বিদ্যমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জোর তাগিদ রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। চলতি বাজেট ঘোষণায় কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি খাতের জন্য ৩৫,৩৭৪ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব হলে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে।
খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রতি একক জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত যেমন জরুরি, তেমনি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির বিস্তার ও ব্যবহার অনস্বীকার্য। দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিনিয়ত নব নব কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২১১টি ফসলের ওপর গবেষণা করে এ যাবৎকাল প্রায় ১২০০ এর মতো কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিরি), বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ নার্সভুক্ত ১৪টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে যাচ্ছে।
প্রতিটি উদ্ভাবন দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যেসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তার দ্রুত আপ-স্কেলিং বা পাইলট প্রোডাকশন দরকার। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ মাঠপর্যায়ে দ্রæত বিস্তার ঘটাতে বা কৃষকদের নিকট আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলতে করণীয় কি, সেসব বিষয় আলোচনার দাবি রাখে।
কৃষি প্রযুক্তি বলতে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান, কৌশল, এবং যন্ত্রপাতির প্রয়োগ বা ব্যবহারকে বোঝায় যা তুলনামূলকভাবে কম সময়ে, কম খরচে, প্রতিকূল পরিবেশে কৃষি কাজ পরিচালনা বা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে কৃষকের আয় বাড়ানো যায়। সহজ কথায়, যে প্রযুক্তি বা কলাকৌশলের প্রয়োগে কৃষি উৎপাদনকে সহজ, সাশ্রয়ী ও গতিশীল করে তাকে কৃষি প্রযুক্তি বলে।
ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত যেমন বারি আম-৪, বারি সরিষা-১৪, বারি হাইব্রিড টমেটো-৮, বিনা ধান-২৫, বিরি ধান-১০০, ধানের কম্বাইন্ড হারভেস্টর, হাইড্রলিক ম্যাংগো হারভেস্টর ইত্যাদি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির উদাহরণ হতে পারে। কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন একটি চলমান ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তাই গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
আশার কথা সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সাত হাজার ২১৪ কোটি টাকার সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনরশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স (পার্টনার) গত ১৮ এপ্রিল ২০২৩ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি প্রযুক্তিসমূহ মাঠপর্যায়ে আরও ব্যাপক আকারে বিস্তার ঘটবে বলে আশা করা যায়।
কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন, বিস্তার ও গ্রহণযোগ্যতা এ তিনটির একটি অন্যটির পরিপূরক। একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি যদি মাঠপর্যায়ে বিস্তার না ঘটে অথবা কৃষকের নিকট গ্রহণযোগ্যতা না পায়, তাহলে সেই প্রযুক্তিটি এক সময় হারিয়ে যায় অথবা স্থায়িত্ব হারায়। তাই প্রযুক্তি টেকসই হতে হবে।
আর টেকসই প্রযুক্তি বলতে এটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে; অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে হবে; কারিগরি দিক থেকে নমনীয় বা সহজবোধ্য হতে হবে এবং সে সঙ্গে পরিবেশবান্ধব হতে হবে। তাই অ্যাডভান্স প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি সাসটেইনেবল টেকনোলজির দিকে বেশি মনোনিবেশ করা দরকার।
দেশের কৃষি বিশ্বের দরবারে এখন রোল-মডেল। কোভিড-১৯ এ বিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থার টালমাটাল অবস্থায় ও এ দেশের কৃষি খাদ্য জোগানে পিছপা হয়নি। সরকারে প্রণোদনা সহায়তা, কৃষি নীতিমালা ও সরকারের গৃহীত বহুমুখী পদক্ষেপ কৃষিকে করেছে সমৃদ্ধ। কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ ও কৌতূহল অনেক। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সমূহের তথ্য প্রবাহ ও প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো গেলে এর পরিচিতি বাড়বে।
সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত জনপ্রিয় ও লাগসই প্রযুক্তির ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপস সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ সাড়া ফেলেছে। এটি সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানতে সহায়তা করছে। উদ্যোগটি প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রযুক্তি স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে পাঁচটি ধাপে ব্যাখ্যা করা যায় যেমন- গ্রাহকদের লক্ষ্য রেখে প্রযুক্তি উদ্ভাবন, প্রযুক্তি নিশ্চিতকরণ, প্রযুক্তি বিপণন, প্রযুক্তি প্রয়োগ, এবং প্রযুক্তি মূল্যায়ন। প্রযুক্তি হস্তান্তরের অনেক উপায় রয়েছে। তার মধ্যে লাগসই প্রযুক্তিসমূহের প্রদর্শনী স্থাপন; উঠান বৈঠক; ব্যক্তিগত এবং দলগত যোগাযোগ ও আলোচনা; প্রশিক্ষণ; মাঠ দিবস; ফার্মারস র্যালি; কৃষি মেলা; বীজ মেলা ও বীজ সহায়তা; কৃষক পর্যায়ে বীজ উৎপাদন; গ্রামীণ পর্যায়ে কমিউনিটিভিত্তিক বীজ ব্যাংক স্থাপন; বীজ সরবরাহ কেন্দ্র স্থাপন; ডিলার/স্থানীয় নার্সারিদের নিকট বীজ/চারা/কলমের সহজপ্রাপ্যতা; সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির লিফলেট, বুকলেট, বুলেটিন, পোস্টার ও প্রযুক্তি বার্তা বিতরণ; প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রযুক্তিসমূহের প্রচার; ইউটিউব চ্যানেলে ছোট্ট ছোট্ট ভিডিও আপলোড, খামার পর্যায়ে বীজ উৎপাদন ও বিতরণ; মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তির উপযোগিতা যাচাই পরীক্ষা ইত্যাদি।
