রইচ উদ্দিন আকন্দ। বয়স ৫৮ বছর। একজন প্রান্তিক চাষি। নিজস্ব সম্পত্তি বলতে চার শতাংশ বসতির ভিটে আর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কেশরিয়ার মাঠে ষোলো শতাংশ আবাদি জমি। উর্বরা কেশরিয়ার বুকে ওই একখন্ড জমিতে যে ধান উৎপন্ন হয় তা দিয়ে পরিবারের পেটের ভাত হয় বেশ ভালোভাবেই।
পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য শ্রম বিক্রি করেন বছরজুড়ে। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল তার দিন। কিন্তু কয়েকদিন থেকে একটি সংবাদ তাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। শঙ্কিত করে তুলেছে অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে।
সংবাদটি, কেশরিয়ার তলা খনন করে মাছের প্রজেক্ট করে দিবে সরকার। সংবাদটি তার বুকে এসে তীরের মতো বিঁধে। ফসলি কেশরিয়াকে খনন করে কেন মাছের প্রজেক্ট করা হবে সে হিসাব মেলাতে পারছে না কিছুতেই। দুপুরে খেতে বসে রইচ উদ্দিন বিষণ্ণ মনে থালের ভাত নাড়াচাড়া করতে থাকে।
এ অবস্থা দেখে স্ত্রী ছমিরন জিজ্ঞেস করে, ‘কি হইল, খাওন বাদ দিয়া থালের ভাত নাড়াচাড়া করতেছেন যে? ‘ভাবতেছি আল্লাহ বুঝি এই ভাত অচিরেই তুইলা নিব’’! রইচ উদ্দিন উত্তর দেয়। বিস্ময়ে ছমিরন বলে ওঠে ‘কন কি! রইচ উদ্দিন বলে ‘হ! কেশরিয়া খুঁইড়া মাছের বড় প্রজেক্ট বানাইব। বাপদাদার আমলের ক্ষ্যাতটারে এইবার বুঝি আর রক্ষা করতে পারলাম না! হায় আল্লাহ, অহন আমাগো কি হইব, কি খাইয়া বাচুম’ বলে ছমিরন ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে।
পাশের বাড়ি থেকে বৃদ্ধ ফুলো বিবি আসে। রইচ উদ্দিনকে জিজ্ঞেস করে, ‘হ্যাগো রইচ, শুনলাম কেশরিয়া খুঁইড়া নাকি মাছের প্রজেক্ট বানাইব? নিরুত্তর রইচ উদ্দিন দুচোখের পানি টপটপ করে ছেড়ে দেয়। বৃদ্ধ ফুলোবিবির বুঝতে বাকি থাকে না কিছুই। সে বাড়ি ফিরে যেতে যেতে বলে, গরিবের প্যাটে লাথি মারলে আল্লাহ সহ্য করব না। গজব পরব গজব!, এমন আহাজারি শুধু বৃদ্ধ ফুলোবিবি বা রইচ উদ্দিনের নয়, কেশরিয়ার মাঠের পাড়ে যাদের বসবাস প্রায় প্রতিটি বাড়িতে চলছে এ শোক আর আহাজারি।
কেশরিয়ার মাঠটির অবস্থান কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতর বন্দ ইউনিয়নের ২, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডে। প্রায় কয়েক হাজার একর জমির ওপর বিস্তৃত এ মাঠ। ঝাকুয়া বাড়ি, মন্নেয়ার পাড়, মোল্লা পাড়া, ডাকনির পাট, মুনশি পাড়া, সরকার পাড়া, নামদানি, বারানির ভিটা, চরুয়াপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে এর পাশ ঘেঁষে। এসব গ্রামের শত শত পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ মাঠের ওপর নির্ভরশীল।
কেশরিয়া এক সময় বিল ছিল। কেশর নামের এক প্রকার জলজ উদ্ভিদ প্রচুর জন্মাত বলে এর নাম দেয়া হয় কেশরিয়ার বিল। বিলে ফুটত শালুক, শাপলা, কলমি, পদ্মসহ নানা প্রজাতির জলজ ফুল। এসব ফুলের সৌন্দর্য দেখে মোহিত হতো যেকোনো বয়সের মানুষ। কেশরিয়ার মিঠা পানিতে পাওয়া যেত শোল, গজার, বোয়াল, চিতল, কৈ, শিং, মাগুর, পাবদা, পুটি, টেংরা, রয়নাসহ দেশি নানা মাছ।
এসব মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত এখানকার প্রায় প্রতিটি পরিবার। বিলের পাড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে পড়ত চিল, শকুন, বালিহাঁস, বক, চখাচখি, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, হাড়গিলাসহ হরেকরকম পাখি। পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকত এর আশপাশ।
এখন সেসব অতীত স্মৃতি মাত্র। ফি বছর বন্যায় পলি পড়ে কেশরিয়ার বিল এখন অনেকটা সমতল। বছরজুড়ে আবাদ হয় ধান, পাট, গম, সরিষা কলাইসহ বিভিন্ন খাদ্য শস্য। উৎপাদিত শস্য স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিশেষ করে ধান উৎপাদনের জন্য কেশরিয়ার মাঠ বিখ্যাত। একর প্রতি নব্বই থেকে একশ মণ ধান উৎপন্ন হয় এ মাঠে।
তাই কেশরিয়াকে ভাতের হাঁড়ি বলে থাকেন অনেকে। এবারো ইরির বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু আনন্দ নেই কৃষকদের মনে। ভুলেভরা আরএস রেকর্ড ও ইজারাদারের দৌরাত্ম্য কেড়ে নিয়েছে তাদের ঘরে ফসল তোলার আনন্দ।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এসএ রেকর্ডে কেশরিয়ায় আঠারো একর পঁচিশ শতাংশ জমি খাস দেখানো হয়। সত্তুরের দশকে এসব জমি স্থানীয় ভূমিহীনদের মাঝে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। বর্তমান আরএস রেকর্ডেও কেশরিয়ায় আঠারো একর পঁচিশ শতাংশ জমি খাস দেখানো হয়েছে। কিন্তু এসএ রেকর্ড ও সঠিক কাগজপত্র থাকার পরও অনেক জমি খাস এবং ভূমিহীনদের মাঝে বন্দোবস্ত দেয়া খাসজমি অনেকের নামে রেকর্ড দেয়া হয়েছে।
