-->
শিরোনাম

আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করা বাজেট

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করা বাজেট

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৩৬ শতাংশ। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ আরো বড় হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। রেকর্ড এ বাজেট ঘাটতি পূরণ করতেই দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ বাড়াচ্ছে সরকার।

 

মধ্যে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি ব্যাংকিং খাত থেকে পূরণের লক্ষ্য রয়েছে। আর চলতি অর্থবছরে সরকার দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এক এপ্রিল মাসেই সরকার নিয়েছে ২৯ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা, যা মাস হিসেবে চলতি অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

 

আগামী অর্থবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি ঋণ নেবে সরকার। রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পাবলিক প্রকিউরমেন্টের জন্য তহবিলের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সরকারকে ব্যাংক ঋণ বেশি নিতে হচ্ছে।

 

অর্থাৎ আসছে অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি কমাতে ব্যাংকিং খাতের ওপর আরো বেশি নির্ভর করতে যাচ্ছে সরকার। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ কমে যাবে। পরিণামে বিনিয়োগের বৃদ্ধি ধীরগতির হয়ে যেতে পারে। জিডিপির অনুপাতে গত এক দশকে রাজস্ব আয় বাড়েনি। যদিও এ সময় জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণে ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটেছে।

 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশে সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এক দশক পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে।

 

আবার এ সময়ে কমেছে রাজস্ব আয়-জিডিপির অনুপাত। ২০১৪ সালে সরকারের রাজস্ব (কর ও অনুদান) জিডিপি অনুপাত ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। এক দশক পর তা নেমেছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। আর শুধু কর-জিডিপির অনুপাত নেমেছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে। ‘রাজস্ব আয়ে সরকারের ব্যর্থতার কারণে প্রতিবছর ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বাড়ছে।

 

বিশ্বের কোনো দেশই এত কম রাজস্ব আয় দিয়ে চলে না। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি বাড়ানো সম্ভব না হলে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়বেই। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অন্তত ২০-২২ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে সংকটের সমাধান হবে না।’

 

সঞ্চয়পত্রে সরকারের সুদের ব্যয় এক-তৃতীয়াংশ কমতে পারে। এতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। আগামী অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হতে পারে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আনুমানিক বাজেট ঘাটতি মোট জিডিপির ৫ দশমকি ২ শতাংশ।

 

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ অর্জন করতে চায়। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ।

 

এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ৯ এবং সরকারি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশের ঘাটতি বাজেট ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে করোনার কারণে গত দুই (২০২০-২১ ও ২০২১-২২) অর্থবছরে সেটি ৬ দশমিক ২ শতাংশের সীমা ছাড়িয়ে যায়। যদি সরকারের ব্যয়ের চেয়ে আয় কম হয়, তাহলে তাকে ঘাটতি বাজেট বলে।

 

সরকারি ব্যয় ও আয় সমান থাকলে সেটি সুষম বাজেট এবং ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হলে তাকে উদ্বৃত্ত বাজেট বলে। বাজেট প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও ঘাটতি বাজেটের পক্ষে জোরালো যুক্তিতর্ক খোঁজেন। উদ্বৃত্ত বাজেট দেয়ার পর্যায়ে দেশ পৌঁছেনি। আবার সুষম বাজেট দিয়ে বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই জনগণের জীবনযাত্রার মান ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করতে হলে অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হলে ঘাটতি বাজেটই শ্রেয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেটি আরো বেশি প্রযোজ্য।

 

ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে দেশের রাজস্ব নীতির লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত হয়। বাণিজ্য চক্রের উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে এ বাজেট প্রণয়ন করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায়। এ ছাড়াও মূলধন গঠনের জন্য এ বাজেটের কোনো বিকল্প নেই, বিশ্বব্যাপী যখন মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিতে রয়েছে। ঘাটতি বাজেটে দেশের অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহৃত হয় এবং উৎপাদন ও নিয়োগ বৃদ্ধি পায়।

 

যা মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে একটা স্তর পর্যন্ত প্রশমিত রাখতে পারে। বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা।

 

ফলে, চলতি অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এ বছর বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান পরিশোধ করতে হয় না। এ জন্য এটি সরকারের আয় মনে করা হয়।

 

বাজেটে এই ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য রাখতে হবে। সেজন্য অতিরিক্ত খরচ এড়িয়ে চলা, এখনি প্রয়োজন হবে না- এমন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা ঠিক হবে না। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কেবল জনতুষ্টিমূলক বাজেট দেয়ার সুযোগ সীমিত বলে মনে হয়। নির্বাচনের আগে আগে সব সরকারই জনতুষ্টিমূলক বাজেট দিতে চায়।

 

কিন্তু আর্থিক অবস্থা, রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক ঘাটতির কারণে সরকারের সামনে সে জন্য সুযোগ খুব সীমিত। সে রকম বড় কোনো চেষ্টা করতে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরে। ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে ৯৫ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা।

 

গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেটে আয়-ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি রাখা হয় অনুদানসহ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ দশমিক ১ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ছিল মোট ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে অনুদান ব্যতীত এই ঘাটতি রাখা হয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ছিল মোট ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে মোট ব্যয়ের আকার কাটছাঁট করে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। এতে করে শেষ পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতির আকারও কমে আসে।

 

অনুদানসহ নতুন ঘাটতি দাঁড়ায় ২ লাখ ১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির শতকরা হিসাবে এর ৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং অনুদান ছাড়া ২ লাখ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির শতকরা হিসাবে এর ৫ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ লাখ ৬০ হাজার ১৬০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ ছিল অনুদানসহ ১ লাখ ২৯ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা বা জিডিপির শতকরা হিসাবে ৪ দশমিক ২ ভাগ।

 

অনুদান ছাড়া ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির শতকরা হিসাবে ৪ দশমিক ৩ ভাগ।

 

বর্তমান অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেবল জনতুষ্টিমূলক বাজেট দেয়ার সুযোগ খুব সীমিত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সব সরকারই জনতুষ্টিমূলক বাজেট দিতে চায়। কিন্তু আর্থিক অবস্থা, রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক ঘাটতির কারণে সরকারের সামনে সে জন্য সুযোগ খুব সীমিত। সে রকম বড় কোনো চেষ্টা করতে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরে।

 

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version