-->
শিরোনাম

ধলাই নদী অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে

পাভেল পার্থ
ধলাই নদী অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে

এই গ্রহে নদীই সর্বব্যাপী ক্ষত নিয়ে গড়িয়ে চলা এক জীবন্ত প্রাণসত্তা। বেঁচে থাকার জন্য কোনো জীবিত প্রাণের শরীরের সব অংশের সুস্থতাই জরুরি। অস্থি-মজ্জা-হাড়-মাংস কিংবা শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ; কিন্তু আমরা চারধারে কী দেখি। এই নদীর হাত নেই, তো ওই নদীর চোখ তুলে ফেলা হয়েছে। কোনো নদীর কলিজা পিষে দেয়া হয়েছে, কোনো নদীর শরীর থেকে ধড় আলাদা করা হয়েছে। খুব কম নদীকেই আমরা মাথায় চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ অবধি আপাদমস্তক সুস্থ খুঁজে পাব।

 

নদীর জন্য সবচেয়ে কঠিন হলো উজান থেকে ভাটিতে গড়িয়ে চলার পথের ‘অতি সাধারণ নিরাপত্তা’। এটি কুসুম কুসুম ফুলের বিছানা বা মসৃণ মাটি কিংবা উত্তল পাথরের চাঁই নয়। কিংবা নদীর গড়িয়ে চলা পথের মামুলি নিরাপত্তার জন্য সমরাস্ত্র কারখানা বা জলপাই বাহিনীরও কোনো প্রয়োজন নেই। এর জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বা জাতিসংঘের কোনো বৈঠকেরও দরকার নেই। শুধু নদীর উজান থেকে ভাটিতে গড়িয়ে চলার পথকে বাধা না দিলেই হলো।

 

কিন্তু এখানেই যত বগলবাজি, বাণিজ্য কিংবা বাহাদুরি। যে যেভাবে পারছে এক একটা নদীতে উজান থেকে ভাটিতে সর্বত্র কুপিয়ে পিটিয়ে থেঁতলে প্রতিদিন খুন-ধর্ষণ করে চলেছে। বিশেষ করে উজানে ও উৎসমুখে নদীগুলো জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বৃহৎ অবকাঠামো কিংবা বৃহৎ বাঁধের কাছে বন্দি। উন্নয়নের এই কারাগার থেকে খুব কম জলধারাই মুক্তি পেয়ে ভাটিতে গড়ায়।

 

অধিকাংশের নিয়তি হয় পায়ে ডান্ডা বেড়ি আর শেকল নিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে গড়িয়ে চলা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদে আছে আমাদের আন্তঃসীমান্ত অভিন্ন নদীগুলো। সবটির উজানেই ভারতীয় অংশে তৈরি হয়েছে নানা স্থাপনা ও প্রকল্প। ভাটির বাংলাদেশে এসব নদীর জীবন ও প্রবাহ বদলে ফেলা হয়েছে।

 

নদীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পেশা, জীবন, জীবিকা এবং বাস্তুতন্ত্র সবকিছুই দুম করে বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে। কোনো অভিন্ন জলধারাকে এভাবে লাগাতার একের পর এক উজানে বাধা দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া অন্যায়। সমাজে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ কিংবা রাষ্ট্রের আইন কী আন্তঃরাষ্ট্রিক নীতি সব বিবেচনাই উজানে বাধা দিয়ে ভাটিতে নদীতে মরণাপন্ন করে তোলা অপরাধ; কিন্তু তাই ঘটে চলেছে বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর জীবনে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের এক অনন্য নদী ধলাই।

 

এ নদীর উজানে ত্রিপুরা রাজ্যে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কারণে নদীটি প্রতিদিন পরিচয় ও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে। চলতি আলাপখানি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের কাছে ধলাই নদীর সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের দাবি জানায়।

 

