২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে নেমে এসেছে ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশে। একই সময়ের ব্যবধানে কর রাজস্ব নেমে এসেছে ৯ দশমিক ৮০ থেকে ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশে (সূত্র : অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩)।
অপরদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আহরণে ঘাটতির পরিমাণ ২২ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে (কাস্টমস)। ঘাটতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। এরপরই রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে মূসকে (ভ্যাট)। এ খাতে ঘাটতি ৫ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। সবচেয়ে কম ৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে আয়কর ও ভ্রমণ করে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। আগের অর্থবছর যা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছর আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে ১ লাখ ১১ হাজার, স্থানীয় পর্যায়ে মূসক ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ এবং আয়কর ও ভ্রমণ করে ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছিল। এই বাজেট বাস্তবায়নে এনবিআরকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজন ছিল। এনবিআরের কালেকশন দেখে মনে হচ্ছে, জনগণ সরকারকে কর দিতে চায় না। আবার ব্যবসায়ীরাও সরকারকে ভ্যাট দিচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতি পরিস্থিতি ভালো নয়। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণ কমে আসারই কথা। যেভাবে রাজস্ব আহরণ কমছে এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েই চলতে হবে সরকারকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আগস্টের পর সেপ্টেম্বরেও রাজস্ব আয়ের চিত্র ভালো নয়। ২০২১-২২ বছরের একই সময়ের চেয়ে এ মাসে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৫২ শতাংশ। যদিও ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২০১৭ সালের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ দশমিক ০৫ শতাংশ।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে রাজস্ব আয় হয়েছে ১৭ হাজার ৭৮৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পরের মাস অক্টোবরে আয় হয়েছে ১৭ হাজার ৭০৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ, সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে আয় কমেছে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের প্রধান তিন খাতেই আদায় কমেছে। খাত তিনটি হলো- আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক-কর, স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট এবং আয়কর ও ভ্রমণকর। টিআইএনধারী সবাই যাতে আয়কর রিটার্ন দাখিল করে তারা সেই উদ্যোগ নিচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা।
এর মধ্যে শুল্ক খাতে ৬ হাজার ৭৬৬ কোটি, ভ্যাটে ৬ হাজার ২৯৯ কোটি এবং আয়কর ও ভ্রমণ করে এসেছে ৪ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) এ সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। পরের মাস আগস্টে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ১২ শতাংশে। এ মাসে মোট রাজস্ব আহরণ হয় ২২ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুল্ক থেকে ৮ হাজার ৯৬ কোটি, ভ্যাট এসেছে ৮ হাজার ৭৩৩ কোটি এবং আয়কর ও ভ্রমণ করে আয় হয়েছে ৫ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা।
রাজস্ব আহরণ প্রবৃদ্ধি ক্রমেই নিম্ন গামী বিষয়টা সবাইকে ভাবাচ্ছে ও শঙ্কা তৈরি করছে। অর্থনীতির আকার অনুযায়ী ক্রমেই যেখানে তা বাড়ার কথা সেখানে চিত্র বিপরীত।
সাদামাটা কারণ হিসেবে করোনার ধাক্কা বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলা হলেও এক্ষেত্রে এনবিআরের যে দায়িত্ব ছিল সেটা তারা পালনে সক্ষম হচ্ছে কি-না, তা ভালো করে দেখতে হবে। দেশের অধিকাংশ মানুষ করের আওতায় আসে না এবং যারা কর দেন তারাও সরকারকে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন। কী কারণে এনবিআর রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না সেটা রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরা দরকার।
এনবিআর যদি জবাবদিহির আওতায় থাকত তাহলে সবাই জানতে পারত যে, এ প্রতিষ্ঠান কেন পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না। এনবিআর যদি রাজস্ব আহরণে তার ভূমিকা না রাখতে পারে সেটাও জনগণকে জানানো দরকার। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুযায়ী সংস্কারে ব্রত না হয়ে নিজ থেকেই রাজস্ব আহরণ বাড়াতে দরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার।
প্রতি বাজেটেই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাকে বাড়িয়ে ধরা একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। এ বছর দেখা যাচ্ছে, সব ক্যাটাগরিতেই প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। তবে মূল্যস্ফীতির কারণে রাজস্ব আয়ে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা।
কারণ, ন্যূনতম আয় তো বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধি অনেক কম। তবে এর প্রভাবে মুনাফা হয়েছে অনেক বেশি, যা উচ্চবিত্তদের হাতেই গেছে। সেটা ট্যাক্সে কোনো প্রভাব ফেলেনি। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি হওয়ার কথা, কিন্তু তা হচ্ছে না।
রাজস্ব আদায় এভাবে ক্রমাগত কমার কারণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগসহ রাজস্ব আদায়কারী মূল প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউয়ের (এনবিআর) সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে কর ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার আনা প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম। অর্থনীতির মূল সমস্যাগুলো সমাধানে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ প্রদানের জন্য সরকারকে আগে থেকেই চাপে থাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে আরো বেশি টাকা ধার করতে হবে এবং আরো বেশি সুদ দিতে হবে।
ইতোমধ্যে সরকার বৈদেশিক সহায়তার অংশ কমিয়ে দিয়ে এডিপিতে বরাদ্দ ৭.৫ শতাংশ কমিয়ে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টানার নিচে নামিয়েছে। কিন্তু দেশীয় উৎস থেকে বরাদ্দ ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকার মতোই রয়ে গেছে। এর অর্থ রাজস্ব কর্তৃপক্ষ সম্পদের ব্যবধান কমাতে এবং কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে আইএমএফের শর্ত পরিপালনের জন্য কর রাজস্ব আদায় বাড়ানোর প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য চাপে থাকবে।
অর্থাৎ, কর-জিডিপি বাড়াতে না পারলে সার্বিক অর্থনীতি থাকবে চাপের মুখেই।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য