-->

প্রসঙ্গ : জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা

অসিত কুমার মন্ডল
প্রসঙ্গ : জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা

শিক্ষার মাপকাঠি নির্ধারণের যত শিক্ষাই থাক না কেন, বর্তমান যুগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষক ছাড়া শিক্ষা অর্জনের বিকল্প কোনো মাধ্যম নেই বললেই চলে। সার্টিফিকেট বা সনদপত্র অর্জনের জন্য কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজায় হাজির হতেই হয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার এটাই সর্বশেষ রূপ বা চূড়ান্ত মাধ্যম বলা যায়।

 

এ কারণে দেশের সর্বত্র দিনের পর দিন বিভিন্ন প্রকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করছে। শিক্ষা গ্রহণের পর উচ্চশিক্ষা বা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর যারা শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন, তারা শিক্ষক। তাদের পারিশ্রমিক যেটা দেয়া হয়, সেটাকে বলা হয় বেতন। দেশের প্রচলিত সার্ভিস রুলস অনুসারে এমপিওভুক্তির (মান্থলি পে-অর্ডার) পর একজন শিক্ষক বেতন পান।

 

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি সরকার ক্রমান্বয়ে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছে। সর্বশেষ বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন-ভাতা কয়েক দফায় দ্বিগুণ, তিনগুণ হারে বৃদ্ধি করেছেন। যেটিকে সম্মানজনক বলা যায়। শিক্ষকদের সাপ্তাহিক দুদিন ছুটি কার্যকর করেছেন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিফট সিস্টেম চালুর কারণে শিক্ষকরা টানা আট ঘণ্টা ডিউটির স্থলে ৩-৫ ঘণ্টা কর্তব্য পালন করেন।

 

অধিকাংশ শিক্ষক ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোচিং সেন্টারের নামে স্কুলের আদলে শ্রেণিভিত্তিক রুটিনমাফিক ক্লাস চালু করেছেন। যেখানে দিন-রাত শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের আনাগোনা। বৈশাখী ভাতা, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ কত সুযোগ-সুবিধা। অথচ আমাদের শিক্ষকদের তাতে মন ভরছে না। তারা শিক্ষা জাতীয়করণের নামে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন করছেন। জাতীয়করণটা কী? কাকে বলে? তার পরিকাঠামো বা অবকাঠামো কী হবে? এটা কোনো শিক্ষক সঠিকভাবে স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। তারা আন্দোলনের মধ্যে বক্তব্যে শুধু তাদের অভাব-অভিযোগ আর সুযোগ-সুবিধার কথা বলছেন, পেটের ক্ষুধার কথা বলছেন, অভুক্তির কথা বলছেন।

 

শিক্ষা জাতীয়করণ শুধু দেশের মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা স্তরের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা নয়। শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের পদ-পদবি অনুযায়ী এবং সরকারের নির্ধারিত বেতন কোটা অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাবেন। এসব বিষয় শিক্ষা জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রণয়ন বা প্রচলনের আওতায় পড়ে না। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি দেশের সরকারের অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং ফান্ডের ওপরে নির্ভর করে।

 

সরকার তার অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনুযায়ী দেশের সার্ভিস রুলস অনুসারে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করতে পারে। সেটা বর্তমান সরকার করেছে। বিগত সরকারের সময়ে একজন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকের প্রারম্ভিক বেতন স্কেল ৩ হাজার ৪০০ টাকা ছিল। বর্তমান সরকার প্রথমবারে বৃদ্ধি করে ৮ হাজার ২৫০ টাকার স্কেলে উন্নতি করে। দ্বিতীয়বার ১৬ হাজার টাকার স্কেল প্রদান করেছে। এভাবে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চতর শিক্ষা স্তর পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছে।

 

কিন্তু শিক্ষা জাতীয়করণ বিষয়টি দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবকাঠামো। যেখানে প্রাথমিক লেবেল থেকে শুরু করে উচ্চ স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। যদি জাতীয়করণ করতে হয়, সেখানে শিক্ষার সব স্তরের শিক্ষক-কর্মচারী আন্দোলনে শামিল হবেন কেন? সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটা নির্ধারণ করবেন।

 

শিক্ষা জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সংজ্ঞা : দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার শ্রেণি এবং স্তর ভেদে, সব স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায়, সরকারি কারিকুলাম অনুযায়ী একটি অভিন্ন পাঠ্যসূচির আওতায় পাঠদান প্রক্রিয়া ও পরীক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটানোর ব্যবস্থাই শিক্ষা জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষা নীতি বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা।

 

যদি আরো একটু পরিষ্কার করে বলি- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞান এমন ৫টি বিষয় পড়ানো হয়। এই বিষয়গুলো দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রাথমিক লেবেলের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন- কিন্ডারগার্টেন, মাদরাসা, সরকারি, বেসরকারি সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে একই পাঠ্যপুস্তক রূপে বিদ্যমান থাকবে। আলাদা কোনো পাঠ্যপুস্তক থাকবে না। তবে এভাবে শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটাতে হলে ‘জাতীয় শিক্ষা বোর্ড’ গঠন করতে হবে। যেখান থেকে দেশের বিভাগীয় সব শিক্ষা বোর্ড পরিচালিত হবে একই কারিকুলামে। কোনো বোর্ডের সঙ্গে কোনো শিক্ষা বোর্ডের পার্থক্য থাকবে না। এ জন্য একটি জাতীয় শিক্ষা কমিটি থাকতে হবে।

