নারী অধিকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনসহ অনেকেই সোচ্চার। এসব সংগঠনের উদ্যোগ ও জনস্বার্থ মামলার কারণে বিভিন্ন সময়ে এসব বিষয়ে নতুন আইন ও নীতিমালা তৈরি হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের অনীহা ও গড়িমসির কারণে তা সম্ভব হয়নি, যার ফলে নারী তার পরিপূর্ণ অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে হিন্দু নারীরা আইনি অধিকারের ক্ষেত্রে খুব উপেক্ষিত।
এ উপমহাদেশ এক সময় ব্রিটিশরা শাসন করত। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। স্বাধীন হওয়ার পর ভারত হিন্দু নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেশকিছু আইন প্রণয়ন করে, যেমন হিন্দু বিবাহ আইন-১৯৫৫; হিন্দু নাবালকত্ব ও অভিভাবকত্ব আইন-১৯৫৬; হিন্দু দত্তক ও ভরণপোষণ আইন-১৯৫৬; হিন্দু উত্তরাধিকার আইন-১৯৫৬; হিন্দু বিবাহ বৈধকরণ আইন-১৯৪৯ এবং বিশেষ বিবাহ আইন-১৯৫৪। এই আইনগুলো প্রণয়নের মাধ্যমে ভারতের হিন্দু পারিবারিক আইনে ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে ভারত আরো যুগোপযোগী করেছে। সব হিন্দু মতবাদের জন্য অভিন্ন আইন প্রবর্তন করেছে। বিয়ে নিবন্ধনের বিধান করা হয়েছে। স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ ইচ্ছা করলে বিয়ে বিচ্ছেদ এবং বিয়ে বিচ্ছেদের পর যে কেউ পুনরায় বিয়ে করতে পারবে। উভয়ের বিয়ে বিচ্ছেদের পর ভরণপোষণের ব্যবস্থা এবং সন্তানদের হেফাজতে রাখার প্রশ্নেও আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারবে। সব ধরনের হিন্দু মতবাদে অভিন্ন উত্তরাধিকারের বিধান রাখা হয়েছে। হিন্দু পুরুষের মৃত্যুর পর তার পুত্র-কন্যা, স্ত্রী ও মায়ের মধ্যে সম্পত্তির বিলিবণ্টনের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। একজন নারী যেকোনো উপায়ে সম্পত্তি অর্জন করলে, সেটার মালিকানা শর্তহীনভাবে তিনি ভোগ ও হস্তান্তর করতে পারেন।
ভারতের আইনে নারীদের দত্তক গ্রহণের অধিকার দেয়া হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কা অবিবাহিত হিন্দু নারী দত্তক নিতে পারবেন। বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত, ধর্মান্তরিত বা আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষিত হলেও দত্তক নিতে পারবেন। নারী-পুরুষ যে কাউকেই এবং নিকটাত্মীয় থাকলেও আগন্তুক যে কাউকে দত্তক নেয়া যাবে। দত্তক পুত্র-কন্যাও স্বাভাবিক পুত্র-কন্যার মতো উত্তরাধিকার পাবে। এসব বিষয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকারের বিধান রাখা হয়েছে।
কিন্তু পাকিস্তান আমল ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি হিন্দু পারিবারিক আইনে তেমন কোনো সংস্কার সাধিত হয়নি। সম্প্রতি যে আইনটি হয়েছে তা হলো হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন করার বিধান করে প্রণীত হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন-২০১২। এটি ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি কার্যকর হয়। এ আইনে বলা হয়েছে, অন্য কোনো আইন, প্রথা, রীতিনীতিতে যা কিছু থাকুক না কেন, হিন্দু বিবাহের দালিলিক প্রমাণ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে হিন্দু বিবাহ, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিবন্ধন করা যাবে এবং ২১ (একুশ) বছরের কম বয়স্ক কোনো হিন্দু পুরুষ বা ১৮ (আঠারো) বছরের কম বয়স্ক কোনো হিন্দু নারী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে তা এই আইনের অধীন নিবন্ধনযোগ্য হবে না। তবে এর সঙ্গে কোনো হিন্দু বিবাহ এই আইনের অধীনে নিবন্ধিত না হলেও এ কারণে হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পন্ন বিবাহের বৈধতা ক্ষতি হবে না এই অংশটুকু যোগ করে এবং নিবন্ধন না করলে তাকে দন্ডযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা না করে আইনের বিধানটিকে আবার ঐচ্ছিক হিসেবেই রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনে নারীর বিয়ে বিচ্ছেদ নেই, সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার নেই আজও। অথচ ভারত ও নেপালসহ অন্যান্য হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের হিন্দু আইনে সমভাবে সবার অধিকার আছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে সব নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ-১৯৭৯ এ বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষর করে, যেখানে নারীর অধিকার ভোগ ও চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কথা বলা হয়েছে। অথচ সম্পত্তিতে সমান অধিকার