ভৌগোলিকভাবে ভূতাত্তিক গঠনে বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ অঞ্চল। বদ্বীপ অঞ্চল গ্যাসসম্পদে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার কথা, অন্তত বিশ্বের অন্যান্য বদ্বীপ অঞ্চলকে বিবেচনায় নিলে। আন্তর্জাতিক গ্যাস জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়নেও একই মত প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে যথেষ্ট মাত্রায় গ্যাস অনুসন্ধান না হওয়ার কারণে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে গ্যাস সম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা কম অনুসন্ধানকৃত দেশগুলোর একটি। যথেষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভূগর্ভে লুক্কায়িত গ্যাস উত্তোলন করলে সংকট থাকবে না। জ্বালানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে বড় অঙ্কের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না।
তদুপরি, উৎপাদিত বিদ্যুতের বেশিরভাগ নির্ভর করে আমদানি করা জ্বালানির ওপর। এই নির্ভরশীলতা ও দাম ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ, যা কিনা ২০২২ সালে কমে প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর কারণ হলো দেশে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনের হার কমে গেছে। আর এর ফলে দেশীয় জ্বালানি তথা গ্যাসের পরিবর্তে বাড়ছে আমদানি করা অতি উচ্চমূল্যের এলএনজির ব্যবহার।
প্রতি ইউনিট দেশীয় গ্যাসের মূল্য যেখানে দুই থেকে তিন ডলার, সেখানে প্রতি ইউনিট আমদানি করা গ্যাসের জন্য ব্যয় হয় ১২ ডলার থেকে ৩৫ ডলার পর্যন্ত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্যের ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রিজার্ভে চাপ তৈরি হচ্ছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি দেশে ডলার ও রিজার্ভ সংকটের কথা শোনা যাচ্ছে। কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ভারসাম্য সংকটসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বা মেগা প্রকল্পে নেয়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ডলারে পরিশোধের কারণে রিজার্ভে চাপ তৈরি হচ্ছে।
গত অর্থবছরে দেশে মোট ৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে। ওদিকে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন। এ পার্থক্য সামনে আরো বড় হবে বৈদেশিক ঋণের সুদ এবং কিস্তি পরিশোধের কারণে। বলা বাহুল্য, দেশের অর্থনীতি কিছুটা সংকটকাল অতিক্রম করছে। ধারণা করা যায়, খুব শিগগিরই এ সংকট কাটবে না। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির নানা প্রতিকূলতার মধ্যে রিজার্ভ সংকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রিজার্ভ সংকটের কারণে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রতিনিয়ত কমছে।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে একাধিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা আসলেও দেশটিতে গ্যাসের সংকট তাতে কমেনি, বরং আরো বেড়েছে। এমনকি বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করেও সংকট সামলানো যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে জ্বালানি নিয়ে সরকারের নেয়া ভুলনীতির কারণেই এখন গ্যাস নিয়ে এই সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে ২৯টি, যার মধ্যে ১৯টি থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে।
দেশের মজুত থেকে প্রতিবছর এক টিসিএফ করে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। কিন্তু সেই হারে নতুন গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া যাচ্ছে না। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, এসব গ্যাসক্ষেত্রে মোট মজুত ছিল প্রায় ৩০.৮৩ টিসিএফ গ্যাস। এই মজুতের তালিকায় ১৯৬৫ সালে আবিষ্কৃত যেসব গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, তাদের মজুতের হিসাবও রয়েছে। সেখান থেকে এতদিন পর্যন্ত ১৯.৯৪ টিসিএফের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। গ্যাস উত্তোলনের পর বর্তমানে মজুত রয়েছে ৮.৬৮ টিসিএফ গ্যাস। বিদ্যুৎ, সার কারখানা, আবাসিক, পরিবহন খাতে ব্যবহারের কারণে এই মজুতও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, বড় ধরনের মজুত পাওয়া না গেলে আগামী আট থেকে ১০ বছরের মধ্যে দেশের গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। বাংলাদেশে এখন গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় চারশ’ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে সরকার এখন পর্যন্ত দৈনিক সরবরাহ করে ৩০০ কোটি ঘনফুট।
এই গ্যাসের মধ্যে দেশীয় উৎপাদন প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা আমদানি করা লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি দিয়ে মেটানো হয়। পুরোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে আগে যে পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যেত, এখন সেটা অনেক কমে এসেছে বলে তিনি জানান। কর্মকর্তারা বলছেন পুরোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস পাওয়ার পরিমাণ কমে গেছে।
কিন্তু গ্যাসের চাহিদা বিশ বছর আগের তুলনায় তিনগুণ বেড়ে গেছে। সেই অনুযায়ী নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার বা উৎপাদন হয়নি। দেশে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন খাত ও অনেক শিল্প, কলকারখানা গড়ে ওঠে। ২০০১ সালের পর দেশে রাতারাতি গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জ্বালানি খাতের প্রায় ৪৬ শতাংশ গ্যাস খাত থেকে সরবরাহ করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেলে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর পরিবর্তে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করে নিয়ে আসার নীতি নিয়েছিল বাংলাদেশের সরকার। কারণ, তখন দেশে অনুসন্ধান বা উৎপাদনের জন্য কূপ খননের চেয়ে আমদানি করাকে বেশি লাভজনক বলে মনে করা হয়েছিল।
