-->
শিরোনাম

সর্বত্রই নারী যেন প্রায় অরক্ষিত

ড. আলা উদ্দিন
সর্বত্রই নারী যেন প্রায় অরক্ষিত

উৎসব কিংবা দুর্যোগ, বিদ্যালয় কিংবা পাবলিক বাস, কর্মক্ষেত্র কিংবা নিজগৃহে সর্বত্রই নারী যেন প্রায় অরক্ষিত। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে যেমন নারী নির্যাতনের প্রকোপ বেড়েছিল, তেমনি দেখা গেছে এবার ঈদুল আজহার উৎসব চলাকালীন সময়েও। ঈদের পাঁচ দিনের ছুটিতে নারী ও শিশু নির্যাতনের তথ্য জানিয়ে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কলের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে।

 

ছুটি শুরুর আগের পাঁচ দিনের তুলনায় এ সময় ফোনকল ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, যে অবস্থায়ই থাকুক না, নারী নির্যাতন চলছে, চলবে। স্বাভাবিক সময়ে তো চলবেই, অস্বাভাবিক বা সংকটকালে এর প্রকোপ আরো বৃদ্ধি পাবে। ঈদের সময়েও তাই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা আহত হওয়ার মতোই ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সমাধান তো নেই, প্রতিকারও নেই বললেই চলে।

 

জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কলের সংখ্যা থেকে বুঝা যায় পবিত্র ঈদুল আজহার পাঁচ দিনের ছুটিতে নারী ও শিশু নির্যাতনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নিযাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে দেশের প্রায় সর্বত্র গ্রামে-শহরে, কর্মক্ষেত্রে, পাবলিক স্পেসে, পাবলিক পরিবহনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহামারির মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ নয়, যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ থেকে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। ধর্ষণও হত্যার চেয়ে কম অপরাধ নয়।

 

গত জুন মাসে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে চলন্ত বাস থেকে সড়কে ফেলে দেয়া নারী দুই দিন পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ জুন সকালে মারা যান। ধর্ষণের চেষ্টাটি গত ১৬ জুন শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে ময়মনসিংহের শ্রীপুর থেকে ভালুকামুখী একটি বাসে সংঘটিত হয়েছিল। ভালুকা উপজেলায় পোশাক শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ওই নারী। এই রকম ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ধর্ষণ প্রতিনিয়ত যেমন দেশের সর্বত্র অব্যাহত রয়েছে, তেমনি এইরকম চলন্ত বাসে বা ট্রেনে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনও অব্যাহত রয়েছে। এর আগে একটি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যার কথা আমাদের মনে থাকার কথা।

 

২০১৮ সালের ১৪ এপ্রিল নেত্রকোনার মদনে চতুর্থ শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে প্রলোভন দেখিয়ে একটি ঝোপে নিয়ে এক প্রতিবেশী ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু শিশুটি চিৎকার শুরু করলে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয় (প্রথম আলো, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২)। গত বছরের আগস্ট মাসের ৫ তারিখেও এই রকম ঘটনা ঘটেছিল। রাতে গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তাকওয়া পরিবহনের একটি চলন্ত বাস থেকে স্বামীকে নামিয়ে দিয়ে এক নারীকে চোখমুখ বেঁধে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয় (প্রথম আলো, ৫ এপ্রিল ২০২৩)।

 

২ আগস্ট মঙ্গলবার কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেসের রাতের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বর্বরোচিত কায়দায় ডাকাতির পাশাপাশি পাশবিক যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে (সমকাল, ৪ আগস্ট ২০২২)। এসব বিকৃত অপকর্ম সভ্যতার মাপকাঠিতে মধ্যযুগীয়, কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র ঘটছে প্রতিনিয়ত। রাস্তা-ঘাট, বাস-ট্রেন, কর্মক্ষেত্র এমনকি বিশ^বিদ্যালয়ের আঙিনায় সর্বত্র নারীরা যৌন হয়রানির শিকার। প্রতিরোধ, প্রতিকার, বিচার এবং সামাজিক বর্জনের অভাবে মানুষরূপী দুর্বৃত্তরা দিনের পর দিন এহেন জঘন্য ঘটনা নির্বিচারে ঘটিয়ে চলেছে।

 

মাত্রা, ধারা, স্থান, ধর্ষকের পরিচয়, ইত্যাদি সকল বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় যৌন নির্যাতন বাংলাদেশে যেন মহামারিতে পরিণত হয়েছে। অন্যসব মহামারি ধীরে ধীরে হ্রাস পায়, কিন্তু যৌন সহিংসতা কেবলই বাড়ছে; নিয়ন্ত্রণহীন, ঘৃণ্য এবং জঘন্যহারে। এর গতি এবং পরিণতি এমন, এই মহামারি বাংলাদেশকে তার উন্নয়নের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছুতে দেবে না। কারণ, অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে (২০২২ এর জনশুমারি অনুযায়ী অর্ধেকের কিছু বেশি) অবদমিত-ভীতসন্ত্রস্ত রেখে সমাজের সার্বিক ও কাক্সিক্ষত বিকাশ বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নারীর ওপর কাপুরুষোচিত-পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এবং নির্দিষ্ট করে যৌন নিপীড়ন সমাজের সুষম ও সুষ্ঠু বিকাশের পথে একটি প্রচÐ বাধা।

 

