২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সংসদে নয়া বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি তার পঞ্চম বাজেট। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের এটি ১৫তম ও সর্বশেষ বাজেট। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ২০তম বাজেট এটি। এ সরকারের আমলে বাজেটের আকার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট বাজেটের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।
১৪ বছর পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা ৬৮৯.২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেট ১২.৩৫ শতাংশ বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৫.৩৩ শতাংশ বেশি। এ বাজেটের আকার হচ্ছে জিডিপির ১৫.২১ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের মূলবাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা ছিল জিডিপির ১৫.২৩ শতাংশ। স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত নয়া বাজেট ওই বাজেট থেকে ৯৯৬ গুণ বেশি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাজেট বাস্তবায়নে। তার প্রধান কারণ, কাক্সিক্ষত মাত্রায় রাজস্ব আহরণে ঝুঁকি। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর উৎস থেকে আসবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হতে হবে প্রায় ১৬.২ শতাংশ।
সাম্প্রতিক বৈশ্বিক মন্দা, ডলার সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা খুবই কঠিন হবে। তা ছাড়া নির্বাচনের আগের ও পরের ছয় মাস অর্থনীতির গতি থাকে অনেকটা মন্থর। তাতে হ্রাস পেতে পারে রাজস্ব আহরণ।
গত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭.৫ শতাংশ। পরে তা নামিয়ে দেয়া হয় ৬.৫ শতাংশে। প্রাথমিক হিসাবে অর্জনের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম, ৬.০৩ শতাংশ। আগামী বছরের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। তবে আগামী বাজেট বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনক না হলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৬ শতাংশ। বাস্তবে এটা আরো বেশি হবে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে।
গত মার্চ মাসে ছিল ৯.৩৩ শতাংশ, এপ্রিলে ৯.২৪ এবং মে মাসে ৯.৯৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট ও জ্বালানি সংকটের কারণে মূলত এই মূল্যস্ফীতি। তদুপরি প্রস্তাবিত বাজেটের বিশাল ঘাটতি মেটাতে সরকারকে বড় আকারের ঋণ গ্রহণের জন্য নির্ভর করতে হবে ব্যাংকিং খাতের ওপর। তাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হবে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বাজেটের আকার হচ্ছে বিশাল থেকে বিশালতর। জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না কাক্সিক্ষত হারে। বিনিয়োগও তেমন বেশি বাড়ছে না। অপরদিকে মানুষের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। হ্রাস পাচ্ছে সরকারি খরচের গুণগত মান। এবার বাজেটের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে মূলত জনপ্রশাসনে ও স্থানীয় সরকারে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ বৃদ্ধির কারণে। এ দুটি খাতে গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৩১.৩৪ এবং ১১.৯৮ শতাংশ। নির্বাচনের আগে এ দুটো খাতের অগ্রাধিকার বেশি বলে মনে হচ্ছে। অন্যান্য খাতে বাজেটের প্রবৃদ্ধির হার অপেক্ষাকৃত কম।
আগামী অর্থবছরে কৃষিবিষয়ক ৫টি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৩ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। এ টাকা মোট বরাদ্দের ৫.৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে শস্য কৃষি খাতের জন্য রাখা হয়েছে ২৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। যা মোট বরাদ্দের ৩.৩৩ শতাংশ। বাকি ২.৪১ শতাংশ মৎস্য ও পশুসম্পদ, বন ও পরিবেশ, ভ‚মি ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়সমূহের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এটা খুবই অপ্রতুল। দিনের পর দিন বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা হ্রাস পাচ্ছে। ২০১১-১২ সালে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা ছিল মোট বাজেটের ১০.৬৫ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে তা ৬.২ শতাংশে হ্রাস পায়। এবার তা নেমে এসেছে ৫.৭ শতাংশে। এর কারণ, যে হারে মোট বাজেট বাড়ছে, সে হারে কৃষি খাতের বাজেট বাড়ছে না। এবার মূল বাজেট বেড়েছে ১২.৩৫ শতাংশ, কৃষি বাজেট বেড়েছে ৩.৭ শতাংশ। জিডিপিতে বৃহত্তর কৃষি খাতের শরিকানা এখনো প্রায় ১২ শতাংশ। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমরা পুরোপুরি নির্ভরশীল কৃষি খাতের ওপর। সে কারণে মোট বাজেটে কৃষি খাতের শরিকানা ন্যূনপক্ষে এর মোট অবদানের সমানুপাতিক হওয়া উচিত।
২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০০২৩-২৪ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৩.৭৮ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ৯ শতাংশ বাদ দিলে কৃষি খাতের জন্য প্রকৃত বরাদ্দ কমে গেছে ৫.৩ শতাংশ। শস্য কৃষি খাত অর্থাৎ কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৮৯৪ কোটি টাকা। এখানে মোট বৃদ্ধি ৩.৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হিসাব আমলে নিলে শস্য কৃষি খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ঋণাত্মক।
