-->

প্রকৃতির বদলার বলি উৎপাদন

মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকৃতির বদলার বলি উৎপাদন

বঙ্গদেশের ষড়ঋতুর প্রথম ঋতুটি গ্রীষ্ম। গ্রীষ্ম ঋতুর দুটি মাস বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ। শীতের দুই মাস ছাড়া গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহ বছরব্যাপী উৎপীড়ন করে প্রবল কষ্ট দেয়। প্রচন্ড গরমে নাভিশ্বাস করে ছাড়ে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ ও ব্যাহত করে তোলে। গরমের তীব্রতায় আমরা এরূপ নাকাল হয়ে চলেছি। গ্রীষ্মের প্রভাব কোনো না কোনোভাবে প্রায় সব ঋতুতেই বিরাজ করে। শীত মৌসুমেও শীতের পাশাপাশি গ্রীষ্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

 

যদিও অপর পাঁচ ঋতু গ্রীষ্মের তুলনায় সহনীয় ছিল। গ্রীষ্মের মতো এতটা যন্ত্রণাদায়ক ছিল না। এখন তো উষ্ণপ্রধান দেশ হিসেবেই আমাদের বিবেচনা করা যায়। তপ্ত গ্রীষ্মেই আমরা প্রকৃতি থেকে পেয়ে থাকি নানা রসালো ফল। আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, তরমুজ, বাঙ্গি, তালের শাঁস ইত্যাদি। অন্য কোনো মৌসুমে এত ব্যাপকভাবে ফলমূল পাওয়া যায় না। গ্রীষ্ম তার উত্তপ্ততায় আমাদের শোষণ করে-পুড়িয়ে মারে তীব্র গরমে। অপরদিকে ওইসব রসালো ফল আমাদের সতেজ হতে সাহায্য করে। প্রাকৃতিক এই বৈপরীত্য ছিল গত ৩০ বছরের মধ্যে এবারের গ্রীষ্মে গরমের মাত্রা সর্বাধিক। গরমে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত।

 

বর্তমানে দেশজুড়ে বিরাজমান তস্কর গ্রীষ্ম। তাপমাত্রা ক্রমেই ভয়ানক পর্যায়ে। এরপরও জীবন-জীবিকা থেমে নেই। তীব্র গরম উপেক্ষা করে কায়িক পরিশ্রমী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবিকা নির্বাহে বাধ্য হচ্ছে। সাধারণভাবে আমরা অদৃষ্টের লিখন বলি, কিন্তু প্রকৃতির এই সর্বনাশা আচরণের কারণগুলোকে শনাক্ত-সন্ধানের চেষ্টা করি না। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণকে প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ বলেই বিবেচনা করে থাকি। প্রকৃত কারণ মোটেও তা নয়। প্রকৃতির ওপর মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে নানাভাবে। প্রকৃতির সহজাত প্রবৃত্তিকে মানুষ বাধাগ্রস্ত করছে উন্নয়ন ও উন্নতির অভিলাষে। প্রকৃতিও অস্বাভাবিক আচরণে বদলা নিচ্ছে। প্রকৃতির ওপর নিষ্ঠুরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে ভয়ানক মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রকৃতিও বসে নেই; ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছাস, আইলা, সুনামি নানা নামে হায়েনার রূপ ধারণে আঘাত করে চলেছে।

 

প্রকৃতির নানাবিধ নিষ্ঠুরতাকে এর স্বাভাবিক আচরণ বলে গণ্য করা যাবে না। প্রকৃতির ওপর তথাকথিত উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাদী তৎপরতায় প্রকৃতি তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। শিল্প, কল-কারখানায় মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি পুড়িয়ে প্রকৃতি বিনাশের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণে প্রাণ-প্রকৃতিকে হুমকির কবলে ফেলেছে। মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি পোড়ানোর কারণেই পৃথিবী উষ্ণ ও তপ্ত হয়ে উঠেছে।

 

