-->
শিরোনাম

মূল্যস্ফীতি হয় ছাপানো টাকায়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ
মূল্যস্ফীতি হয় ছাপানো টাকায়

আমার ভাতিজা শামীম আহমেদ জিতু কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য নিয়ে পিএইচডি করছে; সে আমাকে শিরোনামোক্ত বিষয়ে একটি কলাম লেখার জন্য অনুরোধ করে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি নিয়ে পড়েছে। একসময় বাংলা-ইংরেজি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখত সে- এখন কানাডা থেকে নিয়মিত দৈনিক জনকণ্ঠে লিখে। আমি বহু বছর টাকশালের দায়িত্বে ছিলাম বিধায় সে এই কলাম লেখার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে।

 

বাংলাদেশের নামকরা অর্থনীতিবিদদের অনেকে টাকা ছাপানো বন্ধ করতে বলেছেন; তারা বলছেন, ছাপানো টাকা না থাকলে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ পাবে না। সম্ভবত কথাটি রূপকার্থে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কারণ অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর সঙ্গে সরকারের ঋণ নেয়ার সম্পর্ক একেবারেই নেই। টাকা ছাপানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক চাহিদার ভিত্তিতে; চাহিদা নিরূপিত হয় প্রয়োজন এবং অভিজ্ঞতার আলোকে। পুরাতন জরাজীর্ণ নোট প্রায় প্রতিদিন ধ্বংস করা হয়, ধ্বংসপ্রাপ্ত নোট নতুন ও প্রচলনযোগ্য নোট দিয়ে প্রতিদিন প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।

 

দেশের অর্থনীতি প্রতি বছর সম্প্রসারণ হচ্ছে, পরিধি বড় হচ্ছে- অর্থনীতির সম্প্রসারণই নতুন অর্থ তৈরি করছে এবং এজন্য প্রতি বছর অতিরিক্ত নোটের প্রয়োজন হয়। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নোটের সরবরাহে যাতে কখনোই ঘাটতি না হয় সেজন্য নতুন নোটের মজুত গড়ে তোলা হয়। ক্লিন নোট পলিসির ওপর জোর দেয়া হলে প্রচলনযোগ্য পুরাতন নোটও আর বাজারে ছাড়া হয় না, নতুন নোট বেশি ছাড়া হয়। নোটের চাহিদা নিরূপণে সরকারের ঋণের পরিমাণ আলাদাভাবে কখনো হিসাবে আনা হয় না।

 

দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বা টাকশাল তার সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করে টাকা বা নোট ছাপায়। সব মেশিন ২৪ ঘণ্টা চালিয়েও টাকশালের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। ১৯৮১ সালে তৈরি ৫টি মেশিন দিয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৫ বছর ধরে নোট উৎপাদন করা হয়েছে, মেশিনগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৬ সালে নোট মুদ্রণের আরেকটি লাইন সংস্থাপন করা হয়। একটি নোট মুদ্রণে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মেশিন ব্যবহৃত হয়, ২০০ টাকা মূল্যমানের নোটের জন্য লাগে চারটি মেশিন।

 

নোটের কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে; কিন্তু কাঁচামালের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান মাত্র দুই-তিনটি। প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট কোনো কারণে কাঁচামাল সংগ্রহ বিলম্বিত হলে নোট উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং এই আশঙ্কায় নতুন নোট সব সময় ভল্টে মজুত থাকে। মজুত থাকে বিধায় সরকারকে দেয়ার জন্য আলাদাভাবে নোট ছাপানোর প্রয়োজন হয় না। সরকার শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় না, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও নেয়। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ ছাপানো টাকা নয়। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের অধিক মাত্রায় ঋণ গ্রহণের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহকে সংকুচিত করার সম্ভাবনা বাড়ে।

 

রাজস্ব আদায় কম হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে- যারা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বিভাগের ব্যাপক দুর্নীতি নিয়ে দুদক কথা বলেছে, দুর্নীতি দূর করার কতিপয় সুপারিশও দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বিভাগ দুর্নীতি দূর করার কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো দুদকের দুর্নীতির প্রতি ইঙ্গিত করেছে। এই বিভাগে দুর্নীতি এত ব্যাপক যে, সরকারকে ভ্যাট, কর, কাস্টম ডিউটি কীভাবে কম দিতে হয় তার পথ এই বিভাগের লোকজন নাগরিকদের বাতলিয়ে দেয়।

 

এই বিভাগের কর্মচারী-কর্মকর্তারাই কর, ডিউটি ইত্যাদি ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিয়ে পরে আবার তা খুঁজে বের করে এবং খুঁজে পাওয়ার পর যত টাকা আদায় হয় তার একটি অংশ পুরস্কার হিসেবে পায়। এই খেলায় মনে হয়, অফিসের একপক্ষ ছাড়ে এবং অফিসের আরেক পক্ষকে তা জানিয়ে রাখে। ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে এবং দুর্নীতি রোধ করতে ২০০৮ সাল থেকে সারা দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার বা ইসিআর মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি।