এসব উপায়ের মধ্যে কোন উপায়টি বেশ কার্যকর বা আরো অন্য কোনো সহজ উপায় আছে কিনা তা খতিয়ে দেখে জুতসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে সুফল মিলবে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ঘানার উত্তর ও উচ্চ পূর্ব অঞ্চলের ৫৪৩ জন ধান চাষির কাছ থেকে সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্য ব্যবহার করে বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তি স্থানান্তর পদ্ধতির কার্যকারিতা পরীক্ষার এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রদর্শনী, কৃষক থেকে কৃষক এবং আইসিটি, ভিডিও, মোবাইল ফোন এবং রেডিওর মতো গণমাধ্যম ব্যবহারকে কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণের কার্যকর উপায় বলে চিহ্নিত করেছে।
নেদারল্যান্ডসের WAGENINGEN University & Research কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তরবিষয়ক এক প্রকল্পে কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তরে বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তারা গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এক্সটেনশন সিস্টেম এবং স্থানীয় উৎপাদকদের বিভিন্ন উন্নয়ন ও প্রচারের জন্য বাজার চালিত পদ্ধতির সঙ্গে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের নেতৃত্বাধীন কৃষি প্রযুক্তি স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে মূল হিসেবে দেখেছেন।
কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তরে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে, যেমন- প্রযুক্তি সম্পর্কে যথাযথ তথ্যের অভাব; প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সক্ষমতা; মূলধনের অভাব, উচ্চ উৎপাদন খরচ এবং বাণিজ্য ও নীতিগত বাধা; প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত দুর্বলতা যেমন বীজ সংরক্ষণাগার বা কোল্ড চেম্বার না থাকা; প্রত্যন্ত এলাকার কৃষক পর্যায়ে বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণে দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব; ব্যবসায়িক সীমাবদ্ধতা (ঝুঁকি গ্রহণে বিমুখতা) এবং বীজের মান-উন্নয়ন বা স্ট্যান্ডারাইজেশন ইত্যাদির অভাব তো রয়েছেই। যদিও বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি (এসসিআই) সীমিত জনবল নিয়ে বীজ প্রত্যয়নের কাজ করে যাচ্ছে।
কৃষিকে পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ করতে কৃষকের চাহিদামাফিক উন্নত জাতের বীজ, চারা, কলম ও যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা একান্ত জরুরি। যেসব ফসলের উন্নত জাতসমূহ ইতোমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেসবের পাইলট প্রোডাকশনে বা আপ-স্কেলিংয়ে যেতে হবে। কমিউনিটিভিত্তিক বীজ উৎপাদনে আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাতে কৃষক নিজেরাই নিজেদের উৎপাদিত বীজ সহজে ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
যদিও সব ফসলের বীজ কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন করা কঠিন, সেক্ষেত্রে যেসব ফসলের বীজ সহজে কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন করা যায়, তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা তথা প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারের এ ধরনের অনেক প্রকল্প চলমান রয়েছে। ভালো ও মানঘোষিত বীজ উৎপাদনকারীকে পুরস্কার প্রদান করা যেতে পারে, মিডিয়াতে তার সফলতার সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরতে পারে। তাতে সে আরও বেশি উৎসাহিত হবে। যদিও বর্তমানে অনেক প্রচার মাধ্যম কৃষির সফলতা নিয়ে বেশ সোচ্চার। এটি একটি ইতিবাচক দিক।
প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়া সামগ্রিক কৃষি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান উপাদান। এই প্রক্রিয়াটি তিনটি ধাপে সম্পন্ন করা যেতে পারে। যেমন রিসার্চ সিস্টেম (মৌলিক ও ফলিত গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তির উন্নয়ন); এক্সটেনশন সিস্টেম দোভাষী, প্রচারক এবং সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে প্রযুক্তির স্থানান্তর করা এবং ক্লায়েন্ট সিস্টেম (কৃষকদের দ্বারা প্রযুক্তির ব্যবহার, অর্থাৎ কৃষকদের লক্ষ্য গোষ্ঠী যারা তাদের বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থায় প্রযুক্তি গ্রহণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে)।
প্রযুক্তি হস্তান্তরের পর প্রযুক্তিটি কৃষকের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পেল, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। প্রযুক্তিটির গ্রহণযোগ্যতার ওপর এর স্থায়িত্ব নির্ভর করে। তাই লোকেশন স্পেসিফিক, টাইম স্পেসিফিক এবং চাহিদা নির্ভর প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিস্তার একান্ত কাম্য। পার্টনার প্রকল্পে এসবের দেখা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, কুমিল্লা;
সাবেক ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট, এফএও-জাতিসংঘ।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য