বিজেপির বিদ্যমান শাসনামলে নানা ঘটনায় ও দৃষ্টান্তে ভারত হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে বলে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দলিত এবং অহিন্দু সংখ্যালঘু হত্যা, নির্যাতন-নিপীড়নের অজস্র নৃশংস ঘটনাসহ সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা অবিরাম ঘটেই চলেছে।
সাংবিধানিকভাবে ভারত এককেন্দ্রিক শাসনের অধীন। ভারত একজাতি ও এক সম্প্রদায়ের দেশ অতীতেও ছিল না। আজও নয়। অজস্র ভাষাভাষী ও বহু স¤প্রদায়ের দেশ ভারতে জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সাংবিধানিকভাবে খর্ব করা হয়েছে, সংবিধান প্রণয়নকালে। কংগ্রেস অখন্ড ভারতের দাবি তুলেছিল বৃহৎ ভারতের পুঁজিপতি গোষ্ঠীর সর্বভারতীয় জনগণের ওপর একচেটিয়া পুঁজির শাসন-শোষণ নিশ্চিত করার অভিপ্রায়ে।
স্বাধীনতার বহু পরে ১৯৭৪ সালে ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বাস্তবে সেটা কাগুজে পরিণত। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি উন্মুক্ত তবে কেন? ধর্মনিরপেক্ষ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস নেতৃত্বের স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেই ধর্মভিত্তিক পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিলেন। তবে ভারত বিভাগের জন্য কেবল জিন্নাহ একা দায়ী ছিলেন না।
হিন্দুরা এক পৃথক জাতি, এই কথা ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের আগে ১৯৩৮-৩৯ সালে হিন্দু মহাসভার অধিবেশনগুলোতে সাভারকার সভাপতি রূপে বারবার বলেছেন। গান্ধীও তখন ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান পৃথক দুটি জধপবং (নরগোষ্ঠী) বলে উল্লেখ করেছেন।
নির্বাচনে বিজয়ী নির্বাচিত সরকার মাত্রই গণতান্ত্রিক নয়। বিশ্ব ইতিহাসের নিন্দিত হিটলার, মুসোলিনিও কিন্তু জনরায় নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। দীর্ঘ মেয়াদে নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতায় থাকাই শাসকদের ফ্যাসিবাদী করে তুলতে অনুপ্রাণিত করে। প্রতিটি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারসমূহের মধ্যে তাই ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় না। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যে-রাজ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে দলটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ তকমা মুছে দেয়ার অভিপ্রায়ে চরম সাম্প্রদায়িক নীতি গ্রহণে মেতে উঠেছে। বামদুর্গ খ্যাত ত্রিপুরায় বিজেপি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দখলে নিয়েছে।
একই প্রক্রিয়ায় আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যে। পশ্চিম বাংলায়ও ৩৪ বছর বামফ্রন্টের শাসনাধীন থাকলেও বামফ্রন্টের পতন ঘটে। তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরে পশ্চিম বাংলায় বিজেপির আগমন। বিজেপির রথের চাকা পশ্চিম বাংলায় প্রায় অচলই ছিল। বিজেপির অবস্থার বদল ঘটতে কিন্তু বিলম্ব ঘটেনি। পশ্চিম বাংলায় শূন্য অবস্থান থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে বিজেপি।
গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ২ কোটি ৮৭ লাখ ভোট। অন্যদিকে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ২ কোটি ২৮ লাখ। প্রায় ৯২ জন বিজেপি প্রার্থী হেরেছে ১-৭ শত ভোটের ব্যবধানে। খাল কেটে কুমির আনার মাশুল দিতে হবে আখেরে তৃণমূলকেই। অচিরেই যদি পশ্চিম বাংলা ত্রিপুরার ভাগ্যবরণ করে তাহলে অবাক-বিস্ময়ের কারণ হবে না। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে ভারতের গণতন্ত্র ও সংবিধানকে। বামফ্রন্টের পতনে তৃণমূলের উত্থান আমাদের চমকে দিয়েছিল। ভবিষ্যতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির পশ্চিম বাংলার ক্ষমতা গ্রহণে আমরা কিন্তু বিস্মিত হবো না।
ভারতের সংবিধান প্রণয়নের সময়ে প্রতিটি রাজ্যের রাজ্যপালকে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল, ওই প্রস্তাব কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেন নেহরু। নেহরু ওই প্রস্তাবের বিপরীতে ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক রাজ্যপালের নিয়োগকে সংবিধানভুক্ত করেন। স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস এবং নেহরুর অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাবের কারণে প্রস্তাবকরা নিশ্চুপ হয়ে যান।
