দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু হয়েছে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ এবং ২০৪১ সালে তাদের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লাখ। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার সুযোগ তৈরি করতে দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা (স্কিম) চালু করেছে সরকার।
এই পেনশনব্যবস্থার মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি বয়সি দেশে-বিদেশে থাকা ১০ কোটি মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার চিন্তা রয়েছে সরকারের। মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, ধীরে ধীরে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা এবং তাদের নিরাপত্তাহীনতা। আর এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক আগ্রহে চালু হলো সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা। এ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবার আরো ভালো ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করা হলো।
সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য কর্মে অক্ষম বয়সে সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান কিংবা জমাকৃত অর্থের ওপর সুদের শতাংশে লভ্যাংশ গুনে বাড়তি অর্থ ফেরত দেয়া নয়; বরং উদ্দেশ্য অবসরকালে বাঁচার মতো ন্যূনতম অর্থ সুরক্ষা হিসেবে প্রদানের নিশ্চয়তা। সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার দর্শন হচ্ছে ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা, মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা এবং অবসরপ্রাপ্ত মানুষের আর্থিক কষ্টের ঝুঁকি কমাতে অবসরের পর পর্যাপ্ত ‘আয় প্রতিস্থাপন’ করা।
বিশ্বের সব কল্যাণরাষ্ট্রে প্রবীণ নাগরিকরা এই সুবিধা ভোগ করেন। ১৮৮৯ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর ভন বিসমার্ক সরকারের রাজস্ব আয় থেকে ৬৫-ঊর্ধ্ব শ্রমিকদের সবাইকে একই হারে সামাজিক পেনশনের প্রবর্তন করেন। জার্মানির যুগান্তকারী এ উদ্যোগের সাফল্য দেখে ১৮৯১ সালে ডেনমার্ক ও ১৮৯৮ সালে নিউজিল্যান্ডও সামাজিক পেনশনব্যবস্থা চালু করে। বিশ শতকে এসে পেনশন স্কিম আরো জনপ্রিয়তা লাভ করে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। ২০১৫ সালে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন। ২০১৬ সালে ভারত ঘুরে এসে অর্থ বিভাগের একটি দল একটি ধারণাপত্র তৈরি করে। তবে কাজটি আবদুল মুহিত শেষ করে যেতে পারেননি।
নতুন করে এ আলোচনা গতি পায় ২০২২ সালে এবং এ বছর আরেকটি ধারণাপত্র তৈরি করে অর্থ বিভাগ। এর পর এ বছরের ৩১ জানুয়ারি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন এবং এ আইনের আওতায় ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। এতে দেশে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশনব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। এর প্রধান লক্ষ্য দেশের সব নাগরিককে সম্মানের সঙ্গে বাঁচার সুযোগ করে দেয়া।
দেশের ষাট-ঊর্ধ্ব সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত একটি মহৎ ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ স্কিম চালানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে সরকারের। প্রথমে স্বেচ্ছায় যারা এ স্কিমে যুক্ত হতে চাইবেন, তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। পরে এটি বাধ্যতামূলক করা হবে। এ স্কিম চালু হওয়ায় জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে লক্ষণীয় অগ্রগতি ঘটবে।
বর্তমানে চারটি আলাদা স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে। এগুলো হলো প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। প্রবাস স্কিমটি শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। প্রগতি স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদের জন্য। সুরক্ষা স্কিম রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি প্রমুখ স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য। আর সমতা স্কিম নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। পেনশনব্যবস্থা পরিচালনা ও বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা অর্থ বিভাগের আওতাধীন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে পেনশনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রত্যেক চাঁদাদাতার জন্য একটি আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে। চাঁদাদাতা ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ হওয়ার বাকি সময় মাসিক ভিত্তিতে পেনশন পাবেন। ১০ বছর চাঁদা দেয়ার আগে কেউ মারা গেলে জমা হওয়া অর্থ মুনাফাসহ ফেরত পাবেন নমিনি। পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং মাসিক পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।