ডলার সংকটে আমদানি করা জ্বালানির মূল্য পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। সেই সঙ্গে জ্বালানির মজুতও কমে আসছে। এ অবস্থায় ছয়টি আন্তর্জাতিক কোম্পানি বাংলাদেশের কাছে জ্বালানি তেল বাবদ ৩০ কোটি ডলার পাবে। অর্থ না পাওয়ায় এদের কেউ কেউ বাংলাদেশে তেল পাঠানো কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তেলবাহী কার্গো না পাঠানোর হুমকিও আসছে। গত বছর গ্রীষ্মকালে জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ সংকট চরম আকার ধারণ করে বাংলাদেশে। এতে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ পরিস্থিতিতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেন ভারতের পাওনা রুপিতে পরিশোধ করতে পারে, তার অনুমতি দিতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে বিপিসি।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ গত বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণের আবেদন করে। আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পেয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় মেটাতে চলতি অর্থবছরে বিপিসিকে ৫০০ কোটি ডলার ও এলএনজি আমদানিতে পেট্রোবাংলাকে ২০০ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। এ ছাড়া ঋণপত্র খুলতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও ৩০০ কোটি ডলার দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আমরা সব যৌক্তিকভাবে ব্যবস্থাপনা করছি।
বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। নানা উত্থান-পতন সত্তে¡ও আমরা ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ সংরক্ষণ করছি। যে ছয় কোম্পানির কাছ থেকে তারা তেল কিনছে, সেগুলো হলো চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি সিনোপেকের বাণিজ্যিক অংশীদার ইউনিপেক, ভিটল, এনোক, ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন (আইওসি), পেট্রোচায়না ও ইন্দোনেশিয়ার বিএসপি।
কিন্তু বিপিসির ৯ মের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারিকে ৪ কোটি ১১ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে বিপিসিকে; আইওসিকে ডিজেল ও জেট ফুয়েল বাবদ দিতে হবে ১৪ কোটি ৭২ লাখ ডলার। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেন ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে রুপিতে অর্থ পরিশোধ করতে পারে, তার অনুমতি দিতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে বিপিসি।
এদিকে ডলার সংকট ঠেকাতে আমদানি এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ডলার স্বল্পতার কারণ দেখিয়ে কয়েক মাস ধরে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর ১৫০ কোটি ডলার মূল্যমানের বিল পরিশোধ করছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সংগঠন বলছে, এ বিলম্বের কারণে অনেক স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিকার না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে। এ বিষয়ে বিপিডিবির মুখপাত্র বলছেন, এটা চলমান প্রক্রিয়া।
আশির দশকে যখন অনেক গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেল, তখন এমন অবস্থা ছিল যে, আপনার অনেক গ্যাস আছে, কিন্তু চাহিদা ততটা নেই। ফলে, এরপর আর গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলো হয়তো বিরাট বড় না। কিন্তু সম্মিলিতভাবে সেটার আকার ভালো। কিন্তু এগুলোর উন্নয়ন করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত, সেটা নেয়া হচ্ছে না। কারণ, কর্তৃপক্ষের হয়তো ধারণা তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশে বুঝি গ্যাস আর নেই, শেষ হয়ে গেছে। এর কারণেই গ্যাস উত্তোলন এবং আহরণের জন্য যে চেষ্টা বা আগ্রহ থাকা উচিত ছিল, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তার চেয়ে আমদানি নির্ভরতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর কারণে দেশীয় গ্যাসের আবিষ্কার এবং উত্তোলনটা পিছিয়ে পড়েছে।
সমগ্র বিশ্বে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোও সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎসেবা দেয়ার জন্য রেশনিং করছে। তাই বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের অবস্থাও খারাপ। কারণ, আমাদের যে নিজস্ব গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তা চাহিদার অর্ধেকের চেয়ে কম। বাকি বেশির ভাগ উৎপাদন হয় জ্বালানি তেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে। এখন যদি বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়, তাহলে উৎপাদন খরচ তিন চার গুণ বেড়ে যাবে। পরিশেষে এ কথা বলতে পারি যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতিকে আমাদের গ্রহণযোগ্য হিসাবের খাতায় আনতে হবে।
কেন রিজার্ভে টান? আর কেনই বা লোডশেডিং? অথবা এটা কি আমাদের কোনো অদূরদর্শিতার ফল। মেগা প্রজেক্ট কি আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় ঋণের ফাঁদ না সহায়ক এবং সর্বোপরি আমাদের বাজেট ও পরিকল্পনা কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, এ জাতীয় বিষয়গুলোকে বিবেচনায় এনে সংকট নিরসনে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী গবেষক
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য