-->

সেন্টমার্টিন দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের কেন প্রয়োজন

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
সেন্টমার্টিন দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের কেন প্রয়োজন

ক্রমান্বয়ে ‘ম্লান’ বা ‘ক্ষয়িষ্ণু’ হওয়ার পথে বিশ্বের পুরোনো ‘শক্তিধর’ পাশ্চাত্য বিশ্বের নেতৃত্বে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন সেন্টমার্টিন দ্বীপ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করছে এই প্রশ্নটি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর এখন যেমনটি শোনা যাচ্ছে আগেও সেন্টমার্টিন দ্বীপ সম্পর্কে আমেরিকার আগ্রহের কথা শোনা গেলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর তাৎপর্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক।

 

এর পাশাপাশি প্রধানত দুটি কারণে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। প্রথমটি হচ্ছে, জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে সাধারণ আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরের কথা উঠে আসে। এ পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রদ্ধার বিষয়টি ‘কূটনৈতিক’ অ্যাটিকেটের ছদ্মাবরণে প্রকাশ করা হয়েছে। ওটা করতে হয়!

 

দ্বিতীয়ত, বিশ্ব রাজনীতির প্রভাব চর্চার ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের প্রাধান্য ক্রমান্বয়ে ‘ম্লান’ হওয়া সম্পর্কে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অভিজ্ঞ কুশীলব ও বিশ্লেষকরা মন্তব্য করছেন। ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মার্ক বিসন (২০২০) একটি তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণায় দেখিয়েছেন কীভাবে ‘আমেরিকান আধিপত্যের’ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা, দৃশ্যত ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনিশ্চিত এবং জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের সময় এবং আমেরিকা ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার মুখে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। অনেক ভাষ্যকারের ভয় যে এ ধরনের উত্তেজনা বিশেষ করে তথাকথিত নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং সাধারণভাবে যেসব মূল্যবোধ, নীতি এবং নিয়ম ‘পশ্চিম’ এর সঙ্গে সম্পর্কিত সেগুলোর প্রভাব ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।

 

এ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেখান থেকে উত্তরণ তথা প্রভাবের দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক নম্বর’ অবস্থান ধরে রাখার লক্ষ্যে ‘পুনঃউদ্ভাবনমূলক’ তৎপরতার অংশ হিসেবে সেন্টমার্টিন দ্বীপ কব্জা করার মিশন থাকাটাই স্বাভাবিক! নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বাংলাদেশের এক শ্রেণির প্রভাবশালী রাজনীতিক যে খুনোখুনি পর্যন্ত করতে প্রস্তুত বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেটিও অজানা নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত সরকারপ্রধান বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী ছিল খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যে ছিল বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর। এসব বিবেচনায় রেখেই মার্কিনিরা তাদের অবস্থান অর্থাৎ সেন্টমার্টিন দ্বীপ দিতে বাংলাদেশকে বাধ্য করার জন্য নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

 

আমেরিকার সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টে গত ১৭ মে, ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘পুরোনো শক্তিগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে, নতুন শক্তিগুলোর উত্থান ঘটছে এবং পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে।’

 

কিসিঞ্জারের বক্তব্যের তাৎপযপূর্ণ ব্যাখ্যার পাশাপাশি ভারতের অভিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের একটি বক্তব্যও প্রসঙ্গক্রমে আমাদের বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময় বলেছিলেন, আজকের বিশ্বের কিছু প্রতিষ্ঠিত শক্তি আগামী ২৫ বছরে একটি বিশাল জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে।

 

তিনি বলছেন, ‘সুতরাং আমি যদি অর্থনীতির দিকে তাকাই, যদি আমি জনসংখ্যার দিকে তাকাই, যদি আমি প্রযুক্তির দিকে তাকাই, আমি মনে করি এই প্রবণতার অনেক সত্যিই আমাদের জন্য একটি ভালো দিক নির্দেশ করে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ক্ষয়িষ্ণু পরাশক্তি এই ধারণাকে এস জয়শঙ্কর সমর্থন করেন না। জয়শঙ্কর বলছেন, ‘স্পষ্টতই, আমি (জয়শঙ্কর) এই ক্ষয়িষ্ণু মার্কিন [তত্তে¡র] একজন সমর্থক নই। আমি বলব যে, প্রমাণগুলো ইঙ্গিত করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে নতুন করে পুনরায় উদ্ভাবন করছে।’ (‘আই এম নট অ্য ভোটারি, ফ্রাঙ্কলি, অব দিস ডিক্লাইনিং ইউএস [থিওরি]. আই উড সে দ্য ইভিডেন্স পয়েন্টস টু দ্য ইউএস রিইনভেনিটং ইটসেলফ।’)

