-->
শিরোনাম

তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে না?

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে না?

গত ২৪ মে গভীর রাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্রিংকেন এক টুইট বার্তায় আগামী নির্বাচনে যারা বাধাদান করবে কিংবা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কারচুপি কিংবা তাতে সহায়তাদান করবে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যত্যয় ঘটাবে- তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দান নাও করতে পারে বলে জানিয়ে দেন।

 

শুধু ওই সব ব্যক্তিই নয়, তাদের পরিবার-পরিজনদেরও ভিসা দান করা হবে না মর্মে জানানো হয়। পরদিন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের ব্যাখ্যায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির নেতাদের জানিয়ে দেয়, এটি বিশেষ দল বা সরকারের প্রতি লক্ষ্য করে নয় বরং সব দল, সরকার এবং নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

 

বিষয়টি সেদিনই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ঘূর্ণিঝড় কিংবা ভূমিকম্পের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বিরোধী দল বিএনপি এটিকে সরকারের বিরুদ্ধে স্যাংশন বলে অভিহিত করে বক্তব্য দিয়েছে। সরকার ঠান্ডা মাথায় যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিবাচক বলেই গ্রহণ করেছে।

 

বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করতে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ও বিদেশে এ কথা বহু আগে থেকেই উচ্চারণ করে আসছেন।

 

সুতরাং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিবৃতির সঙ্গে সরকারের চিন্তাতে কোনো সাংঘর্ষিকতা তারা দেখেননি। সরকার এটিকে তাই ইতিবাচক মনে করে স্বাগত জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের অবস্থানকে স্বাগত জানানো হয়েছে।

 

মূল যে প্রশ্নটি দাঁড়ায়, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কত ব্যাপকসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ ও কার্যক্রম সংগঠিত হয়ে থাকে তা পরীবিক্ষণ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে খুব কি সহজ হবে? কিছু কিছু পর্যবেক্ষণ থেকে তারা কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারবে মাত্র। আবার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মতো অনেকে নির্বাচনে বাধাদানের নানা দৃশ্যের ছবি তুলে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রেরণও করতে পারে।

 

প্রতারণা ও প্রক্সিদানের প্রবণতা এ দেশে কত ব্যাপক ও কঠিন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সেটি মার্কিনিরা সেখানে কিংবা দূতাবাসে বসে কতটা বুঝবেন, দেখবেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যেতেই পারে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসা কিংবা থাকার পরিবারের সংখ্যা তো এলিটরা ছাড়া সাধারণ মানুষদের তেমন কেউ হন না।

 

ফলে এটি কেবল রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা তথা সমাজের অপেক্ষাকৃত উঁচু স্তরের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য হতে পারে। বিষয়টি কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানে না? নিশ্চয়ই জানে। আমাদের রাজনীতিবিদরা কি জানেন না? নিশ্চয়ই জানেন। উভয়পক্ষই জানেন বলেই এক পক্ষ দিয়েছেন, আরেকপক্ষ দেশে ঘূর্ণিঝড় কিংবা ভূমিকম্পের মতো অবস্থা তৈরি করে দিয়েছেন।

 

আমাদের রাজনীতির একটি অংশ এখন ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে বাহ্যিকভাবে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। বিশেষত বিএনপির বেশকিছু নেতা মনে করছেন, এই স্যাংশনের জন্য সরকারই দায়ী। যারা শোনেন তারা মনে করেন, এটি একটি দলীয় অবস্থানকে রক্ষা করার বক্তব্য। বিএনপি নেতারা জনসভায় দাঁড়িয়ে মার্কিন ঘোষিত ভিসানীতিকে সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা হিসেবে অভিহিত করেছে, তাদের আন্দোলনের সাফল্য হিসেবেও তারা এটিকে দেখছে।

 

কিন্তু রাজনীতি সচেতন মানুষ মনে করে, এই ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে মার্কিন কর্তৃপক্ষ যদি মিন করে থাকেন, তাহলে বিএনপির পক্ষে আগামী নির্বাচনে ২০১৩-১৪ সালের মতো কিছু করার সুযোগ থাকবে না। বিএনপি তখন নির্বাচন বর্জনই শুধু করেনি, প্রতিহত করারও সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল। এতে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, সম্পদ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। বিএনপি এখন দাবি করে থাকে, সেই নির্বাচনের পর সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিল।

 

কিন্তু বিএনপি সেই নির্বাচন উপলক্ষে দেশে আগুন সন্ত্রাস এতটাই ছড়িয়ে দিয়েছিল যে, মানুষের রুটি-রুজি দুই মাস প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিএনপি আশা করেছিল, নির্বাচন যেহেতু সুষ্ঠু হয়নি, ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন, তাই মানুষ হয়তো রাস্তায় নেমে পড়বে। তাহলেই তাদের কেল্লাফতে।

 

কিন্তু বিএনপি একবারো ভাবছে না, তখন তারা ২ মাস মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছিল, ব্যবসাবাণিজ্য অনেকের লাটে উঠেছিল, তার ফলে মানুষ তাদের ওপর এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিল, ৫ জানুয়ারি নামমাত্র নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার পর মানুষ দল বেঁধে ঘর থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গিয়েছিল।

