-->

ওয়াশিংটনের চাপিয়ে দেয়া নিয়মে ইলেকশন?

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
ওয়াশিংটনের চাপিয়ে দেয়া নিয়মে ইলেকশন?

নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই মানুষের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে যে মার্কিন প্রেসক্রিপশন আগামী নির্বাচনে প্রয়োগের চাপ ঢাকা থেকেই শুধু নয়, সুদূর ওয়াশিংটন থেকেও বেশ প্রকাশ্যেই শুরু করা হয়েছে। এ নিয়ে দেশের রাজনীতিতে বেশকিছু আলামতও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটি গোষ্ঠী চড়া সুরেই নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে, অন্য শক্তি সামলে নেয়ার মতো করেই চলছে বলে মনে হচ্ছে।

 

এরই মধ্যে রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির প্রায় ১০ বছর পর প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পেয়েছে। তাদের ঐতিহাসিক মিত্র বিএনপির নেতৃত্ব এটিকে জামায়াতের ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ হিসেবে অভিহিত করছে। এতেই বোঝা যায়, বিএনপি মাঠের আন্দোলনে তার দীর্ঘদিনের ‘পরীক্ষিত’ বন্ধু জামায়াতকে পেয়ে খুশি!

 

বলা হয়ে থাকে, মার্কিন ভিসানীতির অন্যতম শর্তই হচ্ছে অবাধ নির্বাচনে অংশ নিতে কাউকে বাধা দেয়া যাবে না। সেটি দেশে এখন প্রতিপালিত হতে যাচ্ছে। জামায়াতকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া

 

হলে ভিসানীতির বরখেলাপের অভিযোগ ওয়াশিংটনে স্তূপীকৃত হবে। অথচ জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সেক্যুলার গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক ইত্যাদির বিরুদ্ধেই আগাগোড়াই অবস্থান করেছে। বিএনপি আদর্শগতভাবে কখনোই অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেনি, বরং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে বাংলাদেশে কঠিন করার ‘ঐতিহাসিক’ দায়িত্ব পালন করে এসেছে।

 

একদিকে মুখে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলা হয়, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও ’৭৫-এর ঘাতকসহ স্বাধীনতাবিরোধী সব অপশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ও সখ্য বজায় রেখে চলছে। বিএনপির এই দ্বিচারিতা রাজনীতি সচেতন কারো কাছেই নতুন নয়, অজানাও নয়। বিএনপি এসব রাজনৈতিক ‘শক্তিকে’ সব সময় তাদের মিত্র দল হিসেবে অতীতে যেমন পেয়েছে, বর্তমানেও পাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিএনপি সরকারবিরোধী যে মোর্চা গড়ে তুলেছিল তাতে নামসর্বস্ব কিছু অতিডান, অতিবাম দল এবং ব্যক্তিকেই কেবল পেয়েছিল। জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি এতদিন তারা অস্বীকার করে এসেছিল। মূলত পশ্চিমা বিশ্বকে জামায়াত থেকে তাদের দূরত্বের অবস্থানের কথা বোঝানোর জন্য তা করেছিল।

 

এখন মনে হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বেরও তাতে কিছু যায় আসে না। যে পশ্চিমা বিশ্বকে আমরা উদার, সেক্যুলার গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে এসেছি, তারা আসলে এখন আর সেই অবস্থানে নেই।

 

ভূরাজনৈতিক স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেদিকে অবস্থান নেবে তাদের বিপরীতে যাওয়ার কোনো লক্ষণ ওই সব দেশে দেখা যায় না। এটিও আরেকটি মৌলিক অবনমিত অবস্থান। এরই প্রমাণ সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার কূটনৈতিক মহলে লক্ষ্য করা গেছে।

 

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন দূতাবাসই শুধু নয়, জাপান, ইউরোপীয় কিছু কিছু দেশও অনেকটা এক সুরেই যেন কথা বলতে শুরু করেছে। যদিও ভাষার প্রয়োগে অনেকে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতার কথাই বেশি বলছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের যে ধারণা দিচ্ছেন, তাতে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক শক্তি সম্মতি দেবে সেদিকেই বা সেটির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্র দেশগুলোর অবস্থান ও সমর্থন জুটবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

যদি মার্কিন ভিসানীতির ব্যাপারে মার্কিন কর্তৃপক্ষ দলমত নির্বিশেষে একই নীতি অনুসরণে অনড় থাকার অবস্থান বজায় রাখত তাহলে গাজীপুরসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে যারা ভোটদান কিংবা প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে তাদের এই বিষয়টিকে ভিসানীতির পরিপন্থি হিসেবে ভাবা হচ্ছে না কেন?

 

যেকোনো নাগরিক স্বাধীনভাবে দল নির্বাচন কিংবা ভোটদান করতে পারে। কিন্তু বিএনপি এরই মধ্যে তার দলের নেতাকর্মীদের যেসব সিটি ও পৌর করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দিচ্ছে সেটিকে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বললে কি ভুল বলা হবে?