 

হেনরি কিসিঞ্জার বিশ্ব রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর ক্রমান্বয়ে ‘ম্লান’ হওয়ার কথা বলছেন। একজন অভিজ্ঞ ক‚টনীতিক এবং রাজনীতিক জয়শঙ্কর সতর্কতার সঙ্গে অন্তত আমেরিকার ক্ষেত্রে ‘ম্লান’ শব্দটি ব্যবহার না করে বলছেন আমেরিকা নিজেকে ‘পুনঃউদ্ভাবন’ (রিইনভেন্টিং) করছে। ‘নিজেকে পুনঃউদ্ভাবন করার’ মার্কিন প্রচেষ্টার ব্যাপারে জয়শঙ্কর যে অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করেছেন সেই আলোকেই বাংলাদেশে মার্কিনিদের এবং তার অনুগামী ইউরোপিয়ানদের তৎপরতাকে দেখতে হবে।

 

বিশ্বের ৮০টি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫০টি সামরিক ঘাঁটি আছে। এই সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র শক্তির সামরিক ঘাঁটি আছে। ভৌগোলিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রবেশদ্বার হচ্ছে বাংলাদেশ। সর্বোপরি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ! বাংলাদেশের এই ভৌগোলিক অবস্থান সেন্টমার্টিনে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপিত হলে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চল সব দিক দিয়েই বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য বা ‘এক নম্বর পজিশন’ ধরে রাখার জন্য জরুরি। এ কারণে মার্কিন ঘাঁটি করতে দিতে রাজি এমন একটা রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া দরকার।

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাতে রাজি না হওয়ায় এই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজি করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর পূর্ব এবং পশ্চিম গোলার্ধের মধ্যে বাণিজ্যিক শিপিং রুটের জন্য একটি অর্থনৈতিক হাইওয়ে হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক কন্টেইনার ট্রাফিক এই অঞ্চল দিয়ে যায়। আর এর বন্দরগুলো বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৩৩ শতাংশ পরিচালনা করে।

 

মিয়ানমারের অফশোর গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে প্রবেশাধিকারের জন্য ভারত এবং চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা তেল ও গ্যাসের মজুত এবং অন্য খনিজগুলোর মতো কৌশলগত সংস্থানগুলোর সন্ধানের দ্বারা চালিত হয়। উত্তর ভারত মহাসাগর বিশ্বব্যাপী পূর্ব-পশ্চিম-পূর্ব বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে অন্যান্য সামুদ্রিক অঞ্চলে তেলের সহজ প্রবাহ নিশ্চিত করা বৃহৎ, মাঝারি এবং ছোট শক্তিগুলোর জন্য অত্যাবশ্যক।

 

গত ২১ জুন এক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপমুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আছেন। তার যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে অজিত দোভাল বলেছিলেন, প্রতিবেশীদের ব্যাপারে অন্য দেশের এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া উচিত হবে না, যা ভারতের জাতীয় স্বার্থে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

 

শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় দৈনিক তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা বিঘিœত করে, এমন কিছু করা যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার শাসনামল, তখন ১০ ট্রাক অস্ত্র ভারতের আসামের সন্ত্রাসী সংগঠন উলফার কাছে পাচার হওয়ার পথে ছিল। এটা ছিল নিরাপত্তা নিয়ে মুখ্য বিষয়।’ এ ব্যাপারে প্যাটেলের মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়।

 

জবাবে প্যাটেল বলেন, এ বিষয়ে তিনি দুটি কথা বলবেন। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ও ক্ষেত্রগুলোয় যুক্ত হতে এবং পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে না। তবে তিনি এ কথাও বলেন যে, বিষয়টি যেহেতু ওই অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেক্ষেত্রে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। একটি উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা বজায় রাখতে ভারতীয় অংশীদারদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে।

 

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখ্য উপমুখপাত্র আরো বলেন, ‘আমরা সম্মিলিতভাবে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করি এবং উন্মুক্ত, সমৃদ্ধ, নিরাপদ, স্থিতিশীল ও অভিঘাত সহনশীল বিশ্ব ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ) প্রতিষ্ঠায় কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের ভারতীয় অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর করতে চাই আমরা।’

 

একটি সেতুবন্ধনকারী জাতি এবং একটি ক্রমবর্ধমান মধ্যম শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের একটি নেতৃত্বের ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে। আর এই ভূমিকার ভিত্তি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব এবং কারো সাথে বৈরিতা নয়’। এই নীতির ভিত্তিতে প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সহযোগিতায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সেন্টমার্টিন দ্বীপের ব্যাপারে যেসব তৎপরতা চলছে সেসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা সম্ভব।

 

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version