এতে রেকর্ড বঞ্চিত কৃষকেরা বিস্মিত ও হতবাক হয়ে পড়েছেন। কথা হয় ডাকনির পাট গ্রামের সুমন আহাম্মেদ এর সাথে। উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসেন নাড়িপোতা নিজ গ্রামে। কেশরিয়ার মাঠে প্রায় সাড়ে তিন একর জমিতে পাড় বেঁধে প্রজেক্ট করেন। ধান চাষের পাশাপাশি মাছ চাষ করে সফলতার মুখও দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু কয়েক দিন আগে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার ও এসিল্যান্ড অফিসের সার্ভেয়ার এসে তার প্রজেক্টে লাল ফ্লাগ গাড়েন।
তহশিলদার জানান, প্রজেক্টের এক একর ঊনষাট শতাংশ জমি খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত। এ কথা শুনে সুমন আহাম্মেদ বিস্মিত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমার জমির সঠিক কাগজপত্র ও এসএ রেকর্ড রয়েছে। তবুও রেকর্ড পাইনি এটা হতাশাজনক। আশা করি, আদালতে ন্যায় বিচার পাব’।
মন্নেয়ার পাড় গ্রামের কৃষক তৈয়ব আলী জানান, কেশরিয়ার মাঠে তার চার বিঘা জমি রয়েছে। বর্তমান আরএস রেকর্ডে তার দুই বিঘা জমি রেকর্ড ও দুই বিঘা জমি খাস দেখানো হয়েছে। অথচ চার বিঘা জমির এসএ রেকর্ড ও সঠিক কাগজ রয়েছে। পরামর্শের জন্য গিয়েছিলেন ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। তহশিলদার তাকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন।
তৈয়ব আলী বলেন, ‘প্যাটোত ভাত না থাইকলে মামলা কইরমো কি দিয়া।
কৃষক আলহাজ মোজাফফর হোসেন, নুর হোসেন মাস্টার, আবুল কাশেম, মিনহাজ উদ্দিন, মাহমুদ হাসান, ফরিদ মিয়া, আবু হানিফ, মোতালেবসহ অনেকেই জানান তাদের সঠিক কাগজপত্র থাকার পরও আরএস রেকর্ড দেয়া হয়নি অথচ ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্ত দেয়া অনেক খাসজমি রেকর্ড দেয়া হয়েছে। এর জন্য তারা ভূমি জরিপ কর্মকর্তাদের সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতিকে দায়ী করেন। কেশরিয়ার মাঠের কৃষকদের জন্য বড় দুঃসংবাদ হলো, কেশরিয়ার তলা খনন করে মাছের প্রজেক্ট হবে।
জানা যায়, কেশরিয়া ইজারা দেয়া হয় বেশ কয়েক বছর ধরে। এবারের ইজারা পায় ভিতর বন্দ ইউনিয়ন ভূমিহীন মৎস্যজীবী সমিতি। ইজারা পাওয়ার পর থেকে তারা কেশরিয়ার তলা খনন করে মাছের প্রজেক্ট করার জন্য তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছে। সংসদ সংসদ্যের সাথে নিয়মিত দেনদরবারও করছে। কেশরিয়ার তলা খননের খবর শুনে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে এলাকার মানুষ। স্থানীয়ভাবে তারা মিটিং, মিছিল ও মানববন্ধন করেছে।
তাদের দাবি, কোনোভােেবই যেন উর্বরা কেশরিয়াকে খনন করা না হয়। কেননা এতে একদিকে যেমন কৃষিজমি কমে যাবে, পাশাপাশি ক্ষুদে কৃষকেরা আবারো ভ‚মিহীন হয়ে পড়বে। মাছের প্রজেক্টের জন্য যে উঁচু পাড় বাঁধা হবে বাঁধের উজানে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। ফলে এলাকায় মানুষ ও গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিবে।
বন্যার সময় গালাদীঘি, কচুয়া, ভগির দোলা, শুকতিয়া, পয়ড়া ডাংগা, ডুবাচুরিসহ বেশ কয়েকটি মাঠের পানি নামে কেশরিয়া দিয়ে। কাজেই এখানে প্রজেক্ট করা হলে পানির গতিপথ বাধা পেয়ে উজানে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার সৃষ্টি হবে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় কৃষিসহ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। হাজার হাজার কৃষক তাদের বীজতলা হারিয়ে ফেলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে।
ওই এলাকায় কৃষি, প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হবে। তাই এলাকবাসীর প্রাণের দাবি, গুটিকয়েক ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন এ অঞ্চলের হাজারো কৃষকের অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা কেশরিয়াকে হত্যা না করেন। আমরা জানি, বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন কোথাও যেন এক ইঞ্চি জমি পতিত না থাকে সেখানে কৃষি উর্বর কেশরিয়ার তলা খনন করা তার ঘোষণার সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা চাই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং ফসলি কেশরিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করবেন।
লেখক : সমাজকর্মী
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য