‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ শব্দবন্ধ প্রায় একটি ঐতিহাসিক প্রবচনে পরিণত হয়েছে। সেই হিসেবে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সাড়ম্বরে মৎস্য সপ্তাহ কিংবা মাছের মেলার গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা অস্বীকার করা যায় না। ‘নিরাপদ মাছে ভরব দেশ গড়ব স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২৩ পালিত হয়েছে ২৪ থেকে ৩০ জুলাই।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের সবিশেষ ভূমিকা এবং উৎপাদন আরো বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে জনসাধারণকে আরো বেশি উদ্বুদ্ধকরণ তথা সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরজুড়ে গ্রন্থমেলা, পুষ্পমেলা, বাণিজ্যমেলা, লোক ও কারুশিল্পমেলা, শাকসবজি-ফলমূলের মেলা, দই ও ঘোলমেলা, পিঠার মেলা এমনকি কম্পিউটার মেলার কথা শোনা গেলেও মাছের মেলার কথা প্রায় শোনা যায় না বললেই চলে। অথচ প্রতিবছর দেশব্যাপী পালন করা হয় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ। এ সময়ে মাছের পোনা ছাড়া হয় গণভবন-বঙ্গভবনের পুকুর, লেকসহ বিভিন্ন জলাশয়ে। সেখানে সারা দেশে মাছের মেলায়ই বা বসবে না কেন? জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে মৎস্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, তবে তা সীমিত পর্যায়ে।
যাদের একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা হলো বগুড়ার পোড়াদহ সন্ন্যাসী মেলা, যেটি শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। মেলাটি প্রায় সাড়ে চারশ’ বছরের পুরোনো। এক সময় প্রধানত সন্ন্যাসীদের ধ্যান-জ্ঞান-আরাধনার ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠলেও কালক্রমে তা পরিণত হয়েছে বাঙালির লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধর্মীয় সম্প্রীতির মেলবন্ধনের মেলায়। এই মেলার প্রধান আকর্ষণ মাছ।
তিন শতাধিক মাছের দোকানে সমৃদ্ধ এই মেলায় ৪০ কেজি ওজনের রুই জাতের মাছ বিক্রি হতে দেখা গেছে ৮০ হাজার টাকায়। এর পাশাপাশি অন্যান্য বৃহৎ আকৃতির মাছও ঠাঁই পেয়েছে মেলায়। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ১২ কেজি ওজনের মাছের আকৃতির বৃহৎ মিষ্টি। পোড়াদহ সন্ন্যাসী মেলা জামাই মেলা হিসেবেও পরিচিত স্থানীয়ভাবে। আশপাশের দুই শতাধিক জামাই এই মেলায় এসে থাকে শ্বশুরবাড়ির জন্য মাছ-মিষ্টিসহ নিত্যপণ্য কেনাকাটার উদ্দেশে। মজার বিষয় হলো মূল, মেলার পরদিন বসে বউ মেলা যেখানে নারী ছাড়া প্রবেশাধিকার থাকে না কোনো পুরুষের। মাঘের শেষ ও ফাল্গুনের শুরুতে এই মেলা ব্যাপক জনসমাগমে সমৃদ্ধ ও সরগরম হয়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্যে।
মাছের উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে রোল মডেল, ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম। মৎস্য সম্পদে চতুর্থ স্থান অধিকারী বাংলাদেশ এখনো সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণে অনেক পিছিয়ে আছে। সুবিশাল বঙ্গোপসাগরের বিপুল অর্থনৈতিক সীমানা থেকে এখন পর্যন্ত খুব কমই মৎস্য সম্পদ আহরণ হয়ে থাকে। আগামীতে এই অফুরান সম্পদ আহরণ করতে পারলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে মৎস্য সম্পদে। অবশ্য ইলিশও প্রধানত সামুদ্রিক ও সমুদ্র উপকূলীয় মাছ। মোহনার মাধ্যমে ইলিশ মিঠা পানির নদ-নদীতে প্রবেশ করে থাকে প্রজনন মৌসুমে। আর তখনই ধুম পড়ে যায় জাটকা তথা পোনা ইলিশ আহরণের। যেকোনো মূল্যে এটা বন্ধ করতে পারলে ইলিশের উৎপাদন আরো বহুগুণ বাড়বে ভবিষ্যতে।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তিন শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি আসে মাছ থেকে। বিশ্বের ৬৫ শতাংশ ইলিশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১১ ভাগই ইলিশ। উপকূলীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের প্রায় পাঁচ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি জড়িত।
এ ছাড়া ২০ থেকে ৯৫ লাখ লোক জড়িত পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কাজে। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি অপরিহার্য উপাদান হলো মাছ। নদ-নদী-জলাশয় রক্ষাসহ মাছের প্রযত্ন ও সুরক্ষার দায়িত্ব সবার।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য