চারটি স্কিমের জন্য আলাদা চারটি হিসাব খোলা হয়েছে সোনালী ব্যাংকে। এ হিসাবগুলোয় চাঁদা জমা হবে। সোনালী ব্যাংক দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরে অন্য ব্যাংকও যুক্ত হবে। প্রবাস স্কিমে ৭, সাড়ে ৭ ও ১০ হাজার টাকা; প্রগতি স্কিমে ২, ৩ ও ৫ হাজার টাকা এবং সুরক্ষা স্কিমে ১, ২, ৩ ও ৫ হাজার টাকা করে চাঁদা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। শুধু সমতা স্কিমে চাঁদার হার একটি। আর তা হচ্ছে এক হাজার টাকা।
এর মধ্যে চাঁদাদাতা ৫০০ ও সরকার ৫০০ টাকা করে দেবে। সারা দেশে সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ২২৯টি শাখাতেই সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার সেবা দেয়া হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকে কারও হিসাব থাকুক বা না থাকুক, নির্ধারিত ফরম পূরণ করে এই ব্যাংকের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি বয়সি যে কেউ পেনশন স্কিমের চাঁদা দিতে পারবেন।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দেশের মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। মানুষকে অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতের মাধ্যমে তিনি মানুষকে উন্নত জীবন দিতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের পথ বেয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, জাতি হিসেবে মর্যাদা পেয়েছি। আমরা যদি স্বাধীনতা না পেতাম, তা হলে আমাদের কোনো পরিচয় থাকত না। জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণের জন্য মাতৃসম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শোকের মাসে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবায়তায় সাধারণ নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা সময়ের শ্রেষ্ঠ উদ্যোগ। এর মাধ্যমে দেশের মানুষ তাদের জীবন অন্তত সুরক্ষিত করতে পারবে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের www.upension.gov.bd ওয়েবসাইটে ঢুকে এই প্রকল্পের জন্য নিবন্ধন করা যাবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর প্রথম দিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত অন্তত ৬ হাজার ১০০ জন নিবন্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ৪৬৩ জন প্রথম কিস্তির চাঁদা জমা দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) পর্যন্ত মোট চাঁদা পরিশোধ করেছেন ৮ হাজার ৫৫১ জন। আর তাদের জমা দেয়া চাঁদার পরিমাণ ৪ কোটি ৩৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ বেশি বলে জানা গেছে। স্বতন্ত্র অ্যাপসের মাধ্যমে পরিচালিত হবে বলে এতে দুর্নীতি ও হয়রানির সুযোগ থাকবে না। তাই সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করবে।
শ্রমবাজারের ১০ কোটি মানুষের কথা বলা হলেও বেকারদের জন্য আপাতত কোনো স্কিম নেই। বিষয়টি নিশ্চয় বিবেচনা করা হবে। স্কিমে আরেকটি অসামঞ্জস্য হচ্ছে এককালীন আনুতোষিক বা গ্র্যাচুইটি না থাকা। বেসরকারি বা শ্রমনির্ভর দীর্ঘ চাকরিজীবনের পর এককালীন বড় একটা অঙ্ক না পেলে মানুষের নিজস্ব আবাসনের মতো বড় স্বপ্ন অপূর্ণই থাকবে। সরকারকে এখানে বরাদ্দ দিতে হবে।
তা না হলে সরকারি ও বেসরকারি পেনশনে বৈষম্য থাকবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুষম ব্যবস্থাপনা। এ জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগকারী, ব্যাংকার- যারা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অভিজ্ঞ। বহির্বিশ্বে যেসব দেশে বেসরকারি পর্যায়ে সর্বজনীন পেনশনের মতো স্কিম আছে- তারা ওই টাকা শেয়ারবাজার, বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ করে লভ্যাংশ বের করে আনে। আমাদের দেশে কীভাবে লভ্যাংশ আসবে, এ ধারণা এখনো স্পষ্ট নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসনীয় উদ্যোগ সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ভুক্ত মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং মর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলবে। ফলে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য হ্রাস পাবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের একাত্মতা বাড়বে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হবে- এটিই প্রত্যাশা।
লেখক : রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব বিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য