প্রচন্ড গরমের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। এর আর্থিক মূল্য ২৮ থেকে ৩১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। মাথাপিছু শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম এবং বছরে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ কোটি শ্রমঘণ্টা। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতি বা অনাবৃষ্টি, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদি এখন বাংলাদেশের জন্য সাধারণ ঘটনা
বিশ্বসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। তাপপ্রবাহের এই তীব্রতা ইতোমধ্যে বিগত ২০০ বছরের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। অসহনীয় গরম ও তীব্র আর্দ্রতায় এক অস্বস্তিকর সময় পার করছে পৃথিবীর মানুষ। মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রে। এর ফলে উত্তেজনা, জ্বালা, মানসিক অবসাদ, আগ্রাসন, এমনকি আত্মহত্যার যোগসূত্র আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
২০১০ এবং ২০১৯ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ২ হাজার ৭৭৫টি জরুরি বিভাগের ২ দশমিক ২ মিলিয়নের বেশি প্রাপ্তবয়স্কদের মেডিকেল রেকর্ড যাচাই করে গবেষকরা দেখেন যে, গ্রীষ্মের উষ্ণতম দিনগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যায় বছরের শীতলতম দিনগুলোর তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশ বেশি।
২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিনীদের মধ্যে এক সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয়েছে, যে দিনগুলোতে তাপমাত্রা ৫০ এবং ৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছিল, তার তুলনায় যে দিনগুলোতে তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সে দিনগুলোয় উত্তরদাতারা কম আনন্দ এবং সুখ অনুভব করেছিলেন। সেইসঙ্গে অধিক মানসিক চাপ, রাগ ও ক্লান্তি অনুভব করার মাত্রাও কম তাপমাত্রার দিনগুলোর থেকে ছিল বেশি। এসব সমস্যা আরও তীব্র ছিল যখন তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে ছিল।
এবার জানা যাক, কি কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীতে সূর্যের তাপকে আটকে রাখে গ্রিনহাউস গ্যাস। এসব গ্যাসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং গাছপালা কেটে ফেলার কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ঘটে। ১৮৫০ সালের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে কার্বনের নির্গমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, আট লাখ বছর ধরে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ১০ লাখে ৩০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) এর ঊর্ধ্বে যায়নি। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৪২০ পিপিএম।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংস্থা আইপিসিসি ২০০১ সালে জানিয়েছিল, শিল্পযুগ শুরুর আগে বায়ুমÐলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কয়েক হাজার বছর ধরে ২৮০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) ছিল?
কিন্তু ১৯৯৯ সালে সেটা বেড়ে ৩৬৭ পিপিএম হয়? আর গত মে মাসে সেটা আরও বেড়ে ৪১৫ পিপিএম হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ (গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স রিপোর্ট-২০১০)। অপরদিকে গ্রিনহাউস গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রতিফলিত হওয়ায় পৃথিবী অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়।
আরও আছে ‘এল নিনো’র প্রভাব। মানে প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এই স্রোতের ফলে উষ্ণ হয়ে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল, বিশেষ করে পেরুর দিকের পানি। এর প্রভাবে কমে যাচ্ছে বৃষ্টির পরিমাণ। বাড়তে পারে তীব্র গরম। ১৯৯৭-৯৮ সালে শক্তিশালী ‘এল নিনো’র প্রভাবে সারাবিশ্বে পাঁচ লাখ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। প্রাণহানি ঘটেছিল ২৩ হাজার।
মার্কিন বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এল নিনো’র প্রভাবে ২০২৪ সাল বিশ্বের এ যাবৎকালের উষ্ণতম বছর হয়ে উঠতে পারে। এর জেরে বিশ্ব দেড় ডিগ্রি উষ্ণতা বৃদ্ধির মাইলফলক পেরিয়ে যেতে পারে। ফলে, আর্থিক ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটবে ব্যাপক। এরই মধ্যে পেরু ও ইকুয়েডরের উপকূলীয় অঞ্চলে ‘এল নিনো’র প্রভাব শনাক্ত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, একটি পূর্ণাঙ্গ ‘এল নিনো’ প্রক্রিয়া শুরু হবে শিগগিরই, যার প্রভাব দেখা যাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রায়। উল্লেখ্য, গত এক দশকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে ১ দশমিক ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় ২০২১ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার বিষয়ে বিশ্ব নেতারা নি¤œলিখিত সাতটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন- ১. জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস, ২. মিথেন গ্যাস নিগর্মন হ্রাস করা, ৩. নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা, ৪. পেট্রোল ও ডিজেলের ব্যবহার হ্রাস, ৫. বৃক্ষরোপণ বৃদ্ধি, ৬. বায়ু থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস দূরীকরণ, ৭. দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান। তবে বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা অন্য কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস কৃত্রিমভাবে দূর করা গেলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ হবে দ্রুত।
ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বায়ুমন্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস দূর করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে টেক্সাসের ‘কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং’ এবং সুইজারল্যান্ডের ‘ক্লাইমওয়ার্কস’ অন্যতম। এগুলো একটি রাসায়নিক পদার্থের ফিল্টারের ভিতর দিয়ে বিশাল ফ্যানের সাহায্যে বায়ুমন্ডলে বাতাস নির্গত করে বায়ুমন্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে।
অন্য একটি পদ্ধতি হলো- কার্বন বন্দি ও সংরক্ষণ। এই পদ্ধতিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উৎস যেমন কয়লার জ্বালানি প্লান্ট থেকে বিশেষ যন্ত্র গ্যাস শোষণ করে। শোষণকৃত গ্যাস পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে ভূগর্ভের অভ্যন্তরে কূপে পাঠানো হয়। এটি কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ (সিসিএস) নামেও পরিচিত। তবে এসব প্রযুক্তি বেশ জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ।
সেক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে বৃক্ষরোপণের চেয়ে উৎকৃষ্ট পদ্ধতি আর কিছু হতে পারে না। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস দূর করতে হবে। এজন্য বৃক্ষ রোপণের হার বাড়াতেই হবে। অবশ্য নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন- বায়ু শক্তি, সৌর শক্তি, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে বেশ সাহায্য করছে। অনেক ডিজিটাল প্রযুক্তিও আছে, যা বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এগুলো হলো ইনসিনারেটর, গ্র্যাভিটেশনাল সেটলিং চেম্বার, ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক প্রিসিপিটেটর, সাইক্লোন সেপারেটর, সিলেক্টিভ ক্যাটালিটিক রিডাকশন সিস্টেম, ফ্যাব্রিক ফিল্টার, বায়োফিল্টার, স্ক্রাবার ইত্যাদি।
এর মধ্যে ‘ইনসিনারেটর’ হলো বর্জ্য পদার্থ নিয়ন্ত্রিত পোড়ানোর জন্য ব্যবহৃত একটি যন্ত্র। পুড়িয়ে ফেলা বর্জ্যকে ছাই, ফ্লু গ্যাস এবং তাপে রূপান্তরিত হয়ে শিল্প প্রক্রিয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। ‘গ্র্যাভিটেশনাল সেটলিং চেম্বার’ পদ্ধতিতে গ্যাস নিষ্কাশনের গতি হ্রাস বৃদ্ধি করা হয়, যা বায়ু সাসপেনশন থেকে মোটা কণাগুলোকে আলাদা করার ব্যবস্থা করে।
‘ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক প্রিসিপিটেটর’ এক ধরনের বায়ু ক্লিনার বা ফিল্টার, যা বায়ু থেকে অমেধ্য, ধূলিকণা অপসারণের জন্য বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করে। বেশিরভাগ শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে এটি বায়ু দূষণ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি উন্নত প্রযুক্তি।
‘সাইক্লোন সেপারেটর’ বা ঘূর্ণি বিচ্ছেদের মাধ্যমে ফিল্টার ব্যবহার না করে বায়ু, গ্যাস বা তরল প্রবাহ থেকে কণা অপসারণ করা হয়। এতে একটি হাইড্রোসাইক্লোন ব্যবহার করা হয়, যা বায়ুকে দূষণমুক্ত ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ‘সিলেক্টিভ ক্যাটালিটিক রিডাকশন সিস্টেম’ একটি অনুঘটক বা হ্রাসকারী এজেন্টের মাধ্যমে ইঞ্জিন থেকে নিষ্কাশন গ্যাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রা হ্রাস করে। ফলে, শিল্প প্রতিষ্ঠানের উচ্চ তাপমাত্রা ও বায়ুদূষণের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
প্রচন্ড গরমের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। এর আর্থিক মূল্য ২৮ থেকে ৩১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। মাথাপিছু শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম এবং বছরে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ কোটি শ্রমঘণ্টা। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতি বা অনাবৃষ্টি, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদি এখন বাংলাদেশের জন্য সাধারণ ঘটনা। তালিকায় আছে ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, হাইতি, ফিলিপাইন, মোজাম্বিক, বাহামা, পুয়ের্তোরিকা ইত্যাদি। এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বিভীষিকাময় পৃথিবী অপেক্ষা করছে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য