-->

সোনালি ফসলের মায়ায়

শাইখ সিরাজ
সোনালি ফসলের মায়ায়

মাস চারেক আগে রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চার শিক্ষার্থীকে নিয়ে গিয়েছিলাম মুন্সীগঞ্জের উমপাড়া গ্রামে। ইট-কাঠ-পাথরের এই নাগরিক জীবন থেকে তারা গিয়েছিল শেকড়ের কাছে, কৃষকের মাঠে কৃষিকাজে। পরাগ, তাওহিদা, মারওয়া ও তাহমিদ এই চার তরুণ অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছিল এবারের ‘ফিরে চল মাটির টানে’ কার্যক্রমে। তারা কৃষক নূর হোসেনের মাঠে ধান রোপণ করে এসেছিল।

 

‘ফিরে চল মাটির টানে’ শহরের তরুণ শিক্ষার্থীদের গ্রামমুখী ও কৃষি অনুরাগী করে তোলার প্রচেষ্টায় চ্যানেল আইয়ের হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ উদ্যোগ। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যারা সাধারণত নগরেই বেড়ে উঠেছে তাদের ফসলের মাঠে, কৃষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, যেন তারা খুব কাছ থেকে গ্রামীণ জীবন ও কৃষি কার্যক্রম দেখার সুযোগ পায়।

 

খবর এসেছে ধান পেকেছে। ফলে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চার শিক্ষার্থীকে নিয়ে পুনরায় গিয়েছিলাম মুন্সীগঞ্জের উমপাড়া গ্রামে কৃষক নূর হোসেনের বাড়ি। তিন মাস আগে রোপণ করে আসা ধান কাটতে দারুণ আগ্রহ তাদের। আমরা যখন চ্যানেল আই থেকে রওনা হই তখন সবেমাত্র বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।

 

জাগতে শুরু করেছে নতুন দিনের প্রকৃতি। শহুরে এই শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রথমবারের মতো ধান রোপণ করতে এসে মাটির স্পর্শে দারুণ শিহরিত ছিল। এবারের শিহরণটা অন্যরকম। আকাক্সক্ষায় নতুন কিছু। ফসলের প্রতীক্ষা। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক ধরে খুব অল্প সময়েই আমরা পৌঁছে গেলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন কৃষক নূর হোসেন।

 

ধান কাটা নিয়ে কৃষক নূর হোসেনের বাড়িতে উৎসবের আমেজ। নূর হোসেনের স্ত্রী জেসমিনের মা-বোনরা এসেছে। তাদের বাড়িভর্তি মেহমান। চলছে রান্নাবান্নার কাজ, আমাদের নাস্তার আয়োজন। উঠোনে বসে চার শিক্ষার্থী মুগ্ধ চোখে দেখছিল গ্রামীণ মানুষের সকালের টুকিটাকি কাজগুলো। কাজে নামার আগে সকালের নাস্তার আমন্ত্রণ। খিচুড়ির সঙ্গে নানারকম ভর্তা আর ডিমের তরকারি।

 

নাস্তা সেরে মাঠে নামার পালা। নিজের হাতে লাগানো ধানগাছ বড় হয়ে ফসল দিয়েছে। সোনালি রঙের সেই ফসল। নিজেদের হাতে লাগানো ফসল দেখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল তাদের চোখে-মুখে।

 

জীবনে প্রথমবারের মতো ধান কাটবে তারা। দারুণ কৌতূহল। কিন্তু কীভাবে ধান কাটতে হয় সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তাই ধান কাটার কৌশল শিখিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু বিষয়টি সহজ নয়। বেশ কয়েকবার দেখিয়ে দেয়ার পরও ঠিকঠাকমতো পারছিল না তাদের অনভ্যস্ত হাত। রোদে শ্রমে ঘেমে একাকার। তবু কাঁচা হাতেই চালাল তারা পাকা ধান কাটার কাজ।

 

বলছিলাম দেখো, কৃষকরা কত কষ্ট করে ধান কাটে!

 

এ বছর এই এলাকায় ধানে চিঁটার পরিমাণ বেশি। কৃষকের কণ্ঠে হতাশা। এ নিয়ে কথা হলো স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে।

 

তিনি বললেন, কৃষকরা বছর বছর একই জাতের ধান চাষ করে আসছেন। নতুন উন্নত জাতের ধানগুলো চাষে আগ্রহী হচ্ছে না কৃষক। তাদের নতুন উন্নত জাতের ধান চাষে আগ্রহী করে তুলতে হবে।

 

একটা ধান মানেই একটা ভাত। এক প্লেট ভাত উৎপাদনের কষ্ট মর্মে অনুধাবন করতে পেরেছে শহরের এই শিক্ষার্থীরা। রোদে তাপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু থেমে যাচ্ছে না। তবে তাদের কাজের গতি দেখে এলাকার শিশু-কিশোরদের হাসাহাসি সহ্য করতে হচ্ছে।

 

