-->

আবার কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার?

ড. মিল্টন বিশ্বাস 
আবার কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার?

২০০৭ সালে ‘কেন বন্দি মুজিব দুহিতা’ কবিতায় কবি মহাদেব সাহা জিজ্ঞাসা ছুড়ে দিয়েছিলেন এভাবে-‘শেখ হাসিনা কেন কারাবন্দি এই কথা বলতে বলতে/দেখি মুক্তিযোদ্ধার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,/হাত থেকে পড়ে যায় অন্নথালা/দেখি দুঃখে তার বিরান হয়ে যায় শস্যক্ষেত্র, জলশূন্য হয়ে পড়ে দিঘি সরোবর/পিতৃমাতৃভ্রাতৃ হারা বাংলার সবচেয়ে দুঃখী মানুষ/তার কে আছে আপন আর এই মাটি ও মানুষ ছাড়া?/এমন যে দুঃখী মানুষ যার দুটি চোখ সর্বক্ষণ অশ্রুর নদী/৭ মার্চ আর ২১-এ ফেব্রæয়ারির এই স্বাধীন বাংলাদেশে/সেই চিরদুঃখী তোমার কন্যা আজ কারাবন্দি, হায় পিতা।’

 

প্রকৃতপক্ষে এদেশের মাটি ও মানুষ ছাড়া তার আপন আর কে আছে? আর এ জন্যই জনগণ সেদিন জেগে উঠেছিল। বন্দি শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছিল। একই বছর শেখ হাসিনার বন্দিদশা নিয়ে ‘আশাহত হবার তো কথা নেই’ কবিতায় আনোয়ারা সৈয়দ হক লিখেছিলেন-‘আশাহত হবার তো কথা নেই/মশালের লাল ওই জ¦লছে/পথ পাড়ি দিতে হবে তোমাকেই/এ কথাই সকলে বলছে।’ আসলে গ্রেপ্তার হওয়া শেখ হাসিনা সেদিন দুঃসহ জেল-যন্ত্রণার পথ পাড়ি দিয়ে অমৃতের সন্ধান এনে দিয়েছিলেন জনগণকে।

 

আর এ কারণেই ১৬ জুলাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ দিবস হলেও শেখ হাসিনার জন্য দিনটি অবিনাশী সাহস আর প্রত্যয়ে অভিষিক্ত। তবে তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য ভয়ঙ্কর একটি চ্যালেঞ্জের দিনও। কারণ, সেদিন তাকে বিতর্কিত করে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার হীন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল। যদিও সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয় দেশের প্রতিবাদী জনগণ। এজন্যই দিনটি স্মরণীয়।

 

গতকাল ছিল শেখ হাসিনাকে কারাগারে নিক্ষেপের ষোড়শ বার্ষিকী। দিনটি দেশের ইতিহাসে ‘গণতন্ত্র অবরুদ্ধ ও হত্যা প্রচেষ্টা দিবস’ হিসেবে বহুল পরিচিত। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে ধানমন্ডির নিজ বাসভবন সুধাসদন থেকে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের জন্য সুধাসদনের চারদিক বিভিন্ন বাহিনীর দুই সহস্রাধিক সদস্য ঘিরে রেখেছিল।

 

বঙ্গবন্ধুকন্যা এর মধ্যে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যৌথবাহিনীর কাছে জানতে চান, কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে। চুপ করে ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা।

 

গ্রেপ্তারের আগে নেত্রীর নামে একাধিক মামলা দেয়া হয়। বাসা থেকে তাকে পুলিশের একটি জিপে করে ঢাকার সিএমএম আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত এলাকায় তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশবাহিনীর দায়িত্বহীনতার কারণে তিনি নাজেহালের শিকার হন। সেদিন সিএমএম কোর্টে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় ৩৬ মিনিট বক্তব্য দেন।

 

সেই সকালে অনেক রাজনৈতিক কর্মী কোর্ট প্রাঙ্গণে ছুটে গিয়েছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। আদালতে শেখ হাসিনার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করায় তাকে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে বিশেষ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত কয়েকটি মামলায় বিশেষ জজ আদালত তার বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তীতে ওই সব মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে শেখ হাসিনা হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।

 