 

আমরা দেখেছি একই দেশের ভেতরে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যসূচির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আবশ্যিক বিষয়গুলো যেমন- বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞানসহ অন্য আবশ্যিক বিষয়গুলোর পাঠ্যপুস্তকগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। আবার মাদরাসা বোর্ডের আবশ্যিক বিষয়গুলোও তাদের কারিকুলাম অনুযায়ী ভিন্নভাবে লেখা হয়েছে এবং পরীক্ষাব্যবস্থাও ভিন্ন।

 

ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা কারিকুলামে পরিচালিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণের পর শিক্ষার্থীরা যখন কর্মজীবনে অর্থাৎ পেশাগত জীবনে প্রবেশ করছে যোগ্যতার মাপকাঠিতে প্রচলিত আবশ্যিক বিষয়ের জ্ঞানে বিশেষ করে কারিগরি এবং মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা অনেক দুর্বল। সাধারণ শিক্ষা কারিকুলামে পাস করা একজন শিক্ষার্থীর মেধা স্কোর যদি ৮০ হয়, কারিগরি বা মাদরাসা বোর্ডের একজন শিক্ষার্থীর মেধা স্কোর ৩০।

 

অথচ চাকরি ক্ষেত্রে গিয়ে তারা শতভাগ অধিকার ভোগ করছে। এ ছাড়া রয়েছে আরেকটি শিক্ষা কারিকুলাম ‘ওপেন ইউনিভার্সিটি’ বা ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মাধ্যমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের সুব্যবস্থা রয়েছে। এখানে কারা পড়ছে? সঠিক শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, উড়নচন্ডী, বাউন্ডুলে যত শিক্ষার্থীদের জন্য এই ব্যবস্থার প্রচলন। উদাহরণটা এমন- আমাদের বাড়ির অপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং যত ময়লা, আবর্জনা কুড়িয়ে যেমন ঝুড়িতে বা ডাস্টবিনে জমা করি।

 

পরে এসব ময়লা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা গাড়িতে ভরে নিয়ে কোনো নির্ধারিত ডোবা বা নিচু স্থানে জমা করে। মেধাহীন, মেধায় দুর্বল এমন ধরনের সব স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষার স্থান ওপেন ইউনিভার্সিটি। অথচ এই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থেকে পাস করা অনেকেই এ দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে।

 

বিশেষ করে রেজিস্ট্রিকৃত সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুঁজলে এমন বহু শিক্ষককে খুঁজে পাওয়া যাবে। আজকে এমন ধরনের বহু শিক্ষক সমমর্যাদায় সমান অধিকার ভোগ করছেন। আবার তারা বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করছেন। বড় আশ্চর্য সেলুকাস।

 

শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালায় কোনো ‘স্টপেজ নীতি’ না থাকার কারণে সেখানে একজন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে পাস করা ডিগ্রিধারী সরকারি প্রাইমারি, সরকারি-বেসরকারি হাইস্কুল, কলেজে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক হিসেবে আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন আবার নিয়োগপ্রাপ্তও হচ্ছেন।

 

সুতরাং শিক্ষাকে যদি জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলন করতে হয়, তাহলে আগে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত সব পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় অভিন্ন পাঠ্যসূচি এবং অভিন্ন শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে বিশেষ করে শিক্ষানীতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কিছু ‘স্টপেজ’ থাকতে হবে। বিশেষ করে দেশের যেকোনো স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি দানের ক্ষেত্রে। এগুলো না থাকার কারণে একজন শিক্ষিত বেকার না বুঝে যেকোনো স্থানে আবেদন করে বসেন এবং ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডারে অহেতুক টাকা নষ্ট করেন।

 

কর্তৃপক্ষ নিয়োগ কোটা পূরণ করতে গিয়ে, ব্যাংক ড্রাফট/পে-অর্ডারের টাকা হালাল করতে গিয়ে, সব আবেদনকারীর আবেদনকে বৈধ হিসেবে গণ্য করে চাকরি প্রার্থীকে ভাইবা বোর্ডে আহব্বান করেন। এভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি, অফিস-আদালত, কোট-কাচারি, ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন অধিদপ্তরে মেধাশূন্যরা মামা-খালু আর টাকার জোরে এ দেশে চাকরি ক্ষেত্রে জায়গা দখল করে নিয়েছে/নিচ্ছে। সেখানে মেধাবীদের শিক্ষার সনদ নিরর্থক!

 

পরিশেষে বলব, যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় রূপদান করতে হয়, উপস্থাপিত ওই বিষয়গুলোর ওপরে নজর দিয়ে সঠিক পর্যালোচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।

 

লেখক : কবি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক গবেষক।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version