আন্তঃসীমান্ত নদীর উজানে বৃহৎ বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ভাটির বাংলাদেশ মূলত প্রথম প্রতিবাদী হয় ফারাক্কার বিরুদ্ধে। গঙ্গা ও পদ্মার অভিন্ন প্রবহমানতার দাবিতে। পরবর্তীতে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের রাজনৈতিক দরবার নানাভাবে উচ্চকিত হয়েছে। বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদীপ্রণালির উজানেও বৃহৎ বাঁধ প্রকল্প।

 

মেঘনা-সুরমা-কুশিয়ারার উজানে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও এক নাগরিক প্রতিক্রিয়া সরব হয়েছিল। কিংবা ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের পরিকল্পিত বৃহৎ প্রকল্প নিয়ে কিছু আলাপ জারি আছে; কিন্তু এর বাইরে দেশের অপরাপর আন্তঃসীমান্ত নদীর উজানে কী ঘটছে তা আমাদের জানা-বোঝা ও আলাপচারিতা কিংবা নাগরিক প্রতিক্রিয়ার বাইরেই থাকছে।

 

২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে ‘মনতডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের’ প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মেঘালয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ড. মুকুল সাংমা। মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি জেলা জৈন্তিয়ার জোয়াই শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে লেসকার ১০০ মিটার ভাটিতে মনতডু, লামু ও উমসরিয়াং নদীর ত্রিমুখী সঙ্গমে পেডেকাংসাপ গ্রামের কাছে শুরু হয় ‘মনতডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’। এই নদীর ভাটিতে বাংলাদেশের সিলেটের সারী নদী।

 

সারী নদীর উজানে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাতারগুল জলাবনের বাস্তুতন্ত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে উজান থেকে ভাটিতে নেমে আসা স্রোত ও প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সংবেদনশীল এ জলাবনের প্রাণ-প্রকৃতির বিকাশে সংকট তৈরি হয়েছে। উত্তর-পূর্ব পানি-প্রতিবেশ অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত নদী সারী।

 

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সারী-গোয়াইন নদীকে ২৮৪নং আইডি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। লালাখাল চা বাগানের কাছে ভারতের লোভাছড়ি নদী হতে এই সারী-গোয়াইন নদীর উৎপত্তি। সিলেটের জৈন্তাপুরের কাছে প্রবেশ করে সারী নদী গোয়াইনঘাট এলাকায় গোয়াইন নাম ধারণ করে পরবর্তীতে সিলেটের বাদামঘাট এলাকায় চেঙ্গের খাল (সিঙ্গের খাল) নাম নিয়ে সুরমা নদীতে মিলেছে।

 

সিলেটর জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদর উপজেলার ভেতর দিয়ে নদীটি প্রবাহিত হয়েছে। বারোমাসী স্রোত প্রবাহ নিয়ে প্রবাহিত সারী নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৫.৭৫ কিলোমিটার। সারীঘাট এলাকায় বর্ষা মৌসুমে সারী নদীর গভীরতা থাকে ৮.৫০ মিটার এবং শীতকালে ০.৭৫ মিটার।

 

‘মনতডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’ উদ্বোধন হতে না হতেই ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড়ের উমইয়্যু নদীতে উদ্বোধন করা হয় ‘মাওফু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’। উমইয়্যু নদীতে বাঁধ দিয়ে ওই বিদ্যুৎ প্রকল্প কারণে বাংলাদেশের সিলেটের ধলা নদীর প্রতিবেশীয় বৈশিষ্ট্য সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। উত্তর-পূর্ব পানি-প্রতিবেশ অঞ্চলে অবস্থিত সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত নদী ধলার আইডি নাম্বার-১৪৫। মেঘালয় পাহাড়ের উমইয়্যু পাহাড়ি নদীই হচ্ছে কোম্পানীগঞ্জের ধলা নদীর জলধারার মূল উৎস।

 