গ্রেপ্তারের পরই বঙ্গবন্ধুকন্যার মুক্তির দাবিতে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কবিরা সরব হন কবিতায়। প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হলে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী তাকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা করানোর দাবি জানান। উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে কারাবন্দি শেখ হাসিনাকে ২০০৮ সালের ১১ জুন আট সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি কান ও চোখের চিকিৎসা নেন।

 

দেশে ফেরার পর আবার তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। কারাবরণের পর প্রায় ১ বছর বন্দি ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে ১/১১-এর অগণতান্ত্রিক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের দেয়া মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করলেও শেখ হাসিনা পরবর্তীতে সেই অভিযোগ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অব্যাহতি পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত যে সত্যের জয় হয়, সৎ নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয় তাও প্রমাণিত হয়েছে।

 

আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে খুন করার সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার সংগ্রামী জীবনে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে দুঃখের কষ্টিপাথরে সহিষ্ণুতার দীক্ষায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে।

 

পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই দীর্ঘ ২১ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি হন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হয়ে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অমানিশার দুর্যোগে প্রাণ বাঁচানোর দুঃসহ স্মৃতি, অর্থাৎ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া জীবন নিয়ে আবার নির্যাতিত জনগণের জন্য রাতদিনের পরিশ্রম। কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর সময় হঠাৎ করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি হলেন! শুরু হলো আরেক জীবন। সেই জীবনের স্মৃতি আছে তার রচনায়, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে।

 

বঙ্গবন্ধুর ৩ হাজার ৫৩ দিন জেল জীবনে কারামুক্তি দিবস একাধিক হলেও আমরা ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারিকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে তার জেল জীবনের সমাপ্তি টেনে দিবসটিকে মুক্ত স্বদেশের মুক্তির বারতায় তার নিশ্বাস নেয়ার অন্যতম দিন হিসেবে চিহ্নিত করি। অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ২৭ বছরের বন্দি জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন তার কারামুক্তি দিবস। বঙ্গবন্ধু ও ম্যান্ডেলা উভয়েই নিপীড়ক শাসকের কারা প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন বন্দি থেকেও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির চিন্তায় নিবেদিত ছিলেন।

 

অনুরূপভাবে শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়া সত্তেও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসকদের দ্বারা মিথ্যা মামলায় হয়রানি ও কারা-যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন দুর্ভাগ্যবশত। কারণ, স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের মতো নিপীড়ক শাসক থাকার কথা ছিল না।

 

দেশও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছিল। অথচ দেশ-বিদেশে টিকে থাকা বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা তখনো সক্রিয়। তাছাড়া শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের একাধিকবার চেষ্টা চলেছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে’র পর থেকে, যা ২০২২ পর্যন্ত ২১ বার বলে তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য দেয়। এমনকি সাবজেলে থাকার সময় ‘স্লো পয়জনিংয়ে’ তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।

 

গ্রেপ্তারের পর তাকে রাখা হয় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ সাব-জেলে। সেখানে তার খাবারে ক্রমাগত পয়জন দিয়ে তাকে মেরে ফেলার টার্গেট করা হয়। স্লো পয়জনিংয়ের কারণে বন্দি শেখ হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সবই ছিল তাকে এদেশের রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস’ করার ষড়যন্ত্র। এজন্য ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর তার দেশে ফেরার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। উদ্দীপিত হয় দলীয় নেতাকর্মীরা। যৌথবাহিনী তাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করার পর গণমানুষ তার অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিল।

 

সেসময় তার সাবজেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারজনের মৃত্যুবরণ, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপামর জনগোষ্ঠীকে বদলে দিয়েছিল। কারণ, তখন আদালতের চৌকাঠে শেখ হাসিনা ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা। দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত। বঙ্গবন্ধুরকন্যা হিসেবে সত্যকথা উচ্চারণে বড় বেশি সপ্রতিভ। উপরন্তু গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশবাসীর উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে যান।

 

ওই চিঠিটি নেতাকর্মীদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করে। উজ্জীবিত হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তিনি দেশবাসীর প্রতি তার আস্থার কথা জানিয়েছিলেন। তেমনি গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হওয়ায় দুঃসময়ে নেতাকর্মীরা কী করবেন তার নির্দেশনা দিয়েছিলেন

 

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ব বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু গবেষক, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version