না থাকার কারণে হিন্দু নারী বিভিন্নভাবে বঞ্চনা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশে হিন্দু আইনে নারীর সম্পত্তির অধিকার প্রশ্নে আজও প্রাচীন ও রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণাই প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের পারিবারিক অধিকারের পথটি এখনো সংকুচিত। তারা যে দুভাবে সম্পত্তি পান তা হলো তার নামে সেসব সম্পত্তি ক্রয় করেন, উপহার পান বা দান হিসেবে লাভ করেন, সেগুলো স্ত্রীধন। অন্যটি ১৯৩৭ সালের সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার আইন অনুসারে পিতার কাছ থেকে বা স্বামীর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পান। এই দুটির সীমাবদ্ধতা হলো এই সম্পদ তিনি জীবদ্দশায় ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু কাউকে দান করতে পারবেন না। ফলে উত্তরাধিকারের মূল বিষয় সেটা তিনি ভোগ করতে পারবেন না।
২০১৭ সালে আইন কমিশন থেকে পিতার সম্পত্তিতে মেয়ের সমান অধিকার দেয়া এবং বিয়ে বিচ্ছেদের সুযোগ রাখাসহ হিন্দু আইন সংস্কারের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবসহ সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু হিন্দু নেতাদের বিভক্তির কারণে পরে তা অগ্রগতি হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) অসহায় ও নির্যাতিত মানুষের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে। এ সংগঠনের লিগ্যাল এইড ক্লিনিকে যেসব অভিযোগ আসে, তার মধ্যে হিন্দু নারীদের অভিযোগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, হিন্দু নারীরা মূলত স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের অভিযোগ বেশি করে থাকেন। তখন সমঝোতার মাধ্যমে তারা আলাদা বসবাস করেন। কিন্তু তাতে বিয়ের সমাপ্তি ঘটছে না। পুরুষরা আবারো বিয়ে করতে পারলেও নারীরা পারছেন না। এখন হিন্দু নারীরাও বিয়ে বিচ্ছেদের অধিকার চান।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, বিদ্যমান হিন্দু আইনটি পক্ষপাতমূলক। এ আইনের মাধ্যমে হিন্দু নারীদের নানাভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। একই বাবার ঔরসজাত সন্তান হয়েও ছেলেরা সম্পত্তি পাবে আর মেয়েরা পাবে না এ ধারা বর্তমান যুগে অচল। অবশ্যই হিন্দু আইন সংস্কার হওয়া দরকার। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানাদাশ গুপ্ত বলেন, হিন্দু নারীদের বিয়ে বিচ্ছেদসহ নানা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন।
হিন্দু নারীর অধিকার বিষয়ে বেসরকারি কিছু মানবাধিকার সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে তারা সচেতনামূলক প্রোগ্রাম ও অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ মে ২০২৩ তারিখে হিন্দু আইনের বিয়ে নিবন্ধন, বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক ও সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার অধিকার সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করা হয়।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শুনানিতে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১৪ মে ২০২৩ হিন্দু নারীর (বিয়ে নিবন্ধন, বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক ও সম্পত্তির সমান অধিকার) অধিকারগুলো সুরক্ষায় নীতিমালা বা নির্দেশনা গ্রহণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা যেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছে।
বিয়ে নিবন্ধন, বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক ও সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার বিষয়ে হিন্দু নারীর অধিকার অর্থাৎ তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইনসচিব, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব, ধর্মসচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলসহ বিবাদীকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নীরব ভূমিকা পালন করে। হিন্দু নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দায়েরকৃত জনস্বার্থে মামলাটি নতুন দিক উন্মোচন করবে বলে আশা করা যায়। এ জনস্বার্থ মামলাটি সনাতন আইনবিরোধী নয়। বরং মামলা সনাতন আইন সংস্কার হয়ে আধুনিক, অধিকার দেবার জন্য অন্যতম আইন হতে পারে বলে আশা করা যায়। মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি শেষে হিন্দু নারীর পারিবারিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে এমনটিই আশা করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য