখলে ইভিএম ভীতি অনেকটা কেটে যাবে।
বর্ণিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে পারলে আসন্ন চারটি সিটি নির্বাচন এবং ভবিষ্যতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে, ইভিএম রূপান্তরিত হবে ভোট গ্রহণের নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী টুলস হিসেবে।
ইভিএম ব্যবহারে গাজীপুরবাসী যে সুযোগটি পেল, তা যদি আসন্ন চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বহাল থেকে, তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচনসহ পরবর্তী সব নির্বাচনে ভোটাররা ইভিএমের পক্ষেই অবস্থান নেবে।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (সদস্য, ইভিএম টেকনিক্যাল কমিটি, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন)
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য