 

দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু এবং অবাধ হলেই কি চলবে? অন্য সব নির্বাচনও তো অবাধ এবং সুষ্ঠু হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে কারো কোনো যেন মাথাব্যথা নেই। হয়তো অনেকে বলবেন বিষয়টি এখনো অনেকেরই ধর্তব্যের মধ্যে আসেনি।

 

সে কারণেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না, ভিসানীতির বরখেলাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। তবে যে বিষয়টি মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশের জন্য অনেকটা যেন প্রযোজ্য হয়ে গেছে, তা হচ্ছে গণতন্ত্রের শত্রু মিত্র বলে কেউ নেই। সবার অধিকার আছে, যা খুশি তা বলার কিংবা করার। কিন্তু এমন গণতন্ত্র তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নেই, ইউরোপের দেশগুলোতেও নেই। একসময় স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও দেয়া হয়নি।

 

একটি মুসলিম প্রধান দেশে ওইটুকু পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষেত্রে কী পরিমাণ অসহযোগিতা দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে থেকে ছিল সেটি যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ-পরবর্তীকালীন সময়ে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো থেকেও সহানুভূতি ও সহযোগিতা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়নি।

 

বরং রাষ্ট্রব্যবস্থাটিই যেন চার মৌল নীতিতে গড়ে উঠতে না পারে সেই লক্ষ্যেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী সহযোগিতা করেছিল অভ্যন্তরের নানা অপশক্তিকে। তারাই সেই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডটি সংঘটিত করেছিল যা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীও ঘটাতে সাহস পায়নি। এরপর ক্ষমতাকে সামরিক একক কর্তৃত্ববাদী শাসন দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হয়েছিল।

 

স্বাধীনতাবিরোধী সব অপশক্তিকে রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষাব্যবস্থাসহ সর্বত্রই কেবল তাদের জন্য খুলে দেয়া হলো। ফলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, ত্যাগী, আদর্শবাদী, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি চরম বিপাকে পড়ে দুর্বল এবং ক্রমেই নিঃশেষিত হতে থাকে, সেই স্থলে সাম্প্রদায়িক, উগ্র, হঠকারী, দুর্নীতিপরায়ণ এবং পশ্চাৎপদ প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারার নানা গোষ্ঠী ও অপশক্তি প্রশাসন, বিভিন্ন বাহিনী, রাষ্ট্র রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। এ যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ষোড়শ শতকে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী স্যার টমাস গ্রেসামের (১৫১৯-১৫৭৯) বিখ্যাত অর্থনৈতিক তত্ত 'Bad money drives out good' অর্থাৎ ‘খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে বাজার থেকে বের করে দেয়’।

 

রাজনীতিতেও অপশক্তি শুভশক্তিকে হঠিয়ে দেয়। সেটি বাংলাদেশে ’৭৫-এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে ঘটে এসেছে। মূলত সাম্প্রদায়িক ও সুবিধাবাদী অপশক্তি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের অবস্থানকে এতটাই শক্তপোক্ত করতে পেরেছে যে সেখানে ন্যূনতম যুক্তিবাদ, গণতান্ত্রিক চিন্তা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বোধ ও চর্চা সমাজের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে।

 

এমনকি আমাদের দেশে এ অবস্থা ষাটের দশকেও ছিল না। কিন্তু আমরা বলব না তখন একেবারেই ছিল না। তবে সময়ের নিরিখে বিবেচনা করলে তখন সাম্প্রদায়িকতার জায়গা বর্তমানের চেয়ে অনেক দুর্বল ছিল।

 

খুব বেশি দূরের নয়, ২০০১-০৬ সালে সাম্প্রদায়িকতার যে বিবর্ণ ও কৃষ্ণকায় চিত্রের প্রকাশ ঘটেছিল সেটি আমাদের সমাজের অভ্যন্তরে মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিমূলকে একেবারে নড়বড়ে অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০০৯-১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে যুদ্ধপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির, বিএনপি এবং হেফাজত চক্রের যে চতুর্মুখী আক্রমণ মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল সেটি আরব বসন্তের নামেই ক্ষমতা বদলের নিরন্তর ষড়যন্ত্র হিসেবে ঘটেছিল।

 

চেষ্টা হয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতাকে দখল করে ‘আরব বসন্তের’ পরিবর্তন ঘটানো। কিন্তু সেটিকে রাষ্ট্র, সমাজ এবং সরকারের অসাম্প্রদায়িক শক্তির দৃঢ়তা দিয়েই নিবৃত্ত করা গেছে। সেই অপশক্তি ২০১৪-এর নির্বাচন প্রতিহত করেছে, ২০১৮-এ ভোট বিপ্লবের স্লোগান তুলেছে। এখন তারাই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটাধিকারের জন্য তলে তলে শুধু ঐক্যবদ্ধ হয়নি, বিদেশি বিভিন্ন দেশ এবং শক্তিকে তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য পাশে নেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে।

 

এ শক্তি অসাম্প্রদায়িকতায় কখনই বিশ্বাস করেনি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এখনো তারা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য তাদের বিশ্বাসের জায়গাতে নেই। সুতরাং যারা এখন এই অপশক্তিকে ‘গণতান্ত্রিক’ শক্তি হিসেবে স্পেস দেবে, তারাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করার সুযোগ করে দেবে। যেটি মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই কমবেশি ঘটেছে, বাংলাদেশে সেই মহড়াই যেন চলছে। যে উন্নয়ন বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ঘটেছে, সেটির বিনাশ ঘটতে মোটেও তখন সময় লাগবে না।

 

সুতরাং অগণতান্ত্রিক শক্তির গণতন্ত্র প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তির জন্যই শুধু নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ হয়ে যেন আসার পথ কেউ কেউ খুঁড়ে দিচ্ছেন। দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং অসাম্প্রদায়িকতায় যারা বিশ্বাস করেন তাদের সম্মুখে নতুন এক লড়াইয়ের বাস্তবতাই যেন শোনা যাচ্ছে। সেই লড়াইতে যদি জনগণকে সম্পৃক্ত করা না যায় তাহলে নির্বাচন, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কিছুই অবশিষ্ট থাকার আশা করা যাবে না।

 

লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version