বাংলাদেশ স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পার করছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের এবং আনন্দের। এই বায়ান্ন বছরে স্বাস্থ্য খাতে যেমন যুগান্তকারী অর্জন আছে তেমনি বিশ্বাস-অবিশ্বাস, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও আস্থাহীনতার দোলাচালে একটি অস্বস্তিকর এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও যেমন অভাব-অভিযোগ ও ক্ষোভ আছে তেমনি রোগীদেরও আস্থাহীনতা, অবিশ্বাস ও ক্ষোভ আছে। আমরা জানি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, যেদিন বাংলার মানুষ ক্ষুধায় অন্ন পাবে, মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে, রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাবে, শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে সেদিন আমার স্বপ্ন পূরণ হবে। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম স্বাস্থ্য সচিব ডা. টি হোসেনকে দায়িত্ব দেন স্বাধীন বাংলার স্বাস্থ্যসেবার ভিত রচনা করার। শ্রদ্ধেয় ডা. টি হোসেন অল্প সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার একটি কাঠামো দাঁড় করান।
সেই সময়ে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিভিন্ন বিশেষায়িত টারসিয়ারি হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। সময়ের পরিক্রমায় এসবের কলেবর আরো বৃদ্ধি পেয়েছে তবে সাধারণ মানুষের কাক্সিক্ষত মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা অধরাই রয়ে গেছে।
আমরা যদি স্বাস্থ্য খাতের অর্জনগুলোর দিকে তাকাই তাহলে সেগুলো নেহায়েতই কম নয়। স্বাস্থ্য খাতেই জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ১৬টি পুরস্কার সরকার অর্জন করেছে। দেশব্যাপী ইপিআই-এর মাধ্যমে বর্তমানে ১০টি রোগের টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত করে বিশ্বে এক অনন্য নজির স্থাপন বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে। রোগীরা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৩০ ধরনের ওষুধ পাচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে জরুরি সেবা, বহির্বিভাগ সেবা ও আন্তঃবিভাগ সেবা এই তিন ধরনের সেবা চলমান। ২৪ ঘণ্টাই এই চিকিৎসাসেবাগুলো চিকিৎসকরা দিয়ে যাচ্ছেন। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট, ডায়ালাইসিস, ওপেন হার্ট সার্জারি, হার্টে রিং বসানো এ ধরনের চিকিৎসাসেবা সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিয়মিতই রোগীরা পাচ্ছেন।
এভাবে সেবা দিয়েও রোগীদের আস্থা কি আমরা অর্জন করতে পেরেছি বা পারছি?
অবিশ্বাস দূর করে বিশ্বাস অর্জন করতে পারছি?
একটা সুন্দর ডক্টর-পেশেন্ট রিলেশনশিপ কি স্থাপন করা গেছে? কেন এ অবস্থা?
এ অবস্থার পেছনের কারণগুলো হলো-
১) পর্যাপ্ত বেডের অভাব, ২) পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্বল্পতা বা ব্যবস্থা না থাকা, ৩) অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ৪) নার্স ও কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য ৫) চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীদের কমিউনিকেশন গ্যাপ এমনি আরো বেশ কিছু কারণ পাওয়া যাবে।
প্রথমে বেডের কথায় আসি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকে এবং সংগত কারণেই বেড না থাকায় অনেক রোগী ফ্লোরে চিকিৎসা নেন। ফ্লোরে ট্রিটমেন্ট দিয়ে রোগীর আস্থা ও মন পাওয়া বড়ই দুরূহ ব্যাপার। যেখানে বেডের অতিরিক্ত রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা দিয়ে প্রশংসিত হওয়ার কথা সেখানে বেডের অপর্যাপ্ততার দায় পুরোটাই চিকিৎসকের ঘাড়ে এসে পড়ে অথচ এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা একেবারেই নির্দোষ। এর দায় নীতিনির্ধারকদের।
দ্বিতীয়ত, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষোভের কারণ হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্বল্পতা বা ব্যবস্থা না থাকা ও হয়রানি। চব্বিশ ঘণ্টা রোগী ভর্তি হচ্ছে কিন্তু পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে না ভাবা যায়! মানসম্মত চিকিৎসা দিতে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিকল্প নেই এবং নীতিনির্ধারকরা এই বিষয়টি চরম অবজ্ঞা করেছে যার ফল ভোগ করছে রোগী ও চিকিৎসকরা।
তৃতীয়ত, যেখানে চব্বিশ ঘণ্টাই শত শত লোক অবস্থান করেন সে জায়গা পরিষ্কার রাখার জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মী না থাকলে কীভাবে পরিষ্কার থাকবে?
চতুর্থত, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নার্সদের। কিন্তু নার্সদের অপেশাদারি দায়িত্বহীন আচরণ রোগীকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ করে তোলে। নার্সদের সঙ্গে কর্মচারীদের বেপরোয়া আচরণ স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশকে জটিল ও অস্থির করে তুলছে।
পঞ্চমত, চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর কমিউনিকেশন গ্যাপের দায় মূলত চিকিৎসকদের। একজন রোগীকে রোগ ও তার ট্রিটমেন্ট নিয়ে যদি একটু ব্রিফ করা যায় তাহলে অনেক ভুল বুঝাবুঝি, আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস দূর হবে।সাধারণ মানুষ চান তারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলে যেন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক পান, একটা বেড পান, যেন হয়রানির শিকার না হন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেন হাসপাতালেই করাতে পারেন এবং কোনো পরীক্ষা যেন বাইরে করতে না হয়। নার্সরা যেন দায়িত্বশীল হন, মানবিক আচরণ করেন, কোনো কর্মচারী যেন অন্যায়ভাবে টাকা না নেন। আমি বা আমার আত্মীয়স্বজন অসুস্থ হলে আমার চাওয়াও তো এরকমই হবে।
সাধারণ মানুষের কাক্সিক্ষত মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো হলো দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সঠিক ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব, দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা, জবাবদিহির অভাব, স্বল্পমেয়াদি হেলথ পলিসি, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিকতা, অপ্রতুল বাজেট, কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় না থাকা। আমাদের দক্ষ স্বাস্থ্য প্রশাসন গড়ে তুলতে এই চ্যালেঞ্জগুলো ওভারকাম করতে পারলে অবশ্যই মানসম্মত চিকিৎসা অধরা হয়ে থাকবে না।
বিশেষ করে মানুষ যাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক সেবাটা পান, সে জন্য সেবা সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে হবে। কোনো কোনো হাসপাতালে এমনও হয়েছে যে, রোগীকে ডাক্তার দেখাতে ও ডায়াগনসিস করতে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে ছুটতে হয়, দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়, সঠিক কোনো নির্দেশনা পান না, অসহায় বোধ করেন। এসব জটিলতা দূর করতে হবে। সরকারি সেবা মানুষের জন্য সহজ করতে হবে। মানুষ যাতে হাসপাতালে গিয়ে সেবা নিতে হয়রানির মুখে না পড়েন, সেটা দেখতে হবে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের হাতে দিতে হবে।
চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের সুবিধা-অসুবিধা বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে হবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রভাব যেন না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সরকার অর্থ বিনিয়োগ করলেই মানুষ চিকিৎসা পাবে না। সেই অর্থ ও ব্যবস্থাপনা সহজ ও সমবণ্টন হতে হবে। তবেই মানুষের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কিডনি রোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য