কৃষি ভর্তুকির ক্ষেত্রে আপেক্ষিক বরাদ্দ হ্রাসের বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ফসল খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল মোট বাজেটের ৬.৩৪ শতাংশ। ক্রমে তা হ্রাস পেয়ে ২০২৩-২৪ সালে ২.২৩ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। এবার কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। যা গত বছরের মূল বাজেট থেকে ১ হাজার ৬ কোটি টাকা বেশি।
কিন্তু সংশোধিত বাজেট থেকে তা ৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকা কম। আগামী দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস পেলে এ ভর্তুকিতে হয়তো চলবে। নতুবা অভ্যন্তরীণ বাজারে কৃষি উপকরণের দাম বাড়বে। তাতে বিঘ্নিত হবে কৃষির উৎপাদন।
কৃষি ও শিল্প খাতকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে কাজ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত। এ দুটো খাত মানব উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত। উল্লিখিত দুটো খাতের বরাদ্দ বেড়েছে অপেক্ষাকৃত কম। স্বাস্থ্য খাতে ৩.২৩ শতাংশ এবং শিক্ষা খাতে ৮.১৬ শতাংশ। অন্যান্য সেবা ও সহায়তাধর্মী খাতসমূহ থেকে কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দের প্রবৃদ্ধি বেশি হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হতে পারে। এবারের বাজেটে তেমন প্রতিফলন নেই।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১২৬৮ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজ কল্যাণ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪০ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। গত সংশোধিত বাজেটে ছিল ৩৯ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। বরাদ্দ বৃদ্ধির হার ৩.২৪ শতাংশ।
এ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে একত্রে, পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে (সমাজ কল্যাণ, মহিলা ও শিশু, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মুক্তিযুদ্ধ)। এক্ষেত্রে বয়স্ক ভাতা প্রতিমাসে ১০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬০০ টাকা আর বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী ভাতা ৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫৫০ টাকা। এ ভাতার পরিমাণ ন্যূনপক্ষে ১০০০ টাকা হওয়া উচিত।
প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। মহিলা ও ৬৫ বছরের বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৪ লাখ টাকায় নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া ব্যক্তি করদাতার নিট সম্পদের ওপর সারচার্জ আরোপের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সীমা ৩ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নিট পরিসম্পদের সর্বোচ্চ সীমা ৫০ কোটি টাকা অতিক্রম করলে সারচার্যের পরিমাণ হবে ৩৫ শতাংশ।
সাম্প্রতিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে করদাতাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। সে প্ররিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বাড়ানোর প্রস্তাব যৌক্তিক। একই কারণে নিট সম্পদের ওপর সারচার্য আরোপের ন্যূনতম সীমা বাড়ানোর প্রস্তাবও গ্রহণযোগ্য। রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র হিসেবে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর বাধ্যতামূলক করার বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য।
যাদের টিআইএন আছে, তাদের আয়ও আছে। যাদের আয় নেই, যারা গরিব, তাদের জন্য টিআইএন বাধ্যতামূলক নয়। অতএব, যাদের আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে এবং যাদের টিআইএন আছে তাদের বছরে মাত্র ২ হাজার টাকা দিয়ে গর্বিত আয়কর দাতা হিসেবে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কাজে অংশ নিতে আগ্রহ থাকা উচিত। বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না রাখার জন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
বাজেট বক্তৃতার উপসংহারে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের আপামর জনসাধারণ ও সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আমাদের সম্পদ ও প্রাণশক্তি। তাদের আশা-প্রত্যাশা ও উন্নয়ন ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে সাজানো হয়েছে প্রস্তাবিত নয়া বাজেট। তিনি আশা করেছেন, এ বাজেট বাস্তবায়নে অর্থনীতি আরো শক্তিশালী ও বেগবান হবে।
তাতে স্মার্ট সমাজ, স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট অর্থনীতি গঠনের পথ সুগম হবে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত জ্ঞানভিত্তিক উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রস্তাবিত বাজেটের অনেক সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও এর দার্শনিক ভিত্তি মহৎ। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটের সফল বাস্তবায়ন কামনা করি।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য