-->
শিরোনাম

প্রযুক্তির কল্যাণে ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রযুক্তির কল্যাণে ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন

অনস্বীকার্য যে, দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও শাসন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে চরম অরাজক পরিস্থিতি বিরাজমান। বিভিন্ন সময়ে নানা সরকারের আমলে ভিন্ন ভিন্ন জরিপ কার্য পরিচালিত হলেও কথিত প্রভাবশালী-সিন্ডিকেট-মাফিয়াচক্র অবৈধ-অনৈতিক অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত সার্ভেয়ার-তহশিলদারদের কুটিল যোগসাজশে বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক হয়েছে।

 

পক্ষান্তরে, দরিদ্র-হতদরিদ্র-অর্ধশিক্ষিত শহর-নগর-গ্রামীণ জনপদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নির্মম শোষণ-বঞ্চনার মোড়কে হয়েছে ভূমি-বাস্তুচ্যুত। অর্থলিপ্সু হিংস্র দানবরূপী কতিপয় দুর্বৃত্তের কদর্য অপকৌশল অবলম্বনে ভ‚মির মালিকানা-দখল-খতিয়ান-জাল দলিল তৈরি ও মিথ্যা-প্রতারণামূলক সাক্ষ্য-সাবুদের বেড়াজালে নিঃস্ব হয়েছে অগণিত অসহায় নিরীহ মানুষ।

 

দেশব্যাপী বিভিন্ন আদালতে হীন মনোবৃত্তির কতিপয় আইনজীবী-রেজিস্ট্রার-সাব রেজিস্ট্রারের ঘুষ-দুর্নীতির প্রচলিত অপসংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণ খুবই দুরূহ বিষয়। নিষ্ঠুরতা-অমানবিকতায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে পুরো জনগণকে জিম্মি করে দখলে নেয়া এসব ভুয়া দলিল-দস্তাবেজ বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে জনগণের অর্থ আত্মসাতের মহোৎসবে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের করুণ কাতরতা সর্বত্রই অনুভূত।

 

সাগর-নদী-খাল-বিল-জলাশয়-কবরস্থান-শ্মশান দুর্বৃত্তায়নের নিষ্ঠুর কশাঘাতে অসহনীয় অবস্থা ধারণ করেছে। নষ্ট-ভ্রষ্ট চরিত্রের রাজনীতিক-পেশাজীবী-সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অশুভ পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষেত্র বিশেষে উল্লেখ্য অভিশপ্ত কর্মযজ্ঞ সম্পাদন অব্যাহত রয়েছে।

 

সচেতন মহলসহ দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, যথার্থ নেতৃত্ব-প্রযুক্তির কল্যাণে ইতোমধ্যে জটিল ভ‚মি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দীর্ঘসূত্রতার নিরসন-নানামুখী হয়রানি হ্রাসের পাশাপাশি নিশ্চিত হয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। বিশেষ করে বর্তমান ভূমিমন্ত্রী ২০২৬ সালের মধ্যে পরিকল্পিত সব প্রকল্পের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূমিসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

 

গৃহীত নীতি-কৌশল ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে চলমান সরকারের সাড়ে ১৪ বছরে অর্জিত বিপুল সাফল্যের ক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয় সাফল্য ঈর্ষণীয়। ‘হাতের মুঠোয় ভ‚মিসেবা’ স্লোগানে ভূমিসেবার সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি অধিকতর ব্যবহার করা হচ্ছে। এটুআইয়ের সহায়তায় ই-মিউটেশন, অনলাইনে আরএস খতিয়ান, মুসলিম আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর, মৌজা ম্যাপ অনলাইনে প্রকাশে ভূমি মন্ত্রণালয় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশব্যাপী ই-মিউটেশন উদ্যোগ বাস্তবায়নের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ‘ইউনাইটেড নেশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ পেয়েছে বাংলাদেশ ভূমি মন্ত্রণালয়।

 

ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ১ জুলাই তিন পার্বত্য জেলা ব্যতীত সারা দেশে একযোগে শতভাগ ই-নামজারি বাস্তবায়ন শুরু হয়। বর্তমানে ৪৮৫টি উপজেলা ভূমি-সার্কেল অফিস এবং ৩ হাজার ৬১৭টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ই-নামজারি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ম্যানুয়াল আবেদন বন্ধ করায় এখন ই-নামজারির কল্যাণে একবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষও ঘরে বসে এই সেবা নিতে পারছেন।

 

দালালদের দৌরাত্ম্য, নিম্নতম স্তরে দুর্নীতি বন্ধ হওয়ায় সেবাপ্রার্থীরা স্বল্প সময়-খরচে হয়রানিমুক্ত সেবা গ্রহণে সক্ষম হচ্ছেন। সরকারি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ভ‚মি ডেটা ব্যাংকের মাধ্যমে শতভাগ খাসজমি চিহ্নিতকরণ, ছবিসহ খাসজমি, অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি, সায়রাত মহালের শক্তিশালী ডেটাবেজ তৈরি করে জনগণের জন্য তথ্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।

 

ফলে অনলাইন সফটওয়্যার ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে খাসজমি বন্দোবস্ত, জল-বালুমহাল ও হাটবাজার ইজারা দেয়া যাচ্ছে। দ্রুত সময়ে ভূমি সেবা নিষ্পন্নে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশজুড়ে ১ হাজার ৬৩৯টি ভূমি অফিস স্থাপনের উদ্যোগ উঁচুমাত্রিকতায় উচ্চকিত।