যৌন নিপীড়ন মহামারির বিস্তার ও প্রতাপ এতটাই প্রকট যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও যৌন নির্যাতনের হার কমেনি। বরং সবাইকে অবাক করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তোয়াক্কা না করে, সমাজের প্রচলিত বিধিনিষেধকে অবজ্ঞা করে ক্রমেই বেড়ে চলেছে যেন। বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারি অনেকটা প্রশমিত হলেও যৌন নির্যাতন কোনোভাবেই কমছে না, বরং তা যেন নির্বিঘ্নে ঘটছে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস, সিলেট এমসি কলেজ এবং কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জমুখী রাতের বাসে। যৌন নিপীড়নের প্রকৃতি ও বিচার প্রক্রিয়া বলে দেয়, যেভাবে এর প্রাদুর্ভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, তা সমাজকে পুরোপুরি পঙ্গু না করা অবধি চলতেই থাকবে, যদি না অনতিবিলম্বে এর লাগাম টেনে ধরা হয়।

 

যৌন নির্যাতন বিকৃতি মোকাবিলা কেবল বিচার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এর সঙ্গে মনোজাগতিক চিন্তাভাবনা, পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তি, পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোণ, শোষণমূলক সমাজ এবং সমাজে প্রচলিত ভোগবাদী ধ্যান-ধারণার সম্পর্ক বিদ্যমান। কেন নারী তার ভাই, বাবা, কিংবা সন্তানের মতো অন্য পুরুষের যৌন লালসার শিকার হবে? সমস্যাটি কেবল লালসার বিষয় নয়। কেন একজন পুরুষ তার ঘরে মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা থাকা সত্তে¡ও একইরকম অন্য ঘরের নারীর ওপর হিংস্র হয়ে উঠবে, নির্যাতন করবে? কেন মনে মানবিক বোধ বা পাপবোধ কাজ করে না, কেন তারা পরিণতি ভাবে না? কীভাবে তারা নিশ্চিত থাকে যে, তাদের কিছু হবে না! এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

 

কেন নির্যাতনকারীরা ভাবে না, তারা যা করছে সে রকম পরিস্থিতি বিরাজ করলে তার নিজের মা, বোন বা কন্যাও শঙ্কা মুক্ত নয়। নিজের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য হলেও অন্যের পরিবারের মানুষের নিরাপত্তা, তথা পুরো সমাজে নিরাপদ পরিবেশের আবশ্যকতা রয়েছে। নিজের ঘরের মানুষদের নিরাপত্তার জন্য ঘরের বাহিরকেও নিরাপদ রাখতে হবে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মতো, যতক্ষণ না বাহির নিরাপদ, ততক্ষণ নিজের ঘরের আপনজনও নিরাপদ নয়।

 

অবস্থা এমন যে যৌন নির্যাতন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে, কোনো প্রকার কার্যকর ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ ব্যতিরেকেই। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবহন (বাস, ট্রেন), কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি সকল স্থানে এগুলো অহরহ ঘটছে। কয়টা ঘটনাইবা পত্র-পত্রিকায় স্থান পায়। মামলা হয় তার চেয়ে কম। যা কয়েকটা মামলা হয়; বিচার সম্পন্ন হয় তার চেয়েও আরো অনেক কম। মাঝে মাঝে আসামিও গ্রেপ্তার হয়; তবে কিছুদিন পর তারা বেরিয়েও আসে; বেরিয়ে এসে আবার যৌন নির্যাতন করে। গ্রেপ্তার হলেও শক্তি বা ক্ষমতার বলে কখনো কখনো অপরাধীরা নির্যাতনের শিকার বা তাদের পরিবারের সদস্য (যেমন ভাই, বাবা) বা সংবাদকর্মীর ওপর চড়াও হয়। সাম্প্রতিক সময়ে (২০২২ এর মধ্য জানুয়ারিতে) যেমন হুঙ্কার লক্ষ্য করা গেছে বরিশালে ‘শোন, সারা জীবন জেলে থাকমু না। কী হইছে? তাতে এত নিউজ করার কী আছে? আমি জেল থেইকা বাইর হইয়্যা লই। ব্যাপারটা দেখমু আনে’ (প্রথম আলো, জানুয়ারি ১৫, ২০২২) ।

 

অথচ কাগজে-কলমে এ দেশে নারীর সার্বিক বিকাশের মাত্রা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। নব্বই দশক থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ তথা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীরা অত্যন্ত সুদৃঢ়। বাংলাদেশে যখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থান দীর্ঘদিনের, সেখানে নারী নির্যাতনের, নির্দিষ্ট করে যৌন নির্যাতনের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া ক্ষমতা ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমন অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য নারী-পুরুষ সকলকে মতাদর্শের বদলের মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সম্প্রদায়, জনপ্রতিনিধি, ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে নারী নিগ্রহসহ যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে হতে হবে সোচ্চার। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে নিয়মিত অপরাধীদের ওপর সচিত্র সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে।

 

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নারী নিপীড়ন অব্যাহত থাকলে উন্নয়নমূলক ও সৃজনশীল কর্মকান্ডে নারীর অবদান ও অংশগ্রহণ থেকে দেশ বঞ্চিত হবে; অথচ সবার জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হলে দেশের উন্নয়ন হবে বেগবান। এই সত্যটি উপলব্ধি করত সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ ও সোচ্চার পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। নারী-পুরুষ সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে অবশ্যই এই যৌন নির্যাতন ও নারী নিগ্রহ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

 

দৃশ্যমান কয়েকটি উন্নয়নসূচক (শিক্ষার হার, চাকরি কিংবা বাসে বসার আসন) দ্বারা নারীর এই অধস্তন অবস্থার অবসান সম্ভব নয়। ভাবাদর্শগত পরিবর্তন ও প্রয়োজন অনুযায়ী বাস্তবিক রাষ্ট্রের (কঠোর আইনগত অবস্থানসহ) পদক্ষেপ অপরিহার্য। এখনই সময় যথাযথ প্রতিকারের, কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নয়, প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকল অঙ্গের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে।

 

লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version