 

না, সেটি কোনো সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে নয়, কাজের উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে একটি প্রবাদ যেমন তখন সবার কাছে মনে হয়েছিল, ‘ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলা’ অর্থাৎ নির্বাচন চাই না, তোদের অগ্নিসন্ত্রাসীদের থামা! সে কারণে দেশের মানুষ পরবর্তী ৫ বছর বিএনপির কাছ থেকে কোনো নির্বাচনের আন্দোলনের আশাও করতে যায়নি।

 

বিএনপি ২০১৫ সালেও আবার অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষকে ৩ মাস ঘরবন্দি করে রেখেছিল। এসব কারণেই নির্বাচনের কোনো আকাক্সক্ষা তখন কারো ছিল না। শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ়ভাবে তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছিল। পরবর্তী নির্বাচনেও মানুষ বিএনপির অসহায়ত্ব দেখেছে। নির্বাচন নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকলেও মানুষ উন্নয়ন ধারার দিকেই মনোযোগী ছিল বেশি।

 

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার যদি ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিক কোনো উন্নয়ন দিতে না পারত, তাহলে এই সরকারের প্রতি দেশে এবং বিদেশে কোনো আস্থাই সৃষ্টি হতো না, ক্ষমতায়ও সরকার থাকতে পারত না। ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে শেখ হাসিনা দেশে যে চমক সৃষ্টি করতে পেরেছেন তার ফলে জনগণের কাছে নির্বাচনে ঘাটতির অনেক কিছুই বড় হয়ে ওঠেনি, বিদেশিদের কাছেও নয়।

 

এটি হচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার মৌলিক কারণ, জোর করে থাকার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকত না। বিদেশিরাও শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন জানাত না, যদি তিনি এসব পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ঘটাতে না পারতেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধটি জারি করেছে। তার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক তাৎপর্য কী হতে পারে?

 

এটি নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার কিছু নেই। এককথায় বলে দেয়া যায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তারাসহ সব দেশই দেখতে চায়। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশে বিদেশিদের ব্যবসাবাণিজ্যের অপার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

 

বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করতে চায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি এখন আমাদের সমুদ্রসীমানার তলদেশে যেসব গ্যাস কূপ রয়েছে সেগুলোর প্রতি বিশেষভাবে পড়েছে বললে ভুল করা হবে না।

 

প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা থাকাকালে মার্কিন গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানিরা দলে দলে তার সঙ্গে দেখা করেছেন, তাদের আগ্রহের বিষয়টি বোঝাও গেছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পসহ অনেক ব্যবসাবাণিজ্য এখানে লাভজনক।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই চাইছে না, চীন বা রাশিয়া এখানে প্রবেশ করুক। যদিও শেখ হাসিনার সরকার কোনো বিশেষ রাষ্ট্র বা জোটের মধ্যে অবস্থান না করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের অবস্থানে থাকতে তার অনড় দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন, সেটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো পুরোপুরি আস্থা স্থাপন করতে চায়নি।

 

কিন্তু শেখ হাসিনার মতো দৃঢ়চেতা নেতারা দেশীয় স্বার্থের বাইরে বিদেশি স্বার্থের কাছে কখনো নতজানু হয় না। সে কারণেই তারা মনে করে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হলে শেখ হাসিনা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাদের ব্যবসাবাণিজ্যও এখানে ভালোই চলবে।

 

অন্যদিকে বিএনপি রয়েছে নেতৃত্বশূন্যতায়। বিএনপির অতীত ইতিহাস বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক উচ্চতাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো আগের মতো করে দেখার ক্ষেত্রে সন্দিহান। তারপরও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে দেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে এটি তাদের অনুমান।

 

কিন্তু সেই নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে আবার ২০১৪ সালের মতো জ্বালাও-পোড়াও অবস্থানে ফেলে দেয়া হয়, তাহলে ভ‚রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলয় আস্থার সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে নাও পারতে পারে। কারণ বিএনপি জোটের সঙ্গে দেশের সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী নানাগোষ্ঠী গোপনে যুক্ত আছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আবার ২০০১-০৬ এর চেয়ে ভয়াবহতার দিকে চলে যেতে পারে।

 

এসব হিসাব-নিকাশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন রয়েছে, চীন, জাপান, ভারতেরও রয়েছে। এখন পৃথিবীর সব দেশই আমাদের মতো দ্রুত বর্ধনশীল দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে চায়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টারও বাংলাদেশে এসেছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির আলোচনা করতে।

 

এ আলোচনায় স্থান পেয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি। এক্ষেত্রে চীনই একমাত্র বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে। সুতরাং চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখতেই হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং অর্থনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য, একইভাবে জাপানের সঙ্গেও।

 

সরকারি দল আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দলের অভ্যন্তরের বিরোধ আর উচ্চাকাক্সক্ষীদের নিয়ন্ত্রণে আনা। অনেকেই মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার ক্ষেত্রে কারো কারো সঙ্গে হাত মেলাতেও পারেন। এটি আওয়ামী লীগের জন্য মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

লেখক: অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version