 

আমাদের মতো সাধারণ লোকের ধারণা, ঘুষ এবং দুর্নীতি অবিচ্ছিন্ন রাখার স্বার্থে কর ভ্যাট আদায়ে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়নি। দুর্নীতি অব্যাহত রাখার কুমতলবে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের ক্ষেত্রেও প্রিপেইড মিটার সংস্থাপন বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মতে বছরে ১৯ লাখ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব; এই লক্ষ্যমাত্রা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বেশি মনে হলেও রাজস্ব আদায় যে বাড়ানো সম্ভব সে ব্যাপারে অর্থনীতিবিদরা একমত।

 

প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায় হয় না বলেই সরকারকে ঋণ করে ব্যয় করতে হচ্ছে। সরকারের ব্যয় সংকোচনের সুযোগ কম, উন্নয়নের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন এবং যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে সেগুলোর অবকাঠামো নির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতেই হবে, মাঝ পথে থেমে গেলে ইতোমধ্যে ব্যয়িত অর্থের আর কোন আউটপুট থাকবে না।

 

বাজেট পাস হওয়ার পরপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অনুক‚লে অর্থের ছাড় শুরু হয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বরাদ্দ করা অর্থ খরচে নানাবিধ কর্মকান্ড শুরু করে। সরকার সারাবছর যে রাজস্ব আদায় করে তা জমা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে, সরকারের সব ব্যয় পরিশোধও হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। সরকারের পক্ষে লেনদেন শেষ করে দিনশেষে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সঙ্গে দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করে। সরকারের পক্ষে জমা বেশি হলে ঋণ সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয় না, জমা কম হলে ঋণের উদ্ভব ঘটে।

 

লেনদেনে প্রতিদিন ঘাটতি হলে ঋণ বাড়তে থাকে। সরকারের একাউন্টে টাকা না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের কোনো চেক ডিজঅনার করতে পারে না। তাই বাজেটে যে ঘাটতি আছে তা পূরণ করতে সরকারকে ঋণ নিতেই হবে। তবে সরকার যদি মনে করে, যে কাজ বা প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেই কাজ বা প্রকল্পের গুরুত্ব কমে গেছে বা একেবারেই নেই, তখন সরকার সেই প্রকল্প বাদ দিয়ে ব্যয় কমাতে পারে।

 

সরকার ঋণ নিলে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ে; বাজারে অর্থ সরবরাহ বেশি হলে মূল্যস্ফীতি হয়। মূল্যস্ফীতি রোধে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমানোর নানাবিধ কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়। অর্থ সরবরাহ হ্রাস করে মূল্যস্ফীতি কমানো গেলেও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়ানো সম্ভব হয় না। বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে গেলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও হ্রাস পায়, তখন মানুষ ব্যয় করতে হিসাবি হয়ে ওঠে।

 

মানুষ ব্যয় করার ক্ষেত্রে হিসাবি হয়ে গেলে জিনিসপত্রের বিক্রি কমে যায়, বিক্রি কমে গেলে উৎপাদক লোকসানের সম্মুখীন হয় এবং অধিক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের স্থবিরতা নেমে আসে। মূল্যস্ফীতি কমানোর আরেকটি পথ হচ্ছে উৎপাদন বাড়ানো; কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও সীমিত জমি উৎপাদন বাড়ানোর প্রধান প্রতিবন্ধক।

 

এ ছাড়া উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়। বাজারে পণ্যের জোগান বাড়ানোর আরেকটি পথ হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানি। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত পণ্য এনে বাজারে জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে আমরা যে সবাই পণ্য নিয়মিত বিদেশ থেকে কিনি সেসব পণ্যের দর বিশ্ববাজারে অসহনীয় পর্যায়ে বেড়ে গেছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশ কিছুটা মূল্যস্ফীতি কমাতে সমর্থ হয়েছে, তবে তাদের মূল্যস্ফীতি ছিল অনেক বেশি। তুরস্ক তাদের মূল্যস্ফীতি ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করতে সমর্থ হয়েছে।

 

সরকারের অর্থায়নে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধির অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য; কিন্তু তাই বলে খিচুড়ি রান্না শেখার জন্য বিদেশে যাওয়ার খরচ বহন করা গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া উচিত, কোনো কলাকৌশলে যাতে আমলা-মন্ত্রী বিদেশে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করা জরুরি।

 

এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনয়ন জরুরি, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা অর্জন আরও বেশি জরুরি। সরকারি অর্থ চুরি, ডাকাতি বন্ধ করা সম্ভব হলেও সরকারের ঋণ কমবে। ঘুষ আর দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হলে প্রকল্প ব্যয় কমে যাবে, প্রকল্প ব্যয় কমে গেলে সরকারের ব্যয় কমবে, সরকারের ব্যয় কমলে সরকারের ঋণও কমবে, সরকারে ঋণ কমলে সরকারের ঋণের জন্য অর্থনীতিবিদদের কথিত টাকা ছাপানোর আর প্রয়োজন হবে না।

 

লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version