বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বসবাসের অযোগ্য হতে চলেছে পৃথিবী। তীব্র তাপপ্রবাহ, লু-হাওয়া, উত্তপ্ত সড়ক, জনপদ ও ভবনের কারণে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। প্রকৃতির ওপর যে মাত্রায় মানুষের নির্যাতন, বিপরীতে প্রকৃতিও করছে মানুষের প্রতি অনুরূপ বৈরী আচরণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রিনহাউস নিঃসরণের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে জলবায়ুতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় চলে গেছে অনাকাক্সিক্ষত পর্যায়ে। ইতোমধ্যে প্রলয়ঙ্করী ঝড়, জলোচ্ছাস, অতিবৃষ্টি থেকে ঘন ঘন মহাবন্যা, খরা থেকে মরুকরণ, খাপ খাওয়াতে না পেরে বিশেষ বিশেষ প্রজাতির বিলুপ্তি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে উপকূলীয় ও দ্বীপ দেশগুলো তলিয়ে যাওয়া এবং লবণাক্ততা বেড়ে সুপেয় পানির মারাত্মক অভাবের মুখে পড়েছে বিশ্ব। ধরিত্রী না বাঁচলে প্রাণিকুল বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ধরিত্রীকে বসবাসের যোগ্য রাখতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি।
জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎসারিত কার্বন গ্যাস তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শিল্পোন্নত, উদীয়মান ও স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যকার ধারণাগত পার্থক্যের কারণে বিশ্বায়িত কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। শিল্পোন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল হোতা। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভর করে গড়ে তুলেছে শিল্পোৎপাদনের বিশাল ক্ষমতা, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে উন্নত দেশের অর্থনীতি।
জীবাশ্ম জ্বালানি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী বলে বিকল্প উদ্ভাবনে উন্নত বিশ্বকে মনোযোগী হতে দেখা যায়নি। বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা কমাতে ইচ্ছুক নয়। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো অবদান না রাখলেও স্বল্পোন্নত ও গরিব দেশগুলো ধরিত্রীর রুদ্ররোষের শিকার হচ্ছে।
এটা সত্য, বিশ্বে ক্ষতিকারক কার্বন নিঃসরণের ৫০% হয়ে থাকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে। আবার এশিয়াই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল। স¤প্রতি ৫৬তম বার্ষিক সম্মেলনে এডিবির প্রেসিডেন্ট মাসাতসুন্ত আসাকাওয়া বলেন, ২০০০ সালের পর থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের যত বিপর্যয় ঘটেছে। তার ৪০% ঘটেছে এশিয়া ও প্যাসিফিকে। এতে ৩৫০ কোটির বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মারা গেছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ।
এডিবির হিসাবে জলবায়ু পরিবর্তন সমন্বয় করে যে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, তাতে কেবল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াই প্রয়োজন হবে ৩.১ ট্রিলিয়ন ডলার। ওই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন সংকট মোকাবিলার জন্য এডিবি ১০,০০০ কোটি ডলারের একটি নতুন ঋণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তবে ঋণের প্রক্রিয়াটি সহজ করার জন্য সবাই জোর দিয়েছেন।
বর্তমানে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়াজুড়ে যে নজিরবিহীন বন্যা, ঝড়, খরা ও তীব্র দাবানলের দুর্যোগ-দুর্বিপাক, তা পৃথিবীজুড়ে প্রকৃতির বৈরী প্রভাব। এ প্রভাব শুধু স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নীল দেশে নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার মতো উন্নত দেশেও ছোবল মারছে। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে, কি নির্মমভাবে শিল্পপতি/বিনিয়োগকারীরা পরিবেশের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে।
একদিকে শিল্প-কারখানার জন্য ভুগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে শত শত টন পানি, অন্যদিকে নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় ভরাট করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন। প্রকৃতির ফুসফুস বন-জঙ্গল উজাড় করা হচ্ছে নির্বিচারে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার উষ্ণতম স্থানের সঙ্গে শহরের বাইরে শীতলতম স্থানের দিন-রাতের ভ‚-পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষয়টা অনেকটা এমন, ঢাকার অদূরে সাভার বা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের যখন তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে, তখন রাজধানীর তেজগাঁও-ফার্মগেট এলাকার ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবার ঢাকার মধ্যেও ভূ-পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ে মিরপুর-চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকার তাপমাত্রা গুলশানের/মতিঝিলের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে।এতে বোঝা যায়, ঢাকার একটা বড় অংশ তাপীয় দ্বীপে (হিট আইল্যান্ড) পরিণত হয়েছে। এসব এলাকার উন্মুক্ত স্থানে গাছ লাগাতে হবে, বাড়ির ছাদে বাগান করতে হবে। ঢাকার চারপাশের নদী-খালগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে।
এ ছাড়াও শহরে জলাভূমি সৃষ্টি করতে হবে। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীর অপরিকল্পিত উন্নয়ন হয়েছে। সবুজ-জলাভূমি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের ভূ-পৃষ্ঠ এলাকায় ২৫.৩৩ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৬.২৫ শতাংশ।
এর ফলে ঢাকায় একটি অসহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা শহরের অধিবাসীদের জন্য খুব অস্বাস্থ্যকর ও অস্বস্তিকর। ঢাকা শহরের বাতাস ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় শহরে সবুজায়ন ঘটাতে না পারলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিরিক্ত কার্বনের ৫০ শতাংশ শোষণ করতে পারে পৃথিবীর সমুদ্র ও বৃক্ষরাজি। বাকি অর্ধেক বায়ুমÐলে অশোধিত থেকে মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে। প্রকৃত অর্থে প্রকৃতির কার্বন শোষণ ক্ষমতা শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে কার্বন সীমিতকরণ সংক্রান্ত চুক্তি কাগজে-কলমে হলেও বাস্তবে তা আলোর মুখ দেখেনি।
পরবর্তীতে অর্থাৎ ২০১৬ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (ইউএন সিসিসি) বিশ্বের ১৯৬টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে একটি বিশ্বায়িত কাঠামো চুক্তি সম্পাদন করে। ওই চুক্তির আওতায় বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সহায়তা পাবে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, ২০৬০ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে। বাস্তবে উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাবে না। কেননা, কার্বন পুড়িয়েই তাদের সমৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজার দখল ও সর্বোপরি পৃথিবী শাসন। বিদ্যুতের ব্যবহার হ্রাস, বায়োগ্যাস ও সোলার প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, যানবাহনের ব্যবহার সীমিত, শিল্প-কলকারখানায় ইটিপি নির্মাণ, আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাঁটি চালু, হিমায়িত খাদ্যের পরিবর্তে তাজা খাদ্য গ্রহণই পরিবেশের রক্ষাকবচ। মানুষের সীমাহীন লোভ ও ভোগবাদিতার লাগাম টেনে না ধরলে এমন একদিন আসবে, যখন প্রাসাদতুল্য ভবনগুলো ফাঁকা পড়ে থাকবে। প্রাচুর্যভরা শহর-নগর হয়ে পড়বে জনশূন্য।
এহেন পরিস্থিতিতে ধরিত্রী রক্ষায় পরিবেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার এখনই সময়। তাই পরিবেশ রক্ষাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য সবাইকে আন্তরিক সদিচ্ছা ও সক্রিয় উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বলতে হবে এটা আমাদের সবার পৃথিবী। এ পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে। সবুজে সবুজে ভরে তুলতে হবে গ্রামাঞ্চল, নগরায়ণ ও শিল্পাঞ্চল।
লেখক : অধ্যাপক ও সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ঢাকা
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য