কংগ্রেস দলের প্রস্তাবই সংবিধানে সর্বাধিক অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, দলের ও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় এবং নানা ক‚টকৌশল অবলম্বনে। কেন্দ্রীভ‚ত শাসনের জালে আবদ্ধ ভারতের রাজ্যগুলোর শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা কেন্দ্র কর্তৃক কুক্ষিগত। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত রাজ্যপাল ক্ষমতাসীন সরকারের অনুগত-তল্পিবাহক। পশ্চিম বাংলার প্রাক্তন বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথাগত রায় বিজেপির কেন্দ্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ত্রিপুরার রাজ্যপাল পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। রাজ্যপালের পদ সাংবিধানিক এবং রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করার এখতিয়ারও রাজ্যপালকে দেশটির সংবিধান দিয়েছে। রাজ্যপালদের অসীম ক্ষমতা প্রদানের মাশুল এখন স্বয়ং কংগ্রেস দলকেই বহন করতে হচ্ছে।
রাজ্যপালের দৌরাত্ম্যের একটি ঘটনা ঘটে দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক রাজ্যে। রাজ্যে ভোটের হিসাবে প্রথম বিজেপি, দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং তৃতীয় অবস্থানে ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দল। কর্নাটক রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যার পরে কংগ্রেস ও ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দলের আসন সংখ্যা। নির্বাচনের পর পরই কংগ্রেস ও ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দল (জেডিএস) ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গড়ে তোলে। দুই দলের মোর্চা গড়ার ফলে আসন সংখ্যা দাঁড়ায় বিজেপির তুলনায় অধিক।
সংখ্যাগরিষ্ঠতা মোর্চার থাকলেও কর্নাটকের বিজেপি অনুগত রাজ্যপাল বাজুভাই বালা সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা উপেক্ষা করে বিজেপির ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রী রূপে শপথ করিয়েছিলেন। এ নিয়ে কংগ্রেস ও জেডিএস আদালতের শরণাপন্ন হয়। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী আদালত এবং রাজ্যপাল উভয়ে সাংবিধানিক। সাংবিধানিক আদালত সাংবিধানিক রাজ্যপালের স্বেচ্ছাচারমূলক মুখ্যমন্ত্রীর শপথকে বাতিল করার এখতিয়ার রাখে কিনা সে প্রশ্নও উঠেছিল।
আশার কথা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হবেন বিবেচনায় শপথের ৭২ ঘণ্টার মাথায় স্বেচ্ছায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে কংগ্রেস এবং জেডিএস জোট রাজ্যে সরকার গঠন করে। কংগ্রেস-জেডিএস জোট-এর অধিক আসন সংখ্যার পরও রাজ্যপাল কোন যুক্তিতে বিজেপিকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণসহ ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রীর শপথ করিয়েছিলেন? ওদিকে বিজেপি কংগ্রেস ও জেডিএস-এর বিধায়কদের অর্থের বিনিময়ে দলে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। দল ভাঙতে এবং দলভুক্ত করতে বিজেপি অর্থের ভান্ডার উন্মুক্ত করে দিয়ে রাজ্যে রাজ্যে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারছে।
আদানি এবং আম্বানিসহ ভারতীয় পুঁজিপতিরা নিজেদের মুনাফার স্বার্থে বিজেপিকে আর্থিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ভারতজুড়ে চাউর রয়েছে, যে-দল ওই পুঁজিপতিদের ব্যবসায়িক সুবিধা প্রদানে যতবেশি সুবিধা দেবে পুঁজিপতিরা সে-ই দলকে ক্ষমতা বসাবে।
অর্থাৎ জনগণ নয়, কোন দল ক্ষমতায় বসবে তার নির্ধারণ করে ভারতীয় পুঁজিপতিরাই। বাস্তবতা যে তার থেকে দূরবর্তী সেটা কিন্তু নয়। বর্তমান শাসক দল বিজেপি পুঁজিপতিদের অর্থ ও তাদের মিডিয়ার প্রচারণায় ক্ষমতায় এসেছে এবং শেকড় গেড়ে বসেছে। সে-কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সংস্থাসমূহ ওই পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। ।
আমাদের উপমহাদেশের তিন খন্ডে বিভক্ত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতায় থাকা সরকারেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন নিজেদের দেশের শেষ সরকার বিবেচনা করে। এটা যে চরম আত্মঘাতী সেটা ইতিহাসের নানা দৃষ্টান্ত এবং অভিজ্ঞতায় বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ বাংলার প্রবচন রয়েছে, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য