 

এ ছাড়াও ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় ১৭ ধরনের ভূমিসেবা অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার তথা ই-মিউটেশন, রিভিউ ও আপিল মামলা ব্যবস্থাপনা, অনলাইন ভ‚মি উন্নয়ন কর, রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা ব্যবস্থাপনা, মিউটেটেড খতিয়ান, ডিজিটাল ল্যান্ড রেকর্ড, মৌজা ম্যাপ ডেলিভারি সিস্টেম, মিস মামলা ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও অকৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা, দেওয়ানি মামলা তথ্য ব্যবস্থাপনা, হাটবাজার ব্যবস্থাপনা, জল-বালুমহাল ব্যবস্থাপনা, চা-বাগান ব্যবস্থাপনা, ভিপি সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, ভূমি অধিগ্রহণ ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ বাজেট ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ‘ল্যান্ড ইনফরমেশ সার্ভিস ফ্রেমওয়ার্ক’ সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে একই কাঠামোয় আনার প্রচেষ্টা অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিভাত।

 

জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের জবাবে সম্মানিত ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে বেশকিছু উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। যেমন- ভূমি পরিষেবা অটোমেশন সিস্টেম প্রবর্তন। বিদ্যমান ভূমি অফিসমূহের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দূরীকরণের লক্ষ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের জবাবদিহি আনতে ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের কার্যক্রমকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে।

 

সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চলমান ডিজিটাইলাজেশন কার্যক্রম ও ভূমি আইন সম্পর্কে পারদর্শী করতে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ভূমি অফিসসমূহে ডিজিটাল ডিভাইস প্রদান করা হয়েছে যাতে সেবা প্রদান দ্রুত ও ত্রুটি মুক্ত হয়।’ ‘বর্তমানে সাধারণ নাগরিকগণ ভূমি অফিসে না এসে নামজারি-আনলাইনে সার্টিফাইড পর্চা-মৌজা ম্যাপের জন্য আবেদন, ঘরে বসেই খতিয়ান বা ম্যাপ পেয়ে যাচ্ছেন এবং খাজনা দিতে পারছেন। যেকোনো ভূমি সেবা সম্পর্কে জানতে বা অভিযোগ জানাতে হটলাইন (১৬১২২) কল করতে পারছেন।

 

পরিসংখ্যান অনুসারে, ই-নামজারি ব্যবস্থায় বর্তমানে প্রতি মাসে অনলাইনে ২ লক্ষাধিক নামজারি নিষ্পত্তি হচ্ছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে প্রায় ৮৪ লাখ নামজারি মামলা। নামজারি সিস্টেম থেকে আনলাইনে আদায়কৃত প্রায় ১৬০ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে। ২০২১ সালে উদ্বোধনের পর থেকে প্রায় ৪ কোটির বেশি হোল্ডিং ডেটা ম্যানুয়াল থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। নাগরিকদের অনলাইনে দাখিলা প্রদান করা হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখের বেশি।

 

অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হয়েছে ৫১৯ কোটি টাকা। বর্তমানে ৫ কোটি ২১ লাখের অধিক জমির মালিকানা এবং ৭৫ হাজারের বেশি মৌজা ম্যাপ তথ্য অনলাইনে রয়েছে। তিন লাখের মতো খতিয়ান ডাক বিভাগের মাধ্যমে নাগরিকগণ হাতে পেয়েছেন। এ সিস্টেম থেকে প্রায় ১৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা সরকারি রাজস্ব আদায় হয়। প্রতিনিয়ত নামজারি খতিয়ান যুক্ত হচ্ছে এ সিস্টেমে।

 

কলসেন্টার থেকে প্রায় ১০ দশমিক ২০ লাখ কল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিদেশ থেকে নিষ্পত্তিকৃত কলের সংখ্যা প্রায় ৬০০০। প্রায় ১১ হাজার ৪০০ ফলো-আপ কল করা হয়েছে। নাগরিকদের ২০ হাজার ৮০০টি ভূমি সংক্রান্ত আইনি পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।

 

বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদদের মতানুসারে, ভারতবর্ষ বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থার বিষয়টি এখনো সমাজ পরিবর্তনের ধারায় অত্যুজ্জ্বল। ‘গোলাভরা ধান-পুকুর ভরা মাছ-গোয়াল ভরা গরু’ ইত্যাকার প্রসঙ্গগুলো স্বাপ্নিক-বাচনিক কিছু নয়। ব্রিটিশ শাসনকালে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সাবলীল ভ‚মি ব্যবস্থাপনা পরাস্ত হলেও তার প্রভাব কিন্তু এখনো ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পুরোনো দিনের জনগণের স্মৃতিতে ভাস্বর।

 

গ্রামীণ জনপদের যৎসামান্য কিছু অঞ্চলে এর প্রচলন বিরাজিত। দেশ বিভাগ-পাকিস্তান-বাংলাদেশে বহুবার জরিপ কার্য চালানোর ফলে ভ‚মি ব্যবস্থাপনায় জটিলতা শুধু দীর্ঘায়িতই হয়েছে। আধুনিক চিন্তা চেতনায় পরিশুদ্ধ ভূমি মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপ এবারই সর্বাধিক প্রশংসিত। মাঠপর্যায়ে সঠিক বাস্তবায়নে এর ব্যত্যয় ঘটলে দেশবাসী আবারও হতাশার গভীর গহবরে নিপতিত হতে পারে।

 

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version