শিল্পের বর্জ্য ফেলে সমুদ্র, নদী, নালা ভরাট প্রক্রিয়া থেমে নেই। সমুদ্রের গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে আইলা, সুনামি ইত্যাদি নামের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পুঁজিবাদী বিশ্বের উন্নয়নের চরম মাশুল গুনছে উন্নয়নশীল গরিব দেশগুলো। প্রকৃতি ও বায়ুমন্ডলের দূষণের কারণে পৃথিবী ক্রমেই বসবাসের যোগ্যতা হারাচ্ছে। তেমনি প্রকৃতিও হারিয়ে ফেলছে তার স্বাভাবিকতা। অতি শিল্পায়নের কারণে প্রাকৃতিক তান্ডব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী সংখ্যালঘু ধনী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে সম্মিলিত-সংগঠিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এখনো গড়ে ওঠেনি। তারই শতভাগ সুযোগে তাদের অপকীর্তি থেমে নেই। স্থায়ী প্রতিকারের বিপরীতে আর্থিক মুচলেকা দেয়ার ও পাওয়ার দেন-দরবার চলছে মাত্র।

 

প্রকৃতি দূষণ এবং প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্টের মূলে অতি শিল্পায়ন। অর্থাৎ পুঁজিবাদী মুনাফার অনাচার। শিল্প-কারখানা, গাড়ির দূষণ-ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ চলছে। এই দূষণ প্রক্রিয়ার মূলে অতি শিল্পায়ন অর্থাৎ অতি উৎপাদন, অতি মুনাফা। পুঁজিবাদ মুনাফা ভিন্ন কিছু বোঝে না। মুনাফার প্রয়োজনে সে হেন অপকীর্তি নেই, যা সে করতে না পারে। এক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে, সর্বাধিক পরিমাণে। শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি পুড়িয়ে অর্থনীতির বিশ্বায়ন নামক অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। একইভাবে বায়ুদূষণকারী জ্বালানি পুড়িয়ে পরিবেশকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। আশার কথা, নিজ দেশের জনগণের চাপে পরিবেশ দূষণের পথ পরিহারের কথা শিল্পোন্নত দেশগুলোকে নতুন চিন্তায় ফেলেছে। বিশেষ করে পরিবেশ দূষণে সর্বাধিক বিবেচ্য কয়লার ব্যবহার থেকে পিছু হটার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে।

 

সমীক্ষায় জানা যায়, বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণে-ধ্বংসে সর্বাধিক অবদান কয়লার ব্যবহার। কয়লা পোড়ানোর কারণেই পরিবেশ দূষণ মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে। শতভাগ পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ দূষণই কয়লা ব্যবহারের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ অন্যান্য জ্বালানির কারণে। শিল্পোন্নত দেশগুলো নিজ দেশের জনগণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে বাধ্য হয়ে কয়লার ব্যবহার সংকুচিত এবং বাতিল করে বিকল্প জ্বালানির বিষয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে।বিশ্বের পরিবেশ দূষণের জন্য সর্বাধিক দায়ী কয়লা। কয়লা সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী জ্বালানি বলেই কয়লা ব্যবহারে বিশ্বের পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়াবহ। উন্নত বিশ্ব কয়লাকে পরিত্যাগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ পরিত্যক্ত কয়লাকে বেপরোয়া ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছে। সরকার দেশজুড়ে অনেক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে।

 

যা মারাত্মকভাবে আত্মঘাতী এবং দেশ ও জনবিরোধী। কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামের রাউজানে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, খুলনায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পাবনার রূপপুরে ২ হাজার মেগাওয়াটের আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আমরা নিশ্চয় বিস্মৃত নই ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনের চেরনোবিলে অবস্থিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা।

 