২০০৭ থেকেই বিষাক্ত হয়ে ওঠলো লুকা হ্রদ। কারণ খুঁজে দেখা গেল স্টার সিমেন্ট আর টপ সিমেন্ট কারখানার দূষণে নীলচে হয়ে যাচ্ছে এই অভিন্ন নদী। ২০০৪ সালে মেঘালয়ের পূর্ব জৈন্তিয়া পাহাড়ের লুমস্নোং এলাকায় স্থাপিত হয় স্টার সিমেন্ট কারখানা। ২০০৬ সালে থাংস্কাইয়ের কাছে উমদহে স্থাপিত হয় টপ সিমেন্ট কারখানা। আর এই সিমেন্ট কারখানার রাসায়নিক বর্জ্যে দিনের পর দিন লুমস্নোং এবং থাংস্কাইয়ের কাছে দূষিত হয়ে ঘননীল হয়ে যায় লুকা নদী।

 

কেবল সিমেন্ট কারখানা নয়, মেঘালয় পাহাড়ে অপরিকল্পিত চুনাপাথর ও কয়লা খননের দূষণেও বিপন্ন হয়ে উঠছে অভিন্ন নদীগুলো। এমনকি সংবেদনশীল এ অঞ্চলে অভিন্ন জলধারার ওপর একের পর এক তৈরি হচ্ছে বৃহৎ বাঁধ। দেখা গেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ে বাণিজ্যিক খনন, বাঁধ এবং বৃহৎ প্রকল্পের কারণে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো দূষিত হচ্ছে এবং এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ছে। এই প্রবল উন্নয়ন বাহাদুরির কারণে এখানকার আন্তঃসীমান্ত নদী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে লোচ মাছ।

 

কিন্তু এই খননকে অপরিকল্পিত খনন হিসেবে আখ্যা দিয়ে নদীপাড়ের মানুষেরা জানান, নদীতে পলি জমে ভরাট হয়ে বর্ষাকালে পানি উপচে আবারো বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবে। এখন পরিস্থিত বিপজ্জনক। শীতকালে নদীটি শুকিয়ে যায় আর বর্ষায় নদীভাঙনে তলিয়ে যায় জমিন ও জনপদ। ধলাই নদীর উজানে ত্রিপুরাতে সেতু ও সড়কপথ নির্মাণপ্রকল্পের কারণে ভাটিতে ধলাইয়ের প্রবাহ শীর্ণ ও ক্ষীণকায় হচ্ছে প্রতিদিন।

 

অথচ অভিন্ন পানিপ্রবাহের ন্যায্যতা ও সুরক্ষাপ্রশ্নে আমরা রাষ্ট্রীয়, দ্বি-রাষ্ট্রিক ও বৈশ্বিকভাবে বহু অঙ্গীকার করেছি। ইরানের রামসার শহরে ১৯৭২ সালে রামসার সম্মেলনে প্রথম পৃথিবীর জলাভ‚মি বিষয়ে বৈশ্বিক মনোযোগ তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহারের জন্য ১৯৯৭ সনে জাতিসংঘ ‘নৌ চলাচল ব্যতীত আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের অপরাপর ব্যবহার সম্পর্কিত আইনবিষয়ক সম্মেলন’ আয়োজন করে।

 

ওই সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১০৩টি রাষ্ট্র সম্মেলনের পক্ষে ভোট দেয় কিন্তু ভারত ভোট দানে বিরত থাকে। আন্তজার্তিক জলপ্রবাহের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার এবং জলপ্রবাহের ওপর এমন কোনো কিছু তৈরি না করা যাতে অন্য রাষ্ট্রের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে এমন বিষয়গুলো ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ কনভেনশনের ৫, ৭ এবং ১২নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে।

 

আমরা আশা করব ধলাই নদীর অভিন্ন পানিপ্রবাহ সুরক্ষিত থাকবে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন ধলাই নদীর অভিন্ন মুক্ত প্রবাহের বহমানতা নিশ্চিত করবে। রাষ্ট্রীয়, দ্বি-রাষ্ট্রিক এবং বৈশ্বিক অঙ্গীকারসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে। উজানে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ভাটিতে ধলাই নদীর জীবন প্রশ্নহীনভাবে বিপন্ন হতে থাকলে এর ক্ষরণ ও দাগ কেবল ধলাই অববাহিকা নয়; সমগ্র বাস্তুতন্ত্র ও জীবনকেই বিমর্ষ করে তুলবে।

 

লেখক : গবেষক

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version