আমি এলাকার দু-একজন কিশোরকে বললাম, এত হাসাহাসি করছ, নিজে কেটে দেখাও। তারা দিব্যি পারদর্শী কৃষকের মতো ধান কেটে দেখাল। তাদের দক্ষতা দেখে তরুণরাও অবাক হলো।

 

এর মাঝে ধানগাছের ধারালো পাতায় মারওয়ার হাত কেটে গেল। প্রয়োজন পড়ল প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার। টানা কাজ করতে করতে একটু বিশ্রামের আবেদন তাদের। বিশ্রামের ফাঁকে হয়ে গেল ছোট্ট একটা কুইজ প্রতিযোগিতা। তারা বলছিল, ধান রোপণের চেয়ে ধান কাটা কম কষ্ট নয়।

 

আমি বললাম, প্রায় তিন ঘণ্টায় তোমরা ৪ জন সাড়ে ৭ শতাংশ জমির আধেকটা পরিমাণ ধানও কাটতে পারনি। অথচ এই জমির ধান কাটতে একজন কৃষকের আধা ঘণ্টা সময় লাগবে। আর মেশিনে কাটলে ৫ মিনিটেরও কম সময়।

 

তারাও একমত হলো যে, সময় ও শ্রম বাঁচাতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই। পাশাপাশি একই জমি থেকে বেশি উৎপাদন পেতে হলেও যান্ত্রিককৃষির প্রয়োজনীয়তা আছে।

 

আবার ধানকাটা শুরু। দুপুরের মাঝেই ধান কেটে মাড়াইয়ের জন্য নিতে হবে। গতি এবার একটু বাড়ল। অবশেষে শেষ হলো ধান কাটা। তারপর ধান বয়ে নিয়ে যেতে হলো মাড়াইয়ের জন্য। বেশ অনেকটা পথ বয়ে নিতে হলো ধানের বোঝা।

 

এবার ধান মাড়াইয়ের পালা। সবাই মিলে লেগে গেল ধান মাড়াইয়ের কাজে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ধান কেমন হবে? পাবে কি কাক্সিক্ষত ফসল?

 

মেশিনে শুরু হলো ধান মাড়াইয়ের কাজ। তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, ভাগ্যিস গরু দিয়ে ঘুরে ঘুরে ধান মাড়াইয়ের কাজ করতে হচ্ছে না! ধান মাড়াই চলতে থাকল। আমি কথা বলছিলাম আশপাশের মানুষজনের সঙ্গে। উপস্থিত ছিলেন কৃষক নূর হোসেন ভাইয়ের স্ত্রী জেসমিনও।

 

প্রিয় পাঠক, আপনাদের মনে থাকতে পারে গতবার জেসমিনকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দেয়া হয়েছিল তার পার্লার ব্যবসার ডিজিটাল মার্কেটিং করার জন্য। তার কাছে জানতে চাইলাম, ব্যবসার কোনো উন্নয়ন হয়েছে কিনা। জেসমিন জানালেন, বউ সাজিয়ে ফেসবুকে ছবি দেয়ায় তার প্রচার বেড়েছে। নতুন নতুন কাস্টমারও আসছে।

 

এর মাঝে ধান মাড়াইয়ের কাজ শেষ হয়ে গেল। সফলভাবে নিজেদের দায়িত্বটুকু পালন করতে পেরে বেশ প্রফুল্ল চার শিক্ষার্থী। জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের হাতে ফলানো ফসল তারা সংগ্রহে রাখতে চাইল। কৃষক নূর হোসেন প্রত্যেককে অল্প করে ধান পলিব্যাগে দিয়ে দিলেন। আর শিখিয়ে দিলেন সংরক্ষণের জন্য কীভাবে ধান শুকাতে হবে। ধান শুকিয়ে কাচের পাত্রে তারা রেখে দেবে।

 

এবার ফেরার পালা। বিকেলের রোদ উজ্জ্বল সোনালি আভা ফেলেছে। মাটি থেকে সোনার ফসল ফলিয়ে আনার যে আনন্দ, পরিশ্রমে ক্লান্ত এ শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখেও তা ফুটে উঠেছে। জীবনের অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেছে। আমরা বিশ্বাস করি মাটির স্পর্শে পাওয়া অভিজ্ঞতা ওদের জীবন চিন্তায় আনবে নতুন মাত্রা।

 

যার টানে একদিন কোনো না কোনোভাবে ওরা মাটির কাছে ফিরবে। জীবনের একটি স্তরে গিয়ে ওরা নিশ্চয়ই কৃষি ও কৃষকের কথা ভাববে। তাদের মাধ্যমে একজন তরুণও যদি কৃষিতে অনুপ্রাণিত হয়, তবেই আমাদের এ আয়োজন সার্থক। কৃষিকে প্রাধান্য দিয়ে আগামীর টেকসই উন্নয়নের বাংলাদেশ রচিত হবে এই তরুণদের হাত ধরে এমনটাই প্রত্যাশা।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version