ওই বিস্ফোরণে বেলারুশ, ইউক্রেন, রাশিয়াসহ ইউরোপের বিশাল অঞ্চলজুড়ে ছাড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়ায় ৯-১০ হাজার নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এরপরই পরিত্যাগে বাধ্য হয় বহু রাষ্ট্র। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও পারদর্শিতার বিচারে অগ্রগণ্য দেশগুলো যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে সম্পূর্ণ অদক্ষ এবং অভিজ্ঞতাশূন্য ঘনজনবসতিপূর্ণ দেশে মানুষ হত্যার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আমাদের সরকার কিসের মোহে! কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রেও বলা যায়, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের অশুভ পাঁয়তারা করছে সরকার। আমরা নিশ্চয় বিদ্যুৎ চাই। বিদ্যুৎ আমাদের মৌলিক চাহিদার অন্তর্গত। তাই বলে প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশ করে সে বিদ্যুৎ কার বা কাদের প্রয়োজন মেটাবে! সুন্দরবনসংলগ্ন রামপালে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এনটিপিসির সঙ্গে দাসখত চুক্তিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে সরকার। অথচ এনটিপিসির ভারতীয় ভূখন্ডের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনেক উদ্যোগ ভেস্তে গেছে ভারতীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধার মুখে এবং জনসাধারণের তীব্র প্রতিরোধে।

 

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় পরিত্যক্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কারণে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চরম মূল্য দিতে হবে। দেশের পরিবেশ, প্রাণ, প্রকৃতি বিনাশের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হতে পারে। আমাদের দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্য পরিবেশ দূষণের অভিযোগে আন্তর্জাতিক বাজার হারাবে। এতে দেশের অর্থনীতিতে যে চাপ আসবে- তা অতিক্রম করার উপায় থাকবে না। আর সে সামর্থ্যও আমাদের নেই। চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ শিল্পোন্নত দেশগুলো যেখানে কয়লাভিত্তিক শিল্পায়ন বন্ধে বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবছে। সেখানে বন্ধুদেশ ভারতের অবিক্রীত নিম্ন মানের কয়লার ক্রেতারূপে বাংলাদেশ ভারতের বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদানে নিজেদের সর্বনাশই ডেকে আনছে।

 

কয়লা মারাত্মক জীবাশ্ম জ্বালানি। কয়লা পোড়ানোর কারণে প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, নদ-নদী, খাল-বিল, ফসলের জমি হতে গাছ-গাছালি, মৎস্যসম্পদ, গবাদিপশু, খাদ্য, পানি, পণ্য সবকিছুই দূষণে আক্রান্ত হবে। সেই ভয়াবহ বিপর্যয় সামাল দেয়ার শক্তি-সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিযুক্ত ও কোণঠাসা হয়ে পড়বে। সেখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাবে না।বিদ্যুৎ নিশ্চয় আমাদের অতি প্রয়োজন। কিন্তু প্রাণ-প্রকৃতি এবং দেশ-জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে নয়। কয়লার পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবনই আমাদের করণীয় কর্তব্য। বর্তমানে গরমের তীব্র তাপদাহে আমরা নাকাল হচ্ছি। দায়ী করছি প্রকৃতিকে। অথচ প্রকৃত দায়ী তারাই যারা পরিবেশ বিনাশে জ্বালানি পুড়িয়ে পৃথিবীকে তপ্ত করে তুলেছে।

 

অর্থাৎ সেই পুঁজিবাদী মুনাফাকেন্দ্রিকতার কারণে বিশ্ব আজ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে। চিহ্নিত এই শত্রুর বিরুদ্ধে যথার্থ প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হলে আমরা আরো ব্যাপকভাবে দূষণের শিকারে পরিণত হব। প্রকৃতির নিষ্ঠুর ত্নডবে প্রাণ হারাব, দুর্বিষহ যন্ত্রণায় দগ্ধ হব। সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রকৃতির অবদান উপেক্ষা করা যাবে না। প্রকৃতি আর মানুষ হাত ধরাধরি করেই চলবে। পরস্পরের সম্পর্ক আদিকালের। মানুষ তো প্রকৃতিরই সন্তান। প্রকৃতির আলো-বাতাস ছাড়া মানুষ বা প্রাণীর জীবন রক্ষার কোনো উপায় নেই। প্রকৃতির অবদানেই পৃথিবীর তাবৎ প্রাণী-বৈচিত্র্য টিকে আছে। সেজন্য প্রকৃতি রক্ষার তাগিদে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। প্রকৃতিবিহীন আমরা বাঁচতে অক্ষম। প্রকৃতিবিরোধী মুনাফাবাজ পুঁজিবাদী শ্ত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ব্যর্থ হলে আমরা আমাদের অস্তিত্বকে রক্ষা করতে পারব না। সর্বাগ্রে জরুরি চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version